জলপাইগুড়ি, 25 ফেব্রুয়ারি: তোমার দেখা নাই রে, তোমার দেখা নাই...৷ আকাশের দিকে তাকিয়ে এখন এই গানই আওড়ে চলেছে উত্তরবঙ্গের চা বলয় ৷ ফার্স্ট ফ্লাশের চা পাতা তোলার সময় চা চাষিরা চাতক পাখির মতো বৃষ্টির অপেক্ষায় ৷ গত বছরও অনাবৃষ্টির কারণে 109 মিলিয়ন কেজি কম চা উৎপাদন হয়েছিল ৷ এবারও ফার্স্ট ফ্লাশের আগে বৃষ্টি নেই । ফলে মাথায় হাত চা চাষিদের ৷ আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় গতবারের মতো এবারও বিরাট ক্ষতির আশঙ্কা করছে উত্তরের চা বলয় ।
ভারতীয় চা পর্ষদের নির্দেশিকা অনুযায়ী, 30 নভেম্বর চা পাতা তোলা বন্ধ হয়ে যায় ৷ আবার ফেব্রুয়ারি মাসে চা পাতা তোলা শুরু হয়েছে ৷ তবে এই গোটা সময়টায় অর্থাৎ নভেম্বর মাস থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বৃষ্টির দেখা নেই ৷ ফলে ফার্স্ট ফ্লাশে তেমন পাতাও নেই ৷ কৃত্রিম সেচের মাধ্যমে যেটুকু পাতা এসেছে, তার গুণগত মানও একেবারেই ভালো নয় ৷ আবহাওয়ার এই খামখেয়ালিপনায় ঘুম ছুটেছে চা চাষিদের ৷
গত বছর ফার্স্ট ফ্লাশের আগে টানা সাত মাস ধরে পর্যাপ্ত বৃষ্টি না থাকার কারণে চা উৎপাদনে বিরাট ক্ষতির মুখে পড়েন চা মালিকরা । একে তো অনাবৃষ্টি, তার উপরে পোকামাকড়ের আক্রমণে উৎপাদনে ঘাটতি হয় । গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহের ফলে চা বাগানের পাতা ঝলসে যায় । চায়ের উৎপাদন 40% কমে গিয়েছিল ।
বিগত দিনে প্রতি বছর তরাই ডুয়ার্সে ডিসেম্বর মাসের 30 তারিখ পাতা তোলা বন্ধ হত । এ বছর চা পর্ষদের নির্দেশিকায় 30 নভেম্বর চা পাতা তোলা বন্ধ হয়েছে । 30 নভেম্বরের পরে চা চাগানের পরিচর্যার কাজ করা হয় । এ বছর চা পর্ষদের নির্দেশিকার ফলে ফেব্রুয়ারি মাসের 10 তারিখে চা পাতা তোলা শুরু হয় । যা কি না অন্যান্য বছরের তুলনায় একমাস আগেই শুরু হয় ৷ এবার চা পাতা তোলা হয়েছে শুখা মরসুমে ৷ বৃষ্টি না থাকার কারণে কৃত্রিম ভাবে জল সেচের ব্যবস্থা করা হয় চা বাগানে । তাতে চা পাতার গুণগত মান ও উৎপাদন ভালো হয়নি বলে এবারও ফার্স্ট ফ্লাশে ক্ষতির আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে । গত বছর মে মাসে সেকেন্ড ফ্লাশেও উৎপাদনে ঘাটতি ছিল । এবারও সেই আশঙ্কা রয়েছে ৷

গত বছর চায়ের উৎপাদন কম হওয়ায় চা শ্রমিকরা বোনাস কম পেয়েছেন । চায়ের উৎপাদনের উপর যেমন মালিকপক্ষের লাভ নির্ভর করে, তেমনই শ্রমিকদের পুজো বোনাসও নির্ভর করে । তরাই ডুয়ার্সের দুই শতাধিক চা বাগানে পুজো বোনাসের প্রায় 500 কোটি টাকা উত্তরের বাজারে লেনদেন হয় । ফলে এই সময়ে উত্তরের বাজার অর্থনৈতিক ভাবে চাঙ্গাও হয় । ফলে চা বাগানের উৎপাদনের উপর অনেক কিছুই নির্ভর করে ।
চা বাগান মালিক সংগঠন ইন্ডিয়ান টি প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ITPA) মুখ্য উপদেষ্টা অমৃতাংশ চক্রবর্তী বলেন, "বৃষ্টি না হওয়ার ফলে ফার্স্ট ফ্লাশের চা পাতার গুণগত মান ভালো হচ্ছে না । বৃষ্টি না হলে খুব বিপদ । কৃত্রিম ভাবে জল সেচ করে চা পাতার ভালো প্রোডাকশন পাওয়া সম্ভব নয় । ফলে এই মুহূর্তে বৃষ্টিপাত খুবই জরুরি । চা চাষ যেহেতু প্রকৃতি নির্ভর, ফলে আবহাওয়ার উপরে চায়ের গুণগত মান ও উৎপাদন নির্ভর করে । স্বাভাবিক ভাবেই বৃষ্টিপাত না হলে অঙ্কুরোদ্গম বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে । এমন চলতে থাকলে আশঙ্কা করছি ফার্স্ট ফ্লাশের উৎপাদন এবারও মার খাবে ৷ পাশাপাশি এর প্রতিফলনে সেকেন্ড ফ্লাশেও একটা ধাক্কা আসবে ।"
2023 সালের থেকে 2024 সালে বৃষ্টির অনুপাত অনেক কম হয়েছিল । 9-10 সেমি বৃষ্টি কম হওয়ায় চা পাতা যে পরিমাণ উৎপাদন হওয়ার কথা ছিল, তা ব্যাহত হয় । বৃষ্টি না হওয়ায় পোকামাকড়ের সংক্রমণ বেশি হয় । আর স্প্রে করে পোকামাকড় তাড়ানোও ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার ।

এদিকে, জলপাইগুড়ির চা চাষী সমিতির সম্পাদক বিজয় গোপাল চক্রবর্তী জানান, "গত কয়েক বছর থেকে আবহাওয়ায় খামখেয়ালিপনার জন্য চা পাতা উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে । এই বছর প্রায় সাড়ে সাত মাস বৃষ্টি নেই । বৃষ্টি না থাকার কারণে কৃত্রিম উপায়ে জল সেচ দিয়ে গাছকে বাঁচানো হয়েছে কিন্তু উৎপাদন আসেনি । ভারতে 2024 সালে 17 মিলিয়ন কেজি অর্থাৎ 22% চা উৎপাদন কম হয়েছে । উত্তরবঙ্গেই ক্ষুদ্র চা বাগানে চা উৎপাদনে বিরাট ক্ষতি হয়েছে । চা যেহেতু প্রকৃতি নির্ভর একটা শিল্প, সুতরাং বৃষ্টি না হলে উৎপাদন মার খাওয়ার সম্ভাবনা থাকে । এর ফলে ফার্স্ট ফ্লাশ ও মে মাসের সেকেন্ড ফ্লাশে ব্যাপক ক্ষতি হয় ।"
তিনি আরও বলেন, 2024 সালের মার্চ মাসে সারা ভারতে চায়ের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে । 2024 সালের মার্চ মাসে মোট চায়ের উৎপাদন হয় 62.52 মিলিয়ন কেজি, যা 2023 সালে ছিল 73.61 মিলিয়ন কেজি অর্থাৎ 17.09 মিলিয়ন কেজি কম উৎপাদন হয় । 2023 সালের তুলনায় মার্চে প্রায় 22 শতাংশ কম উৎপাদন হয়েছে ।
2024 সালের মার্চ মাসের উৎপাদনের মধ্যে ক্ষুদ্র চা বাগানগুলোর অবদান 34.25 মিলিয়ন কেজি ও বড় বাগানের অবদান 24.27 মিলিয়ন কেজি । পশ্চিমবঙ্গে 2024 সালে মোট চা উৎপাদন হয়েছে 24.05 মিলিয়ন কেজি । 2023 সালে যা ছিল 30 মিলিয়ন কেজি । প্রায় 6 মিলিয়ন কেজি চা কম উৎপাদন হয়েছে । চায়ের উৎপাদন কম হওয়ার পিছনে চা বিশেষজ্ঞরা মূলত আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তনকে দায়ী করেছেন । এছাড়া অনাবৃষ্টি, প্রখর রোদ, বৃষ্টিপাতের অভাবের সঙ্গে ব্যাপক পোকামাকড়ের উপস্থিতি উৎপাদন কম হওয়ার মূল কারণ ।
টি অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া (TAI)-র সম্পাদক সুমিত ঘোষ জানান, "এই মরশুমে অনেক ক্ষতি হতে পারে ৷ পাতা এখনও আসেনি । বৃষ্টি আসেনি । বৃষ্টি নেই কয়েক মাস ধরেই । একটা বৃষ্টি হলে ভালো । গত বছর প্রকৃতির খেলায় বিরাট ক্ষতি হয়েছিল । এই বছর সবাই খুব আশাবাদী । প্রকৃতির উপর নির্ভর করে আছে । সেচ বিদ্যুৎ অনেক ব্যয়সাপেক্ষ । এটার ফল ভালো হলে ভালো । ভালো দাম পাব ভেবেছিল । ফার্স্ট ফ্লাশে 2023 সাল পর্যন্ত দাম ছিল 220-225 টাকা কেজি । 2024 সালে সেই দাম কেজিতে 35-40 টাকা কমে যায় ভালো পাতা না পাওয়ার কারণে । নিলামে কেজিতে 80-85 টাকা (সেপ্টেম্বর 2024) কমে যায় দাম ৷"
টি অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া (TAI) সুত্রে জানা গিয়েছে, 2023 সালে উত্তরবঙ্গে চা উৎপাদন হয়েছিল 422.64 মিলিয়ন কেজি । যা গোটা দেশের চা উৎপাদনের 31%। 2023 সালে চায়ের উৎপাদন সবচেয়ে বেশি হয় উত্তরবঙ্গে । সেবার উৎপাদন 18% বাড়ে । 2009 সাল থেকে উত্তরবঙ্গে সেটাই ছিল 15 বছরের মধ্যে সর্বাধিক চায়ের উৎপাদন ।
2009 সালে চায়ের উৎপাদন ছিল 979 মিলিয়ন কেজি । সেখানে দেশজুড়ে 2023 সালে উৎপাদন গিয়ে দাঁড়ায় 1394 মিলিয়ন কেজিতে । 2024 সালে উত্তরবঙ্গে চা উৎপাদন হয় 373.48 মিলিয়ন কেজি । অপরদিকে, 2024 সালে দেশের চা উৎপাদন ছিল 1285 মিলিয়ন কেজি, যা 2023 সালের থেকে 109 মিলিয়ন কেজি কম । সে বছর উত্তরবঙ্গে চায়ের উৎপাদন হয় 373.48 মিলিয়ন কেজি ।
শিলিগুড়ি টি অকশন সেন্টারের প্রাক্তন চেয়ারম্যান তথা চা ব্যবসায়ী কমল তিওয়ারি বলেন, "প্রতি বছর আমরা ডিসেম্বর মাসে চা পাতা তোলা বন্ধ করি । তবে চা পর্ষদের নির্দেশে এবার নভেম্বর মাসে চা পাতা তোলা বন্ধ হয় । এবার বৃষ্টি না হলে আমরা মাঠে মারা পড়ে যাব । প্রোডাকশন ভালো হচ্ছে না । কৃত্রিম জলসেচ দিয়ে ভালো চা পাতা উৎপাদন আশা করা যায় না । ভালো পাতা না হওয়ায় কাঁচা পাতার দাম নেই । এখন চা পর্ষদের নির্দেশিকা মানতে গিয়ে আমরা বিপদে পড়ে গেলাম । ফার্স্ট ফ্লাশের এই অবস্থা, সেকেন্ড ফ্লাশে কী হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না ।"