কলকাতা, 3 ডিসেম্বর: সরকারের আবেদনে সাড়া দিয়ে ধর্মঘট তুলে নিল প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতি । তবে আগামিকালও ধর্মঘট বহাল থাকছে । আলু ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক জানিয়েছেন, বুধবার রাতে হিমঘর থেকে আলু সরবরাহ হবে বাজারে ৷ তাঁরা মোট 48 ঘণ্টার ধর্মঘট পালন করবেন ।
প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতির রাজ্য সম্পাদক লালু মুখোপাধ্যায় এদিন বলেন, "বর্ধমান সদরে আলু ব্যবসায়ী সমিতির ভবনে পূর্ণাঙ্গ রাজ্য কমিটির সদস্যদের নিয়ে আমরা বৈঠকে বসেছিলাম । সকল সদস্যের সহমতে বিভাগীয় মন্ত্রীর আবেদনে সাড়া দিয়ে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হল । সোমবার খাদ্য ভবনে কৃষি বিপণন মন্ত্রী বেচারাম মান্না-সহ সরকারি আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠকে আলোচনা হয় । সেখানেই বলা হয়েছিল, যদি আমরা ধর্মঘট তুলে নিই, তাহলে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে ভিন রাজ্যে আলু রফতানির বিষয়টি নিয়ে বিবেচনা করা হবে এবং ধাপে ধাপে আলু ছাড়ার ব্যবস্থা করবে সরকার ।"
তিনি আরও জানান, "আমরা আজ সরকারের আশ্বাসের ভিত্তিতে বুধবার রাত থেকেই হিমঘর থেকে আলু বের করার ব্যবস্থা করব । অর্থাৎ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে যথারীতি আলুর বাজার সচল হয়ে যাবে । আমরা অনুভব করেছি এই ধর্মঘটের দোহাই দিয়েই কিছু ব্যবসায়ী আলুর দাম বৃদ্ধি করতে চাইছেন । সেই কথা মাথায় রেখেই এই চিন্তাভাবনা আমাদের ।"
ব্যবসায়ীদের ধর্মঘটের জেরে হিমঘর থেকে বাজারে সাপ্লাই বন্ধ আলুর । রাজ্যের প্রায় 45টি হিমঘরে তালা ৷ আজ ধর্মঘটে সামিল হয়েছিলেন 25 হাজার আলু ব্যবসায়ী ৷ তার প্রভাবে আম জনতার পকেটে টান পড়ে ৷ কলকাতার পাইকারি বাজার হোক বা খুচরো, দুই ক্ষেত্রেই এক লাফে অনেকটা বেড়ে যায় আলুর দাম ।
আচমকা আলুর আগুন দামবৃদ্ধিতে মাথায় হাত পড়ে গৃহস্থের ৷ গত মাসে খোলা বাজারে কোথাও কেজি প্রতি 32 টাকা আবার কোথাও আলু বিকোচ্ছিল 34 টাকা কেজি দরে । সেই দাম কমাতে প্রশাসনের তরফে শুরু হয় লাগাতার অভিযান । পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারের তরফে ভিন রাজ্যে আলু পাঠানো বন্ধ করে দেওয়া হয় ৷ এতেই বেজায় চটেন আলু ব্যবসায়ীরা ৷ এই নিয়ে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের পরও রফা সূত্রে বের বের হওয়ায়, আলু ব্যবসায়ীরা আজ থেকে শুরু করেছিলেন ধর্মঘট । তার জেরে চড়চড় করে বাড়ে আলুর দাম ৷
পাইকারি বাজারে যে বস্তা গত দু'দিন আগে 1550 টাকায় বিক্রি হচ্ছিল, সেই বস্তাই আজ 1750-1800 টাকায় বিক্রি হয়েছে । এদিকে, খোলা বাজারে 32-34 টাকা কেজি দরের আলুর দাম এক লাফে বেড়ে আজ হয়েছে 40 টাকা প্রতি কেজি । স্বাভাবিকভাবেই নাভিশ্বাস উঠছে ক্রেতাদের । অধিকাংশ তরি-তরকারিতেই আলুর প্রয়োজন হয় ৷ আর সেই নিত্য প্রয়োজনীয় সবজি কিনতেই হাত পুড়ছে আম নাগরিকের । অসহায় অবস্থা সাধারণ ক্রেতা ও খুচরো বিক্রেতাদের ৷
কোলে মার্কেটের পাইকারি ব্যবসায়ীদের কথায়, "গাড়ি আসছে না । জোগান কমতেই এই দাম বাড়ছে । যদি ধর্মঘট চলতে থাকে বস্তা পিছু আরও বেশি দাম হবে । যতটুকু আলু আছে সেটা দিয়েই ব্যবসা চালাচ্ছি । ফের গাড়ি আসতে শুরু করলে দাম কমতে পারে । তার আগে দাম কমার কোনও সম্ভাবনা নেই ।"
খুচরো ব্যবসায়ীদের কথায়, "কেনা দাম পড়ছে 35-36 টাকা কেজি । তার উপর মুটে ও ভ্যান খরচ আছে । কেজি প্রতি 2 টাকা লাভ না হলে ব্যবসা করে লাভ কী ? ধর্মঘটের জেরে আলু আসা বাজারে কমেছে ।"
ক্রেতারা বলছেন, "আলু এমনিতেই দাম বেশি হওয়াতে সমস্যা হচ্ছিল । কারণ এটি অতি প্রয়োজনীয় একটি সবজি । ধর্মঘট শুনতেই আলু কিনেছি, দাম এখন 40 টাকা কেজি ।" আরেক জনের কথায়, "আমার মাসে চার কেজি আলু লাগতো, দাম বাড়ায় কেজি খানেক কম কিনছিলাম । কিন্তু এখন যে দাম, তাতে প্রয়োজনের অর্ধেক কিনতে হবে । না হলে পুষিয়ে উঠতে পারব না ।"
মন্ত্রী বেচারাম মান্না আজ জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে রাজ্যে 6 লক্ষ 2 হাজার মেট্রিক টন আলু স্টোর করা আছে । গত বছর মোট 63 লক্ষ 5 হাজার মেট্রিক টন আলু উৎপাদন করা হয়েছিল । এবছর 58 লক্ষ 840 মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হয়েছে । ঝড়-বৃষ্টির কারণে এ বছর আলুর উৎপাদন অনেকটা ব্যাহত হয়েছে । 18 হাজার মেট্রিক টন আলু প্রতিদিন রাজ্যে খরচ হয় । কলকাতায় প্রতিদিন গড়ে পাঁচ হাজার মেট্রিক টন আলু খরচ হয়। আগামী দুই মাস এরাজ্যে 15 হাজার মেট্রিক টন আলু গড়ে খরচ হবে বলে জানান তিনি ।
পাশাপাশি তিনি ফের জানিয়ে দিয়েছেন, "একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী চাষিদের কাছ থেকে 650 টাকা থেকে 750 টাকা করে 50 কেজির বস্তা আলু ক্রয় করে রেখে দিয়েছে । এই মুহূর্তে তাঁরা এক হাজার থেকে 1200 টাকারও বেশি দরে আলু বিক্রি করছে । বাইরে আলু পাঠাচ্ছে । কৃষকের হাতে এই মুহূর্তে আলু নেই । কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও 40 জন হিমঘর মালিক এই আলু রেখেছে । রাজ্যে সরকার এবং মুখ্যমন্ত্রী পুরো বিষয়টির উপর নজর রেখেছে । ইতিমধ্যেই প্রতিটি জেলার ডিএমদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ।"
সিঙুর রতনপুর পাইকারি বাজারে প্রতীকী একদিনের ধর্মঘটে সামিল হন ব্যবসায়ীরা । এই জায়গা থেকেই কলকাতা, দুই 24 পরগনা, নদিয়া-সহ বিভিন্ন জায়গায় আলু যায় । সিঙ্গুর আলু ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক সুকুমার সামন্ত বলেন, "প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতির ডাকে সংগঠনের স্বার্থে এখানে প্রায় 200 জন আলু ব্যবসায়ী প্রতীকী ধর্মঘট পালন করছেন । আগামিকাল থেকে ফের স্বাভাবিক হয়ে যাবে । যখনই ধর্মঘটের কথা ঘোষণা হয়েছে, তখন থেকেই সব আলু ব্যবসায়ী আলু মজুত করা শুরু করেছেন । তাঁরাই হয়তো আলুর দাম এক টাকা, দু টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করা শুরু করেছেন । বাজারে আমদানি না থাকলে দাম বৃদ্ধি পাবেই । বর্ধমান, মেদিনীপুর ও বাঁকুড়া-সহ বেশকিছু জেলার আলু খুব উন্নত নয় । এখানে সেই আলু সেভাবে খাওয়া হয় না । তাই সারা বছর এখানকার আলু বাইরে যায় । আমাদের এখনও যা আলু আছে তাতে ভিন রাজ্যে আলু গেলে কোনও অসুবিধা নেই ।"