জলপাইগুড়ি, 17 এপ্রিল: "বিজেপি আপনাদের কী দিয়েছে ? কেন ভোট দেন ?", সম্প্রতি ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি বিধানসভা কেন্দ্রে প্রচারে এসে আক্ষেপ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী ৷ উত্তরবঙ্গে তিন-তিনটি কেন্দ্র- জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহার বিজেপির দখলে ৷ 2014 সালে ঘাসফুল ফুটলেও পরের লোকসভা ভোটেই তার দখল নিয়েছে বিজেপি ৷ উত্তরের এই কেন্দ্রগুলির মধ্যে জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ারে চা-বলয় ৷ এখানে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে চা-শ্রমিকদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য ৷ আর কোচবিহারে সীমান্তে পাচার, অনুপ্রবেশের সমস্যা রয়েছে ৷ মুখ্যমন্ত্রী তাঁর প্রচার সভায় বারবার বিএসএফের বিরুদ্ধে গুলি চালানোর অভিযোগ তুলেছেন ৷ এবারে তৃণমূলের হাতিয়ার কেন্দ্রের মনরেগা, আবাস যোজনা প্রকল্পে বাংলাকে বঞ্চনা ৷ তখন ভারতীয় জনতা পার্টির অভিযোগ তৃণমূলের দুর্নীতি ৷
আগামী 19 এপ্রিল দেশজুড়ে প্রথম দফার লোকসভা নির্বাচনে এই তিন কেন্দ্রে ভোট ৷ এবার কি তৃণমূল এই আসনগুলিতে ফের ঘাসফুল ফোটাতে পারবে ? এপ্রিল মাসের পয়লা দিন থেকে দু'দুসপ্তাহ উত্তরবঙ্গেই থেকে গিয়েছেন তৃণমূল সুপ্রিমো ৷ জলপাইগুড়িতে তৃণমূল প্রার্থী বিধায়ক নির্মল চন্দ্র রায়, আলিপুরদুয়ারে তৃণমূলের প্রকাশ চিক বড়াইক আর কোচবিহারে বিধায়ক জগদীশ বর্মা বসুনিয়ার হয়ে লাগাতার প্রচার করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷
এর মধ্যে 31 মার্চ দুপুরে জলপাইগুড়িতে হঠাৎ টর্নেডোর ফলে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বাড়িঘর ভেঙেচুরে একেবারে তছনছ হয়ে যায় ৷ সেদিন দুপুরে কৃষ্ণনগরে মহুয়া মৈত্রর সমর্থনে প্রচারসভা ছিল মমতার ৷ সেই প্রচার সেরে তিনি কলকাতা ফিরে গিয়েছিলেন ৷ তবে দুর্ঘটনার খবর পাওয়ামাত্র মধ্যরাতে জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ারের বিধ্বস্ত অঞ্চলে ছুটে যান ৷ তারপর থেকে জলপাইগুড়ির চালসাকে ক্যাম্প অফিস করেই আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্রে প্রচার চালিয়ে গিয়েছেন তৃণমূল সুপ্রিমো ৷ মাঝে দু'দিন মাত্র তিনি কলকাতায় ফিরেছেন ৷
মাথাব্যথা উত্তরবঙ্গ:
উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার- তিনটি কেন্দ্রেই দীর্ঘ সময় ধরে বামেদের দখলে ছিল ৷ 2014 সালের লোকসভা ভোটে জলপাইগুড়ি কেন্দ্র, কোচবিহার ও আলিপুরদুয়ারে জয়ী হন তৃণমূল প্রার্থীরা ৷ এরপর 2019 সালের লোকসভা নির্বাচনে মাত্র 5 বছরের ব্যবধানে হঠাৎ পালাবদল ঘটে উত্তরের এই তিনটি কেন্দ্রেই ৷
জলপাইগুড়ি লোকসভা- 2024 সালের বিজেপির লোকসভা প্রার্থী ডঃ জয়ন্তকুমার রায় আগের লোকসভা ভোটে জয়ী হয়েছিলেন ৷ এবারও তাঁকেই প্রার্থী করেছে ভারতীয় জনতা পার্টি ৷ চা-বাগান অধ্যুষিত এই জেলায় অন্যতম সমস্যা চা শ্রমিকদের মজুরি । আবার জেলার একদিকে বাংলাদেশ সীমান্ত আর অন্যদিকে ভুটান সীমান্ত ৷
2019 সালে বিজেপি প্রার্থী ডাঃ জয়ন্তকুমার রায় তৃণমূলের প্রার্থী বিজয় চন্দ্র বর্মনকে 1 লক্ষ 84 হাজার ভোটে পরাজিত করেন ৷ তিনি পেয়েছিলেন 7 লক্ষ 60 হাজার 150 ভোট, প্রাপ্ত ভোটের হার 50.65 শতাংশ ৷ তৃণমূল প্রার্থীর ঝুলিতে এসেছিল 5 লক্ষ 76 হাজার 141 ভোট, প্রাপ্ত ভোট মাত্র 38.39 শতাংশ ৷
এরপর 2021 সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল খানিকটা ঘুরে দাঁড়ায় ৷ জলপাইগুড়ি লোকসভা কেন্দ্রের জলপাইগুড়ি, রাজগঞ্জ, মালবাজার, মেখলিগঞ্জ বিধানসভা তৃণমূল দখল করে ৷ অন্যদিকে ধূপগুড়ি, ময়নাগুড়ি, ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি যায় বিজেপির কাছে ৷
নির্বাচনী প্রচারে এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার চা-শ্রমিকদের জমির পাট্টা দেওয়ার কথা বলেছেন ৷ ফ্রিতে রেশন, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার থেকে শুরু করে একাধিক সরকারি প্রকল্পের কথা প্রচারে বলেছেন ৷ এমনকী জলপাইগুড়িতে টর্নেডোয় যাঁদের বাড়ি পুরোপুরি ভেঙে গিয়েছে, তাঁদের জন্য বাংলার বাড়ি প্রকল্পে বাড়ি তৈরির আশ্বাস দিয়েছেন ৷ তবে আদর্শ নির্বাচনী আচরণবিধি লাগু থাকায় নির্বাচন কমিশনের অনুমতির অপেক্ষায় আছে রাজ্য সরকার ৷ এই কথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায় নিজেই জানিয়েছেন, মঙ্গলবার, 16 এপ্রিল জলপাইগুড়িতে নির্বাচনী প্রচার সভা থেকে ৷
আলিপুরদুয়ার লোকসভা-
চা-বলয়ের আরেকটি লোকসভা কেন্দ্র আলিপুরদুয়ার ৷ তাই প্রার্থীদের জয়ের নেপথ্যে চা-শ্রমিকদের ভোট এখানে গুরুত্বপূর্ণ ৷ এবার এই কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী প্রকাশ চিক বড়াইকের লড়াই বিজেপি বিধায়ক মনোজ টিগ্গার সঙ্গে ৷ এর 2019 সালের লোকসভা নির্বাচনে আলিপুরদুয়ার লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী জন বার্লা 7 লক্ষ 50 হাজার 804 ভোটে জয়ী হন, প্রাপ্ত ভোটের হার 54.40 শতাংশ ৷ তৃণমূল প্রার্থী দশরথ তীর্কে 5 লক্ষ 6 হাজার 815 টি ভোট পেয়েছিলেন, যা মোট ভোটের 36.72 শতাংশ ৷ তৃণমূলের দশরথ তীর্কেকে হারিয়ে 2 লক্ষ 43 হাজার 989টি ভোটে জয়ী হয়েছিলেন বিজেপির জন বার্লা ৷ বিশেষত চা বলয়ের আশীর্বাদেই এই কেন্দ্রটির দখল নিয়েছিল বিজেপি ৷ এদিকে আলিপুরদুয়ার লোকসভা কেন্দ্রের 7 টি বিধানসভাতে 2021 সালে জয়ী হয় বিজেপি ৷ তাই পরপর দু'বারই ধাক্কা খেয়েছে তৃণমূল ৷
কোচবিহার লোকসভা-
এই জেলাটি কিন্তু বারবার খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে ৷ উত্তরের এই জেলার সঙ্গে বাংলাদেশের 549.45 কিমি দীর্ঘ আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে ৷ তাই অনুপ্রবেশ, চোরাচালান, পাচার এখানে দৈনন্দিন ঘটনা ৷ প্রধানত কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল হলেও এখানে শিল্প সেভাবে গড়ে ওঠেনি ৷ তাই জেলার বহু মানুষই ভিন রাজ্যে গিয়েছেন রুটি-রুজির সন্ধানে ৷
2019 সালে বিজেপির নিশীথ প্রামাণিক 7 লক্ষ 31 হাজার 594 ভোটে এখানে জয়ী হন ৷ তাঁর প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল 47.98 শতাংশ ৷ এদিকে তৃণমূল প্রার্থী পরেশচন্দ্র অধিকারী পেয়েছিলেন 6 লক্ষ 77 হাজার 363 ভোট ৷ সেবার 54 হাজার 231 ভোটে জয়ী হন বিজেপির নিশীথ ৷ এরপর 2021 সালের বিধানসভা নির্বাচনেও কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত 7টি বিধানসভার 6টিতেই জয়ী হয় বিজেপি ৷ একমাত্র সিতাই বিধানসভা কেন্দ্রে জয়ী হয় তৃণমূলের জগদীশ বর্মা বসুনিয়া ৷ এবার তিনিই কোচবিহার থেকে লোকসভা প্রার্থী হয়েছেন ৷ পরে দিনহাটা বিধানসভা কেন্দ্রটিতে উপনির্বাচন হয় এবং তার দখল নেন তৃণমূলের উদয়ন গুহ ৷ আসন্ন লোকসভা ভোটে তৃণমূলের প্রার্থী জগদীশ চন্দ্র বর্মা বসুনিয়ার সাথে টক্কর বিজেপির প্রার্থী নিশীথ প্রামাণিকের ৷
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উত্তরবঙ্গের কাজকর্মের সুবিধের জন্য সচিবালয় উত্তরকন্যা তৈরি করেছেন ৷ বারবার উত্তরবঙ্গ সফরে আসেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ এদিকে বিজেপির রাজ্য সম্পাদক দীপক বর্মন কটাক্ষ করে বলেন, "উত্তরবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেড়াতে আসেন ৷ তবে তাঁকে উত্তরবঙ্গের মানুষ ভোট দেবেন না ৷ উত্তরবঙ্গের জন্য মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী কিচ্ছু করেননি ৷ এখানে উত্তরকন্যা করেছেন, যেখানে কোনও দফতর বসে না ৷ কোনও মন্ত্রী কোনও দিন বসেন নি ৷"
আরও পড়ুন: