জাড়া (পশ্চিম মেদিনীপুর), 21 সেপ্টেম্বর: শুরু পুজোর মরশুম। বিভিন্ন সর্বজনীন ক্লাবের দুর্গাপুজোর পাশাপাশি বনেদি ও জমিদার বাড়ির পুজোর প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গিয়েছে। এইরকমই এক প্রাচীন পুজো হল পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল মহকুমার চন্দ্রকোনা 1 নম্বর ব্লকের জাড়া গ্রামের জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজো। এবছর 225তম বছরে পড়তে চলেছে জাড়ার রায় বাড়ির পুজো, তাই চলছে প্রস্তুতি । তবে, 225 বছরের ঐতিহ্যবাহী জাড়ার জমিদার বাড়ির পুজোর জৌলুস আজও অমলীন ৷
রায় বাড়িতে মনীষীদের আনাগোনা-
- একসময় রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও মহানায়ক উত্তমকুমারের স্মৃতি বিজড়িত ছিল এই জাড়ার জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজো। বাড়ির সদস্যদের কথামতো রাজা রামমোহন রায়ের বন্ধু ছিলেন জমিদার রাজীবলোচন রায়। তাই জাড়া গ্রামে যাতায়াত ছিল রাজা রামমোহন রায়ের। তেমনই জাড়া জমিদার বাড়ির সঙ্গে সখ্য ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের। জমিদার পরিবারের আমন্ত্রণে জাড়া স্কুলের স্থাপনা করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এও নাকি শোনা যায়, জমিদার পরিবারের ডাকে এই বাড়িতে বেশ কয়েকবার এসেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
বাংলার ম্যাটিনি আইডল উত্তমকুমারও এসেছিলেন রায় বাড়িতে -
- মহানায়ক উত্তমকুমারের সিনেমা 'অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি' ছবির একটি দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল এখানে। সেটি 'অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি' ছবির একটি গানের দৃশ্য। সেই গানটি হল, "কেমন করে বললি জগা জাড়ার গোলক বৃন্দাবন, যেখানে বামুন রাজা চাষি প্রজা, চারিদিকে তার বাঁশের বন।" প্রাচীন পুজো হিসেবে কথিত এই পুজোর সময় এই বাড়িতে কবি গানের আসর বসত। বিখ্যাত কবিয়াল ভোলা ময়রা এই গান বেঁধে ছিলেন যা 'অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি' ছবিতেও তুলে ধরা হয়। এমনই স্মৃতি বিজড়িত জাড়া জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজোও হত মহাসমারোহে।
রায় বাড়ির অভ্যত্থান-
- জমিদার বাড়িতে দুর্গাপুজোর পাশাপাশি কালী, বিষ্ণুদেবতা, শিব-সহ একাধিক দেবদেবীর মূর্তি ও মন্দির রয়েছে ৷ এখনও তিন বেলা ভোগ চড়িয়ে নিত্যসেবা করা হয়। 1155 বঙ্গাব্দে (1748 খ্রীস্টাব্দ) জাড়া জমিদার বাড়ির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাম গোপাল রায়। পরবর্তী সময়ে তাঁর ছেলে রাজা রাজীবলোচন রায় বর্ধমান রাজার থেকে 'রাজা' উপাধি পেয়েছিলেন। তারপর থেকে জমিদারি আরও বিস্তার লাভ করে এবং তিনিই জমিদার বাড়িতে দুর্গাপুজোর সূচনা করেছিলেন।
জমিদার বাড়ির তৎকালীন সময়ের পুজো-
- রুপোর পালকিতে করে গ্রামের একটি পুকুরে শোভাযাত্রা করে নবপত্রিকা স্নান করিয়ে পুজোর সূচনা হয়। এই প্রাচীন পুজোতে তৎকালীন সময়ে পুজোতে বহু মনীষী আমন্ত্রিত হিসাবে আসতেন। পুজোর ট্রাডিশন ছিল কবি গানের আসর, যাত্রাপালা। এই পাশাপাশি লঙ্গর খানা চলত পুজোর 6-7 দিন। প্রায় 10-15টি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ মানুষ ভিড় জমাতেন পুজোয়, চলত নরনারায়ণ সেবা।
বর্তমান রায় বাড়ির পুজো-
- বর্তমানে জমিদারিত্ব নেই তবে রয়ে গিয়েছে জমিদার বাড়ির বিশাল প্রাসাদ, যা এখন ভগ্নপ্রায় আগাছায় ঢাকা। কমে গিয়েছে জমিদার বাড়ির পুজোর জৌলুস। বর্তমানে জমিদার বাড়ির 21টি পরিবার এখনও বসবাস করেন এখানেই ৷ কিন্তু তাঁদের অধিকাংশই এখন কর্মসূত্রে ভিন রাজ্য বা ভিন দেশে। তবে পুজোর সময় অনেকেই হাজির হন বাড়ির এই দুর্গাপুজোয়। এবছর জাড়া জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজো 225তম বর্ষে পদার্পণ করতে চলেছে । পুজোয় আগের মতো জৌলুস না-থাকলেও সমস্ত রীতিনীতি মেনেই পুজোর আয়োজন হয়ে থাকে। এই জমিদার বাড়িতে দুর্গাপুজোয় কোনও বলি হয় না। নবপত্রিকা স্নানে শোভাযাত্রা বেরোয় ৷ বিসর্জন হয় গ্রামের পুকুরে ৷"
পুজোর আর বেশি দেরি নেই ৷ তাই জাড়া জমিদার বাড়িতে প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গিয়েছে জোরকদমে। বংশপরম্পরায় একই ধরনের প্রতিমা তৈরি হয়ে আসছে ৷ তাতে দেখা যায় দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশকে।