কলকাতা, 20 সেপ্টেম্বর: রাজ্যজুড়ে ভয়ঙ্কর হচ্ছে বন্যা পরিস্থিতি ৷ বৃষ্টি কমে গেলেও বিভিন্ন জেলা এখনও জলের তলায় ৷ কোথাও ঘর বাড়ি তলিয়ে যাচ্ছে আবার কোথাও জলে ভেসে যাচ্ছে মানুষ ৷ রাজ্যের কোন জেলায় কী পরিস্থিতি দেখুন একনজরে :
নদিয়া : ফুঁসছে ভাগীরথী ৷ জলস্তর বেড়ে যাওয়ায় পূর্ব বর্ধমান এবং নদিয়ার একমাত্র সংযোগকারী ফেরিঘাট বন্ধ করেদিল পূর্ব বর্ধমান জেলা প্রশাসন । অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হল ফেরি ও ভেসেল চলাচল ৷ বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই জল বাড়ার পরেও ঝুঁকি নিয়ে পারাপার চলছিল নদিয়ার শান্তিপুর নৃসিংহপুর ফেরিঘাটে । সেদিন রাত থেকে ফেরিঘাট-সহ পার্শবর্তী বাসস্ট্যান্ড-সহ গোটা এলাকায় ঢুকে পড়ে জল । জলের তলায় চলে যায় নৃসিংহপুর ফেরিঘাট ৷ এই ফেরিঘাটের উপর নির্ভর নদিয়ার 3টি রুটের বাস পরিষেবা-সহ টোটো এবং অটো চলাচল । জল বাড়ার কারণে ফেরিঘাট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সমস্যা বেড়েছে ৷ যেভাবে জল বেড়েছে তাতে নদী তীরবর্তী মানুষজন দিশেহারা হয়ে ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন ৷ 2000 সালের বন্যার কথা ভেবে আতঙ্কে রয়েছেন তাঁরা ৷
ঘাটাল : প্লাবিত ঘাটালে নৌকায় চেপে ত্রাণ সামগ্রী বিলি করলেন জেলাশাসক ৷ বন্যা কবলিত মানুষদের হাতে ত্রিপল, শুকনো খাবার ও ওষুধ-সহ যাবতীয় জিনিস তুলে দে খুরশিদ আলী কাদরী বন্যার্ত মানুষদের ত্রিপল,শুকনো খাবার,ওষুধ সহ যাবতীয় কিট তুলে দেন জেলাশাসক খুরশিদ আলি কাদরি । এছাড়াও তাঁর সঙ্গে ছিলেন পিএইচ দফতরের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি সুরেন্দ্র গুপ্তা,ঘাটালের মহকুমাশাসক সুমন বিশ্বাস-সহ প্রশাসনের বিভিন্ন আধিকারিকরা । ঘাটালের একাধিক এলাকা বন্যার জলে ডুবে রয়েছে এখনও ৷ পাকাবাড়ির একতলা ছাদের উপর ত্রিপল টাঙিয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে চলছে বসবাস । ইলেকট্রিক না থাকার কারণে দেখা দিয়েছে পানীয় জলের চরম সংকট ৷ নৌকা ও ডিঙি চড়ে দূর থেকে জল আনতে হচ্ছে । ঘাটালের রথীপুর এলাকায় কয়েকদিন ধরে বন্যার জলে ডুবে থাকা ঘাটাল-চন্দ্রকোনা রাজ্য সড়কের ধীরগতিতে যান চলাচল চালু হলেও এখনও জলমগ্ন রয়েছে রাজ্য সড়ক ৷ তার উপর দিয়েই চলছে ঝুঁকির যাতায়াত ।
বাঁকুড়া : এদিকে বন্যা কবলিত এলাকায় ত্রাণ পৌঁছে দিতে বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাঁশকুড়া রওনা দিলেন আন্দোলনকারী জুনিয়র চিকিৎসকরা ৷ ত্রাণ দেওয়ার পাশাপাশি তাঁরা চিকিৎসা পরিষেবাও দেবেন ৷ নিজেদের উদ্যোগেই চাল, ডাল, আলু, মুসুর ডাল, সয়াবিন, চিঁড়ে, চিনি, ভোজ্য তেল ছাড়াও জুনিয়ার চিকিৎসকরা নিজেদের সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন পর্যাপ্ত ওষুধ ।
জিরাট : বলাগড়ে কালভার্ট ভেঙে গঙ্গার জলে প্লাবিত জিরাটের চর খয়রামারি । একাধিক বাড়ি জলমগ্ন হওয়ায় সেখান থেকে 60 জনকে অন্যত্র সরায় প্রশাসন । অতিবৃষ্টি ও ডিভিসির ছাড়া জলে প্লাবিত বলাগড়ের একাধিক এলাকা । বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন সদর মহকুমাশাসক স্মিতা সান্যাল শুক্লা ও বলাগড়ের বিডিও সুপর্ণা বিশ্বাস । কালভার্টের জায়গায় নতুন কাঠের সেতু নির্মাণ করা হবে বলেও আশ্বাস দেন মহকুমাশাসক । প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে । চরখয়রামারি থেকে জিরাট সংযোগকারী একমাত্র কালভার্টটি ভেঙে যাওয়ায় যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে যায় গ্রাম । জল ঢুকতে শুরু করে গ্রামে । ওই এলাকায় প্রায় আড়াইশোটি পরিবারের বসবাস । তাদের মধ্যে 60 জনকে স্থানীয় আশুতোষ নগর প্রাইমারি বিদ্যালয়ে অস্থায়ী ত্রাণ শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে । এছাড়াও জল ঢুকতে শুরু করেছে বলাগড়ের শ্রীপুরের বাবুচর, সিজা কামালপুর পঞ্চায়েতের বানেশ্বরপুর,আশ্রম ঘাট সহ বেশ কয়েকটি এলাকা জলমগ্ন । বলাগড়ের অধিকাংশ এলাকার সবজি চাষের উপর নির্ভর । বর্তমানে অধিকাংশ কৃষি জমি জলের তলায় চলে যাওয়ায় ফসল নষ্টের আশঙ্কা করছেন চাষিরা ।
জিরাট পঞ্চায়েতের ভারপ্রাপ্ত প্রধান অশোক পোদ্দার জানান, ওখানের 5 নম্বর কালভার্টটি ভেঙে যাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় । বিডিও ও জেলা প্রশাসনকে জানানো হয়েছে । জরুরি ভিত্তিতে মেরামতির কাজ চলছে । ওই এলাকায় নৌকা পরিষেবা চালু করার চেষ্টা করছি । আপাতত কাঠের তৈরি হচ্ছে পরবর্তীকালে পাকাপাকি কালভার্ট করা হবে । আমাদের ত্রাণ শিবির করা হয়েছে । পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে । এদিকে জিরাটের ভাঙা কালভার্ট পরিদর্শন করে পুলিশ । এই বিষয়ে হুগলি গ্রামীণ পুলিশের ডিএসপি (ক্রাইম) অভিজিৎ সিনহা মহাপাত্র জিরাট গ্রাম পঞ্চায়েতের চর খয়রামারিতে গিয়ে গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলেন । এরপর বন্যা কবলিতদের জন্য যে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে সেখানে গিয়ে দুর্গতদের সঙ্গে কথা বলেন । সবরকম সাহায্যের জন্য তারা প্রস্তুত রয়েছেন বলে জানান ডিএসপি ।
খানাকুল : খানাকুলে বন্যার প্লাবনে ভেসে গেল বাড়ি । ঘরছাড়া বহু মানুষ । মৃত্যু হয়েছে তিনজনের । পুলিশের দাবি মদ্যপ অবস্থায় থাকার জেরে জলে ভেসে মৃত্যু হয়েছে সুশান্ত মাইতি (50) নামক ব্যক্তির । অন্যদিকে, তাঁতিশোলে এক নাবালক জলে নেমে তলিয়ে যায় । পরে মৃতদেহ পাওয়া যায় । মৃতের নাম শেখ ফিরদৌস। এখানেই প্রাণ যায় আরও একজনের। আরামবাগের খানাকুল ও পুড়শুরা-সহ একাধিক ব্লক । তার উপর ঝাড়খণ্ড থেকে জল ছাড়াও বিপজ্জনক পরিস্থিতি নেয় একাধিক ব্লক । জলের তোড়ে দ্বারকেশ্বর মুণ্ডেশ্বরী দামোদর নদীবাঁধ ভাঙতে থাকে । এতেই জলের চাপে খানকুলের তালিত গ্রামের একটি পাকা বাড়ি ভেসে যায় । জলের চাপ বেশি থাকায় একাধিক মাটির বাড়ির ও এই পরিস্থিতি হয় । স্থানীয় মানুষ বাড়ি ছেড়ে ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিতে থাকেন । বর্তমানে 2 লক্ষ মানুষ জলমগ্ন অবস্থায় রয়েছেন । খানাকুলের 1 ও 2 নম্বর ব্লকে 50টি ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছে ।
ডিভিসির ছাড়া জলে প্লাবিত হয়েছে খানাকুল, গো-ঘাট,পুড়শুড়া-সহ বিভিন্ন এলাকা । শুক্রবার সকাল থেকে নতুন করে জল না বাড়লেও খানাকুল ও পুড়শুরার অবস্থা খুবই বিপজ্জনক । আরামবাগ দক্ষিণ নারায়ণপুর হাসপাতালে ভিতরেও বন্যার জল ঢুকেছে । একাধিক মাটির বাড়ি ভেঙে গিয়েছে । একাধিক জায়গায় বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে । পানীয় জলের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে । খানাকুল এক ও দুই নম্বর ব্লকে বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের কর্মীরা জলবন্দি মানুষদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছেন । একাধিক স্পিডবোট ও নৌকা নামানো হয়েছে এলাকায় । বন্ধ রয়েছে দোকানপাট ।
এই বিষয়ে হুগলি জেলা পরিষদের সভাধিপতি রঞ্জন ধারা জানান, খানাকুলের এক ও দুই ব্লক মিলিয়ে 24টি পঞ্চায়েত, পুড়শুরার 8টি ও গোঘাটের চারটে পঞ্চায়েত এলাকা জলমগ্ন অবস্থা । বর্তমানে পরিস্থিতি অনেকটা স্থিতিশীল । বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের কর্মীরা মানুষকে খাবার পৌঁছে দিচ্ছে । আড়াই হাজার মানুষকে ত্রাণ শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে । শুকনো খাবার ও রান্না করা খাবার তাদের দেওয়া হচ্ছে । বন্যাদুর্গতদের জন্য প্যাকেট বন্দি জল দেওয়া হচ্ছে ।
পূর্ব বর্ধমান : কাটোয়ার ভাগীরথী নদীতে জলস্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করা হল কাটোয়া বল্লভপাড়া, দাঁইহাট ও কালনার নৃসিংহপুর-সহ অন্যান্য ফেরিঘাট । হঠাৎ করে ফেরিঘাট বন্ধের ফলে দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরা ৷ বৃহস্পতিবার রাত এগারোটা থেকে এই ঘাট বন্ধ রাখার নোটিশ দেওয়া হয় । হঠাৎ করে নৌকা চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সমস্যায় পড়েছেন যাত্রীরা । প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, বৃষ্টির পাশাপাশি ও ডিভিসি থেকে লাগাতার জল ছাড়ায় কাটোয়ার ভাগীরথী নদীতে জলস্তর বৃদ্ধি পায় । বিপদের আশংকা থাকায় বৃহস্পতিবার রাত থেকেই খেয়া পারাপার বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয় । শুক্রবার কাটোয়া থেকে নদিয়া ফিরছিলেন ময়না দাস । ছোট্ট নাতনিকে নিয়ে ঘাটে এসে দেখেন খেয়া পারাপার বন্ধ ৷ তাঁর কথায়, "নদিয়ার জয়রামপুর থেকে গতকাল কাটোয়া এসেছিলাম । আজ ফিরে যাওয়ার কথা । ঘাটে এসে দেখি ঘাট বন্ধ । কখন থেকে চালু হবে সেটাও জানি না । তাই আবার কাটোয়াতেই ফিরে যাচ্ছি ।" আরেক যাত্রী মনোরুদ্দিন মল্লিক বলেন, "গঙ্গার জল খুব বেড়ে গিয়েছে । মুর্শিদাবাদের পলাশী যাব । ফেরিঘাট বন্ধ থাকায় যেতে পারব না । কারণ ঘুরপথে যেতে অনেক সময় লাগে । তাই আজকে যেতে পারব না ।"
কাটোয়া বল্লভপুর ঘাটের ইজারাদার সোমনাথ ঘোষ বলেন, "প্রশাসনের তরফে গতকাল রাত এগারোটা নাগাদ ফেরিঘাট বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় । আজ শুক্রবার সারাদিন ফেরিঘাট বন্ধ আছে । তবে কতক্ষণ বন্ধ রাখতে হবে সেটা জানানো হয়নি । সকাল থেকেই নদী পারাপার করার জন্য মানুষ ফেরিঘাটে ভিড় জমিয়েছে । তাদেরকে বুঝিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে ।"