ETV Bharat / state

রঙ্গোলি-কোলামের থেকে ভিন্ন, প্রকৃতি ও ঋতু বৈচিত্র্যের কথা বলে 'শান্তিনিকেতনী আলপনা' - Shantiniketani Alpana

author img

By ETV Bharat Bangla Team

Published : Sep 4, 2024, 8:58 PM IST

Rabindranath Tagore's 'Shantiniketani Alpana': বৈদিক যুগ থেকে ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আলপনা ৷ যা একটা সময় ভারতের বাইরে বিদেশেও প্রচলিত ছিল ৷ বর্তমানে এর চল শুধুমাত্র ভারত ও বাংলাদেশে রয়েছে ৷ তবে, ভারতে প্রচলিত রঙ্গোলি, কোলাম ও ব্রত আলপনার বাইরে, আরেক ধরনের আলপনার চল রয়েছে ৷ তা হল, শান্তিনিকেতনী আলপনা ৷ যার সূচনা হয়েছিল, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 50 বছরের জন্মদিনে ৷

Rabindranath Tagore's 'Shantiniketani Alpana'
প্রকৃতি ও ঋতু বৈচিত্র্যের কথা বলে 'শান্তিনিকেতনী আলপনা' ৷ (নিজস্ব চিত্র)

বোলপুর, 4 সেপ্টেম্বর: বৈদিক যুগ থেকে আলপনার প্রচলন ভারতীয় সংস্কৃতিতে ৷ তবে 'শান্তিনিকেতনী আলপনা'র একটা নিজস্ব ঘরানা রয়েছে ৷ যা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, শিল্পী অসিত হালদারের হাত ধরে প্রচার ও প্রসারিত হয়েছে ৷ বর্তমানে শান্তিনিকেতনে এই আলপনা শিল্পের ধারা বহন করে চলেছেন শিল্পী তথা অধ্যাপক সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায় ৷ 'শান্তিনিকেতনী আলপনা' নিয়ে আমেরিকায় কর্মশালাও করেছেন তিনি ৷ বর্তমানে অনলাইনে তাঁর কাছে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও সুইডেন থেকে পড়ুয়ারা ক্লাস করেন ৷ এবার ইটিভি ভারতকে তিনি জানালেন, উত্তর ভারতের রঙ্গোলি আর দক্ষিণ ভারতের কোলামের থেকে গ্রাম বাংলার ব্রত আলপনা ও শান্তিনিকেতনী আলপনা শিল্পের তারতম্যের কথা ৷

প্রকৃতি ও ঋতু বৈচিত্র্যের কথা বলে 'শান্তিনিকেতনী আলপনা' ৷ (ইটিভি ভারত)

হুগলি জেলার চন্দননগরের বাসিন্দা সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায় ৷ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিত্রকলা নিয়ে স্নাতক উত্তীর্ণ হন ৷ পরে জাতীয় বৃত্তি নিয়ে বিশ্বভারতীর কলাভবনে পড়াশোনা করেন ৷ ফের রবীন্দ্রভারতী থেকে স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হন ৷ তারপর 1983 সালে বিশ্বভারতীর উত্তরশিক্ষা সদনে অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন ৷ চিত্রকলার এই ছাত্রকে 'শান্তিনিকেতনী আলপনা' আকৃষ্ট করেছিল ৷ তারপর থেকে এই শিল্প নিয়ে নিরলস চর্চা শুরু করেন তিনি ৷ শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আজও তাঁর ও তাঁর ছাত্রছাত্রীদের দেওয়া আলপনাই শোভা পায় ৷

শান্তিনিকেতনের সুধীরঞ্জনদা মানেই আলপনা বিশেষজ্ঞ, এমনটাই পরিচিতি তাঁর ৷ 2017 সালে শান্তিনিকেতনী আলপনা শিল্প নিয়ে আমেরিকার নিউজার্সিতে টেগোর ফেস্টিভ্যালে কর্মশালাও করেছেন তিনি ৷ পরবর্তীতে 2022 সালে আমেরিকার লাস ভেগাসে কর্মশালা করেন ৷ এছাড়া, কলকাতা, মুম্বই, দিল্লি, দক্ষিণ ভারতের একাধিক রাজ্যে 'শান্তিনিকেতনী আলপনা' শিল্প নিয়ে কর্মশালা করেছেন ৷

বর্তমানে দেশের বিভিন্ন রাজ্য-সহ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন, ইংল্যান্ড থেকে শিক্ষার্থীরা অনলাইনে তাঁর কাছ থেকে আলপনা শেখেন ৷ অর্থাৎ, বর্তমানে 'শান্তিনিকেতনী আলপনা'র যে ঐতিহ্য, তার ধারক ও বাহক সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায় ৷ শান্তিনিকেতনের বাড়িতে বসে ইটিভি ভারতকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানালেন, আলপনা শিল্প কী, উত্তর ভারতের রঙ্গোলি ও দক্ষিণ ভারতের কোলামের থেকে গ্রাম বাংলার ব্রত আলপনা ও শান্তিনিকেতনী আলপনার ভিন্নতা কোথায় ?

আলপনার ইতিহাস কী?

আলপনা একটি নান্দনিক ঐতিহ্যবাহী শিল্প ৷ যা স্থায়ী শিল্প নয় ৷ দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া মহাদেশেও আলপনা শিল্পের চল ছিল ৷ তবে, এই শিল্পকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছে বা শিল্পের ধারা বহন করছে ভারতবর্ষ ৷ বৈদিক যুগ থেকেই বিভিন্ন মঙ্গল অনুষ্ঠান, যাগযজ্ঞে আলপনা দেওয়ার রীতি বিদ্যমান ৷ বর্তমানেও গ্রাম-বাংলা-সহ বাংলাদেশেও একইভাবে প্রচলন আছে আলপনার ৷ তবে, এগুলি সবই ধর্মীয় রীতি বা মঙ্গল অনুষ্ঠানের জন্য ৷ যাকে বলা হয় ব্রত আলপনা ৷

'শান্তিনিকেতনী আলপনা' কী ? কীভাবে এর প্রচলন ?

শাস্ত্রজ্ঞানী ছিলেন পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন (নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের দাদামশাই) ৷ বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো সমান অবদান ছিল তাঁর ৷ তিনিই বৈদিক যুগের মতো শান্তিনিকেতনে আলপনার প্রচলন করেছিলেন ৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 50 বছরের জন্মদিন পালনের সময় একবার এবং নন্দলাল বসুকে সম্মান দিতে শান্তিনিকেতন জুড়ে আলপনা দেওয়া হয়েছিল ৷

পরবর্তীতে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের শিলাইদহতে গিয়ে, তাঁদের দেওয়া আলপনা চোখে পড়েছিল কবিগুরুর ৷ তিনি একটি কাগজে আলতা দিয়ে আলপনা আঁকিয়ে এনেছিলেন ৷ সেটি ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দিয়ে গবেষণা করতে বলেছিলেন ৷ আলপনা নিয়ে গবেষণা করে 'বাংলার ব্রত' গ্রন্থটি লিখেছিলেন শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৷ এমনকি, শিল্পী নন্দলাল বসুরও ঝোঁক ছিল আলপনা শিল্পের প্রতি ৷ তিনি এই শিল্পকে সমৃদ্ধ করতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন ৷ এছাড়া, শিল্পী অসিত হালদারের অবদানও অবিস্মরণীয় ৷ এভাবেই শান্তিনিকেতনে আলপনা শিল্প সমৃদ্ধ হতে থাকে ৷

গ্রামবাংলার আলপনা ও শান্তিনিকেতনী আলপনার ফারাক কোথায় ? রঙ্গোলি ও কোলাম কি এক ?

গ্রাম বাংলার ব্রত আলপনায় অবশ্যই শিল্প রয়েছে ৷ তবে, তা ধর্মীয় গত ৷ কলমিলতা, শঙ্খলতা, খুন্তিলতা প্রভৃতির ব্যবহার হচ্ছে ৷ অর্থাৎ, একই রীতি বা ধারা অনুযায়ী চলে আসছে ৷ আর 'শান্তিনিকেতনী আলপনা' অনেক বেশি নান্দনিক ও সমৃদ্ধ ৷ এখানে ছয় ঋতুর বর্ণনা, গাছের পাতা, লতা, মেঘের প্রকারভেদ, প্রকৃতির বর্ণনা প্রভৃতি তুলে ধরা হয় ৷ আর 'শান্তিনিকেতনী আলপনা' প্রতি মুহূর্তে ভিন্ন ভিন্ন শিল্পের ছোঁয়া পায় ৷ এক একজন শিল্পী এক একরকমভাবে নিজের শিল্প মাধুর্য যুক্ত করে থাকেন ৷ এটাই পার্থক্য ৷

উত্তর ভারতের রঙ্গোলি হল রংয়ের খেলা বা রঙের শিল্প ৷ এখানে বিভিন্ন রং দিয়ে নকশা তৈরি করা হয় ৷ যা দৃশ্যমান রঙিন সৌন্দর্য ৷ আর দক্ষিণ ভারতের কোলাম হল চালগুঁড়ো, আটা, খড়িমাটি বা রঙ ব্যবহার করে সাজিয়ে তোলা হয় ৷ চৌক চৌক ছক কেটে এগুলি একই ধারায় চলে আসছে ৷

রঙ্গোলি আর কোলামের থেকে শান্তিনিকেতনী আলপনার ভিন্নতা হল, শান্তিনিকেতনে আলপনার কোন রীতি নেই ৷ প্রতি মুহূর্তে শিল্প সমৃদ্ধ হচ্ছে ৷ কোনও নির্দিষ্ট ধারা ছাড়াই প্রকৃতিকে আলপনায় ফুটিয়ে তোলা হয় এখানে ৷

শিল্পী সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায় বলেন, "শান্তিনিকেতনে যখন প্রথম জাতীয় বৃত্তি নিয়ে পড়তে আসি, তখনই এখানকার আলপনা শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হই ৷ এখানে আলপনায় একটা অন্য নান্দনিকতা আছে ৷ আর সেই শিল্পকে দেশজুড়ে, বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিতেই আমি চেষ্টা করি ৷ দিল্লি, মুম্বইয়ের ছাত্রছাত্রীরাও আমার কাছে ক্লাস করেন ৷ এছাড়া বিদেশি ছাত্রছাত্রীরাও আছেন ৷ ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও রঙ্গোলি, কোলাম, ঝুতি আছে ৷ এগুলিও এক একটা শিল্প ৷ কিন্তু, একটা নির্দিষ্ট রীতি বা ধরন আছে ৷ আর শান্তিনিকেতনী আলপনা প্রকৃতি, ঋতু বিন্যাসকে তুলে ধরে শিল্পের ন্যায় ৷"

বোলপুর, 4 সেপ্টেম্বর: বৈদিক যুগ থেকে আলপনার প্রচলন ভারতীয় সংস্কৃতিতে ৷ তবে 'শান্তিনিকেতনী আলপনা'র একটা নিজস্ব ঘরানা রয়েছে ৷ যা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, শিল্পী অসিত হালদারের হাত ধরে প্রচার ও প্রসারিত হয়েছে ৷ বর্তমানে শান্তিনিকেতনে এই আলপনা শিল্পের ধারা বহন করে চলেছেন শিল্পী তথা অধ্যাপক সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায় ৷ 'শান্তিনিকেতনী আলপনা' নিয়ে আমেরিকায় কর্মশালাও করেছেন তিনি ৷ বর্তমানে অনলাইনে তাঁর কাছে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও সুইডেন থেকে পড়ুয়ারা ক্লাস করেন ৷ এবার ইটিভি ভারতকে তিনি জানালেন, উত্তর ভারতের রঙ্গোলি আর দক্ষিণ ভারতের কোলামের থেকে গ্রাম বাংলার ব্রত আলপনা ও শান্তিনিকেতনী আলপনা শিল্পের তারতম্যের কথা ৷

প্রকৃতি ও ঋতু বৈচিত্র্যের কথা বলে 'শান্তিনিকেতনী আলপনা' ৷ (ইটিভি ভারত)

হুগলি জেলার চন্দননগরের বাসিন্দা সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায় ৷ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিত্রকলা নিয়ে স্নাতক উত্তীর্ণ হন ৷ পরে জাতীয় বৃত্তি নিয়ে বিশ্বভারতীর কলাভবনে পড়াশোনা করেন ৷ ফের রবীন্দ্রভারতী থেকে স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হন ৷ তারপর 1983 সালে বিশ্বভারতীর উত্তরশিক্ষা সদনে অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন ৷ চিত্রকলার এই ছাত্রকে 'শান্তিনিকেতনী আলপনা' আকৃষ্ট করেছিল ৷ তারপর থেকে এই শিল্প নিয়ে নিরলস চর্চা শুরু করেন তিনি ৷ শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আজও তাঁর ও তাঁর ছাত্রছাত্রীদের দেওয়া আলপনাই শোভা পায় ৷

শান্তিনিকেতনের সুধীরঞ্জনদা মানেই আলপনা বিশেষজ্ঞ, এমনটাই পরিচিতি তাঁর ৷ 2017 সালে শান্তিনিকেতনী আলপনা শিল্প নিয়ে আমেরিকার নিউজার্সিতে টেগোর ফেস্টিভ্যালে কর্মশালাও করেছেন তিনি ৷ পরবর্তীতে 2022 সালে আমেরিকার লাস ভেগাসে কর্মশালা করেন ৷ এছাড়া, কলকাতা, মুম্বই, দিল্লি, দক্ষিণ ভারতের একাধিক রাজ্যে 'শান্তিনিকেতনী আলপনা' শিল্প নিয়ে কর্মশালা করেছেন ৷

বর্তমানে দেশের বিভিন্ন রাজ্য-সহ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন, ইংল্যান্ড থেকে শিক্ষার্থীরা অনলাইনে তাঁর কাছ থেকে আলপনা শেখেন ৷ অর্থাৎ, বর্তমানে 'শান্তিনিকেতনী আলপনা'র যে ঐতিহ্য, তার ধারক ও বাহক সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায় ৷ শান্তিনিকেতনের বাড়িতে বসে ইটিভি ভারতকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানালেন, আলপনা শিল্প কী, উত্তর ভারতের রঙ্গোলি ও দক্ষিণ ভারতের কোলামের থেকে গ্রাম বাংলার ব্রত আলপনা ও শান্তিনিকেতনী আলপনার ভিন্নতা কোথায় ?

আলপনার ইতিহাস কী?

আলপনা একটি নান্দনিক ঐতিহ্যবাহী শিল্প ৷ যা স্থায়ী শিল্প নয় ৷ দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া মহাদেশেও আলপনা শিল্পের চল ছিল ৷ তবে, এই শিল্পকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছে বা শিল্পের ধারা বহন করছে ভারতবর্ষ ৷ বৈদিক যুগ থেকেই বিভিন্ন মঙ্গল অনুষ্ঠান, যাগযজ্ঞে আলপনা দেওয়ার রীতি বিদ্যমান ৷ বর্তমানেও গ্রাম-বাংলা-সহ বাংলাদেশেও একইভাবে প্রচলন আছে আলপনার ৷ তবে, এগুলি সবই ধর্মীয় রীতি বা মঙ্গল অনুষ্ঠানের জন্য ৷ যাকে বলা হয় ব্রত আলপনা ৷

'শান্তিনিকেতনী আলপনা' কী ? কীভাবে এর প্রচলন ?

শাস্ত্রজ্ঞানী ছিলেন পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন (নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের দাদামশাই) ৷ বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো সমান অবদান ছিল তাঁর ৷ তিনিই বৈদিক যুগের মতো শান্তিনিকেতনে আলপনার প্রচলন করেছিলেন ৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 50 বছরের জন্মদিন পালনের সময় একবার এবং নন্দলাল বসুকে সম্মান দিতে শান্তিনিকেতন জুড়ে আলপনা দেওয়া হয়েছিল ৷

পরবর্তীতে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের শিলাইদহতে গিয়ে, তাঁদের দেওয়া আলপনা চোখে পড়েছিল কবিগুরুর ৷ তিনি একটি কাগজে আলতা দিয়ে আলপনা আঁকিয়ে এনেছিলেন ৷ সেটি ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দিয়ে গবেষণা করতে বলেছিলেন ৷ আলপনা নিয়ে গবেষণা করে 'বাংলার ব্রত' গ্রন্থটি লিখেছিলেন শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৷ এমনকি, শিল্পী নন্দলাল বসুরও ঝোঁক ছিল আলপনা শিল্পের প্রতি ৷ তিনি এই শিল্পকে সমৃদ্ধ করতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন ৷ এছাড়া, শিল্পী অসিত হালদারের অবদানও অবিস্মরণীয় ৷ এভাবেই শান্তিনিকেতনে আলপনা শিল্প সমৃদ্ধ হতে থাকে ৷

গ্রামবাংলার আলপনা ও শান্তিনিকেতনী আলপনার ফারাক কোথায় ? রঙ্গোলি ও কোলাম কি এক ?

গ্রাম বাংলার ব্রত আলপনায় অবশ্যই শিল্প রয়েছে ৷ তবে, তা ধর্মীয় গত ৷ কলমিলতা, শঙ্খলতা, খুন্তিলতা প্রভৃতির ব্যবহার হচ্ছে ৷ অর্থাৎ, একই রীতি বা ধারা অনুযায়ী চলে আসছে ৷ আর 'শান্তিনিকেতনী আলপনা' অনেক বেশি নান্দনিক ও সমৃদ্ধ ৷ এখানে ছয় ঋতুর বর্ণনা, গাছের পাতা, লতা, মেঘের প্রকারভেদ, প্রকৃতির বর্ণনা প্রভৃতি তুলে ধরা হয় ৷ আর 'শান্তিনিকেতনী আলপনা' প্রতি মুহূর্তে ভিন্ন ভিন্ন শিল্পের ছোঁয়া পায় ৷ এক একজন শিল্পী এক একরকমভাবে নিজের শিল্প মাধুর্য যুক্ত করে থাকেন ৷ এটাই পার্থক্য ৷

উত্তর ভারতের রঙ্গোলি হল রংয়ের খেলা বা রঙের শিল্প ৷ এখানে বিভিন্ন রং দিয়ে নকশা তৈরি করা হয় ৷ যা দৃশ্যমান রঙিন সৌন্দর্য ৷ আর দক্ষিণ ভারতের কোলাম হল চালগুঁড়ো, আটা, খড়িমাটি বা রঙ ব্যবহার করে সাজিয়ে তোলা হয় ৷ চৌক চৌক ছক কেটে এগুলি একই ধারায় চলে আসছে ৷

রঙ্গোলি আর কোলামের থেকে শান্তিনিকেতনী আলপনার ভিন্নতা হল, শান্তিনিকেতনে আলপনার কোন রীতি নেই ৷ প্রতি মুহূর্তে শিল্প সমৃদ্ধ হচ্ছে ৷ কোনও নির্দিষ্ট ধারা ছাড়াই প্রকৃতিকে আলপনায় ফুটিয়ে তোলা হয় এখানে ৷

শিল্পী সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায় বলেন, "শান্তিনিকেতনে যখন প্রথম জাতীয় বৃত্তি নিয়ে পড়তে আসি, তখনই এখানকার আলপনা শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হই ৷ এখানে আলপনায় একটা অন্য নান্দনিকতা আছে ৷ আর সেই শিল্পকে দেশজুড়ে, বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিতেই আমি চেষ্টা করি ৷ দিল্লি, মুম্বইয়ের ছাত্রছাত্রীরাও আমার কাছে ক্লাস করেন ৷ এছাড়া বিদেশি ছাত্রছাত্রীরাও আছেন ৷ ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও রঙ্গোলি, কোলাম, ঝুতি আছে ৷ এগুলিও এক একটা শিল্প ৷ কিন্তু, একটা নির্দিষ্ট রীতি বা ধরন আছে ৷ আর শান্তিনিকেতনী আলপনা প্রকৃতি, ঋতু বিন্যাসকে তুলে ধরে শিল্পের ন্যায় ৷"

ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.