রাজারহাট, 17 জানুয়ারি: সিপিএমের স্বপ্নপূরণ ৷ জ্যোতি বসুর নামাঙ্কিত গবেষণা কেন্দ্রের প্রথম পর্বের উদ্বোধন করলেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির কো-অর্ডিনেটর প্রকাশ কারাট ৷ অতীতে প্রয়াত নেতা নিজে উল্লেখ করেছিলেন, তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হতে না দেওয়াটা ঐতিহাসিক ভুল ৷ সেই ভুলের কান্ডারি হিসাবে প্রকাশ কারাটকেই চিহ্নিত করে রাজনৈতিক মহল ৷ শুক্রবার তাঁর হাত ধরে জ্যোতি বসুর নামাঙ্কিত গবেষণা কেন্দ্রের উদ্বোধন অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ৷
কারাট বলেন, "বাবরি মসজিদ যখন ভাঙা হয়, সেই সময় জ্যোতি বসুর ভূমিকা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ ৷ এই ঘটনাকে তিনি বর্বর-দের কাজ বলেছিলেন ৷ এখন এই সময়েও তিনি প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ ৷ উগ্র হিন্দুত্ববাদের নামে হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণের চেষ্টা চলছে ৷ সেখানে দাঁড়িয়ে তাঁর দেখানো পথ তাঁর চিন্তাভাবনাকে আরও বলীয়ান করতে হবে ৷"
রাজনৈতিক মহলের সকলে জানে 1996 সালে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর, প্রধানমন্ত্রীর হওয়ার প্রধান অন্তরায় ছিলেন এই কারাট ও তাঁর গোষ্ঠী ৷ সেই ঘটনাকে জ্যোতি বসু নিজেই ঐতিহাসিক ভুল বলেছিলেন ৷ 29 বছর পর জ্যোতি বসুর নামাঙ্কিত গবেষণা কেন্দ্রের প্রথম পর্বের উদ্বোধন করলেন সেই প্রকাশ কারাটই ৷ তিনি এখন সিপিএমের পলিট ব্যুরো কো-অর্ডিনেটর ৷
এই বিশেষ দিনে পুরনো বাম কর্মী-সমর্থকদের মনে পড়ছে জ্যোতি বসুর অনুগামী হিসাবে পরিচিত লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কথা ৷ 2008 সালে প্রথম ইউপিএ সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে বামেরা ৷ সেই সময় দলের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হতে পারেননি স্পিকার পদে থাকা সোমনাথ ৷ তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করে সিপিএম ৷ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই আক্ষেপ ছিল সোমনাথের ৷
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
1996 সালের লোকসভা নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছিল বিজেপি ৷ দ্বিতীয় স্থানে ছিল কংগ্রেস ৷ 543টি লোকসভা আসনের ম্যাজিক ফিগার 272টি আসন কোনও দলই পায়নি ৷ এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস সরকার গড়তে কয়েকটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে ৷ সেই সময় একাধিক রাজনৈতিক নেতা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেখতে চেয়েছিলেন ৷ আরজেডি প্রধান লালুপ্রসাদ যাদব থেকে সমাজবাদী পার্টির মুলায়ম সিং যাদব, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ভিপি সিংও চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসুন জ্যোতি বসু ৷
সিপিএমের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক হরকিষণ সিং সুরজিৎও জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী হওয়াকে ব্যক্তিগতভাবে সমর্থন জানিয়েছিলেন ৷ কিন্তু কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য প্রকাশ কারাট থেকে প্রয়াত সীতারাম ইয়েচুরি এবং বাংলার কিছু নেতা এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন ৷ পক্ষে ছিলেন সদ্য প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ৷ বাকি অনেকেই প্রকাশ কারাটদের মতকেই সমর্থন করেছিলেন ৷
জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী হওয়া নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে ভোটাভুটি পর্যন্ত হয়েছিল ৷ তারপর সিপিএম সাফ জানিয়েছিল, জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী হবেন না ৷ এই সিদ্ধান্তের পর সমাজে বিশিষ্ট মানুষজন চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় কমিটিকে ৷ ফের বৈঠক বসে ৷ সেখানেও কারাটপন্থীদের অবস্থান অটুট থাকে ৷ পরে দিল্লিতে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক থেকে বেরিয়ে দলের এই প্রধানমন্ত্রীর না-হওয়ার সিদ্ধান্তকে 'ঐতিহাসিক ভুল' বলে উল্লেখ করেছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ৷
তার 28 বছর পর অর্থাৎ 2024 সালে জ্যোতি বসুর প্রয়াণ দিবসে নিউটাউনে তাঁর নামাঙ্কিত গবেষণা কেন্দ্রের শিলান্যাস করেন পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি ৷ গত বছরের 12 সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যু হয় ৷ এখন দলের পলিটব্যুরো কো-অর্ডিনেটর প্রকাশ কারাট ৷ এবার তাঁর হাত ধরে এই কেন্দ্রের উদ্বোধন হল ৷
অনুষ্ঠানে কারা কারা ছিলেন ?
উপস্থিত ছিলেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বৃন্দা কারাট, ইউসুফ তারিগামী, ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার, সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম, বিমান বসু, সুহাসিনী আলী-সহ অন্যরা ৷ পাঁচ একর জমির উপর এই গবেষণা কেন্দ্র-সহ আরও অনেক কর্মকাণ্ড হবে এই গবেষণা কেন্দ্রে ৷ জ্যোতি বসু গবেষণা কেন্দ্রের জন্য এই জমি পেতে অনেক লড়াই করতে হয়েছে সিপিএমকে ৷
গবেষণা কেন্দ্রে কী কী হবে ?
আপাতত এই গবেষণা কেন্দ্রের দু'টি তলা তৈরি হয়েছে ৷ ভবনটি ছ'তলা করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে ৷ নবনির্মিত ভবনে রাখা হয়েছে জ্যোতি বসুর ব্যবহার করা খাট থেকে বসার চেয়ার, তাঁর পাওয়া পুরস্কার, স্মারক থেকে শুরু করে তাঁর মোমের মূর্তি ৷ একাংশে চালু হয়েছে লাইব্রেরি ৷ সামনে থাকছে বিরাট জলাশয় ৷
এদিন জ্যোতি বসুর 12 মাসের 24টি ঘটনার সংকলন এবং এই গবেষণা কেন্দ্র সম্পর্কিত নানা বিষয় নিয়ে প্রকাশিত হয় একটি ডায়রি ৷ পাশাপশি দু'টি গবেষণাপত্রও প্রকাশিত হয়েছে ৷ প্রকাশ করেন অধ্যাপিকা ঈশিতা মুখোপাধ্যায় ৷ তাঁর কথায়, "মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন জ্যোতিবাবু মানুষের স্বার্থে ও উন্নতিতে কাজ করেছেন ৷ এই গবেষণা কেন্দ্র সেই দিকটা তুলে ধরবে ৷ দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা বিশ্বিদ্যালয়, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়-সহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের বিশিষ্টরা এই কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ৷ কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজ্য সরকারের কেউ আসল তথ্য দিচ্ছে না ৷ তাই এই গবেষণা কেন্দ্র সেই সব তথ্য মানুষের কাছে তুলে ধরবে ৷"
এদিন প্রকাশিত দু'টি গবেষণাপত্র- 'Economic Deprivation in Rural West Bengal: Contours and Trajectories' এবং 'Looming Crisis of Lives and Livelihoods: Employment and Unemployment in West Bengal' ৷ এই দু'টি গবেষণাপত্রের একটিতে দুঃস্থ মানুষ, অন্যটিতে পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে ৷