ব্যারাকপুর, 18 অক্টোবর: আরজি কর কাণ্ডে তোলপাড় রাজ্য ৷ এই আবহে এবার 23 বছর আগে অর্থাৎ বাম আমলে আরজি কর হাসপাতালেই আরও এক চিকিৎসক পড়ুয়ার রহস্যমৃত্যুর সুবিচারের দাবি তুললেন তাঁর পরিবার । নিহত চিকিৎসক সৌমিত্র বিশ্বাসের পরিবার ঘটনার পুনঃতদন্ত চেয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃষ্টি আকর্ষণও করেছেন ।
পরিবার বলতে এখন শুধু বেঁচে রয়েছেন তাঁর একমাত্র ছোট ভাই । মা-বাবা মারা গিয়েছেন বেশ কয়েক বছর আগেই । বেঁচে থাকাকালীন প্রশাসনের দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়িয়েছেন সৌমিত্র'র মা সবিতা বিশ্বাস । তবুও ছেলের মৃত্যুর ন্যায়বিচার পাননি । অভিযোগ, সেই শোকে মৃত্যু হয়েছে তাঁর । সেই আক্ষেপ এখনও বয়ে চলেছেন সৌমিত্রর ভাই শান্তনু বিশ্বাস ৷ তাই দাদার মৃত্যুর বিচার চেয়ে এখন গলা ফাটাচ্ছেন তিনিও ! চাইছেন ধুলো পড়ে যাওয়া দাদার রহস্য মৃত্যুর ঘটনার ফাইল পুনরায় খুলে সত্য ঘটনা সামনে আনুক তৃণমূল সরকার ।
ঠিক কী ঘটেছিল ?
দিনটা ছিল 2001 সালের 25 অগস্ট । আর পাঁচটা দিনের মতোই সেদিন ব্যারাকপুরের জয় হিন্দ পল্লীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিলেন আরজি কর মেডিক্যালের চতুর্থ বর্ষের চিকিৎসক পড়ুয়া সৌমিত্র বিশ্বাস । সেই সময় তাঁর ছোট ভাই শান্তনুর বয়স ছিল মাত্র সতেরো । অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও বিশ্বাস পরিবার তাকিয়ে ছিল চিকিৎসক ছেলের বাড়িতে ফিরে আসার অপেক্ষায় । কিন্তু ছেলে ফিরে আসেননি । পরিবর্তে ছেলের মৃত্যুর খবর এসেছিল আরজি কর হাসপাতালের হস্টেল থেকে ।
নিহত তরুণী চিকিৎসক পড়ুয়ার পরিবারের মতো সেদিনও সৌমিত্রর পরিবারের কাছে গিয়েছিল কর্তৃপক্ষের ফোন । বলা হয়েছিল, সৌমিত্র ললিত মেমোরিয়াল হস্টেলে সাইড ব্যাগের ফিতে দিয়ে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন । সেই খবর পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে সেদিন ছুটে গিয়ে ছেলের নিথর দেহ দেখতে হয়েছিল তাঁর মাকে ।
পরিবারের দাবি, "আত্মহত্যা নয় ! সৌমিত্রকে খুন করা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে ।" বেশকিছু কারণও তুলে ধরেছিলেন তাঁরা । ছেলের শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখে সেই সময় আত্মহত্যার তত্ত্ব মানতে চাননি সৌমিত্রর পরিবার । তাঁরা হাসপাতালে তৎকালীন বাম ছাত্র সংগঠন এসএফআই নেতৃত্বের একাংশের দিকে আঙুল তুলে চক্রান্তের অভিযোগ করেন । তাঁদের অভিযোগ, তাঁদের সঙ্গে চতুর্থ বর্ষের ওই চিকিৎসক পড়ুয়ার দ্বন্দ্ব চলছিল বেশ কিছুদিন ধরে ৷
এরপর ছেলের মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করতে সমস্ত শক্তি কাজে লাগান সৌমিত্রর পরিবার ৷ সিআইডি তদন্তে হলেও তা নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না তাঁরা ৷ সিবিআই তদন্তের দাবি করেছিলেন । কিন্তু তা আর হয়নি । ছেলের মৃত্যুর সত্যতা যাচাই করতে তৎকালীন বাম সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে বারবার দেখা করার চেষ্টাও করেন সবিতা বিশ্বাস ৷ কিন্তু সাক্ষাৎ পাননি তাঁর ।
এরপর 23 বছর কেটে গিয়েছে । চিকিৎসক পড়ুয়া সৌমিত্রর রহস্য মৃত্যুর তদন্তও একসময় বন্ধ হয়ে যায় । এখন আরজি করে চিকিৎসক তরুণীর ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় যখন তোলপাড় হচ্ছে দেশ-বিদেশ । এই সময় 23 বছর আগে দাদার মৃত্যুর ঘটনা বারবার মনে পড়ছে সৌমিত্রর ভাইয়ের ৷ তিনিও বলছেন, "উই ওয়ান্ট জাস্টিস । উই ডিমান্ড জাস্টিস ।" আরজি করে এই চিকিৎসক পড়ুয়ার মৃত্যুর তদন্তও চলুক সমানতালে ।
তাঁর কথায়, "23 বছর আগের এই ঘটনার যদি সঠিক তদন্ত হতো, তাহলে আজ এই পরিণতি হতো না ৷ সেদিন ঠিক কী ঘটনা ঘটেছিল ! কারা, কীভাবে এই ঘটনা ঘটালো ? কেনই বা ঘটলো ? কারা যুক্ত এর সঙ্গে ? সেই সব নিয়ে অন্ধকারে রয়েছি আমরা । তাই সত্য ঘটনা সামনে আনতে যা যা করার প্রয়োজন তা সবই করব । মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন, দাদার মৃত্যুর ফাইল পুনরায় খুলে নতুন করে তা তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হোক । এই বিষয়ে ব্যারাকপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন ।"
রাজনৈতিক তরজা:
এদিকে, 23 বছর আগে বাম আমলে ঘটে যাওয়া আরজি করের এই ঘটনাকে হাতিয়ার করে রাজনীতির ময়দানে নেমে পড়েছে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস । দেরি না করে বৃহস্পতিবার রাতেই নিহত সৌমিত্রর ব্যারাকপুরের বাড়িতে পৌঁছে যান স্থানীয় পৌরসভার চেয়ারম্যান উত্তম দাস, তৃণমূল কাউন্সিলর জয়দেব দাস-সহ শাসক শিবিরের অন্যান্য নেতৃত্ব । সৌমিত্রর ভাই শান্তনু বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করে পাশে থাকার বার্তা দেন তাঁরা ।
চেয়ারম্যান উত্তম দাস বলেন, "বাম আমলে ওই চিকিৎসকের মৃত্যুর সঠিক তদন্ত হয়নি ৷ সিআইডি-র তদন্ত রিপোর্ট ঠিক কী অবস্থায় রয়েছে, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন রয়েছে । এই বিষয়ে প্রয়োজনে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবো আমরা ।"
তিনি আরও বলেন, "মৃত চিকিৎসকের মৃত্যুর জন্য যাঁরা সেদিন দায়ী ছিল, আজ তাঁরাই আরজি করে নির্যাতিতা তরুণী চিকিৎসকের মৃত্যুর আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন । ওঁরা বলছে, 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস' ! আমরাও বলছি, 'উই ডিমান্ড জাস্টিস'। ফোনে সৌমিত্রর ভাইকে হুমকি দেওয়া হয়েছে । এসব হুমকি শুনব না আমরা । কোনও সমস্যা নেই । সবসময় আমরা তাঁর পাশে রয়েছি ৷"
যদিও, এখনও কোনও হুমকি ফোন পাননি বলে দাবি করেছেন নিহত চিকিৎসকের ভাই শান্তনু । অন্যদিকে, 23 বছর আগের এই মৃত্যুর ঘটনা সামনে এনে আদতে তৃণমূল নেতৃত্ব আরজি করে নির্যাতিত চিকিৎসক তরুণীর ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা অন্য দিকে ঘোরাতে চাইছে বলে অভিযোগ সিপিএমের উত্তর 24 পরগনা জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য আহমেদ আলি খানের ।