বর্ধমান, 26 সেপ্টেম্বর: জয়েন্টে পাশ করে ডাক্তারি পড়তে কোচবিহারে গিয়েছিলেন। কোচবিহারের মহারাজা জিতেন্দ্রনাথ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডাক্তারি পড়ার সময় শান্ত স্বভাবের মেয়ের আত্মহত্যার খবর পায় বাবা-মা ৷ খবর পেয়ে তাঁরা তড়িঘড়ি ছুটে যান মেডিক্যাল কলেজে ৷ এক বছর পেরিয়ে গেলেও কীভাবে সেই ডাক্তারি ছাত্রীর মৃত্যু হয়েছিল, ধোঁয়াশা কাটেনি পরিবারের। মেয়ের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ সামনে আসুক, চাইছে মৃতা ছাত্রীর পরিবার।
বর্ধমান শহরের ক্ষুদিরামপল্লি এলাকার বাসিন্দা ছাত্রীর পরিবার ৷ বাবা ব্যবসায়ী ৷ ছোট মেয়েকে 2022 সালে কোচবিহারের মহারাজা জিতেন্দ্রনাথ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডাক্তারি পড়তে পাঠিয়েছিলেন ৷ কিন্তু কিছুদিন পর ওই ডাক্তারি পড়ুয়া জানতে পারেন, মেডিক্যাল কলেজে প্রকাশ্যে নকল করে পরীক্ষা দেওয়া হয় ৷ মেয়ের কাছ থেকে এটা জানার পর ছাত্রীটির বাবা এই বিষয়ে প্রিন্সিপালের কাছে অভিযোগ জানানোর কথা ভাবেন ৷ কিন্তু নিজের পড়াশোনার কথা ভেবে মেয়ে বাবাকে অভিযোগ জানাতে মানা করেন ৷
শুধু নকল করে পরীক্ষা দেওয়াই নয়, পরীক্ষার পর সেই খাতা ব্যাগেই রেখে দিতে বলা হত ছাত্রছাত্রীদের ৷ প্রফেসারেরা বলতেন, সেই খাতা জমা দিতে হবে না ৷ পরে দেখে নম্বর দেওয়া হবে ৷ এমনকি বেশিরভাগ দিন ক্লাস হত না। হস্টেলে পড়াশোনার পরিবেশও ছিল না ৷ তাই তিনি বাড়ি ফিরে আসতে চাইছিলেন ৷ কিন্তু বাবা-মা তাঁকে বুঝিয়ে সেখানেই পড়াশোনা করতে বলেন ৷ সবকিছু দেখে ছাত্রীটি ডিপ্রেশনে চলে যান ৷ সেই কথা মেয়ে তাঁর বাবা-মাকে জানিয়েছিলেন ৷ হস্টেলে ইন্ট্রো দেওয়ার নামে চলত ঘণ্টার পর ঘণ্টার অত্যাচার ৷ এমন অভিযোগও করেছিলেন বর্ধমানের ওই ডাক্তারি পড়ুয়া ৷ এরপরেই তাঁর অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর পায় পরিবার।
মৃতা ছাত্রীর বাবা বলেন, "আমাদের নিয়ে গিয়ে ঘণ্টা দেড়েক বসিয়ে রাখা হয়েছিল ৷ তারপর দেখলাম মেয়ে স্ট্রেচারে শায়িত রয়েছে ৷ গলায় কাপড়ের পাড় জড়ানো ৷ কোন ঘরে মারা গিয়েছে, সেটা দেখতে চাইলেও দেখানো হয়নি ৷ সকাল সাড়ে 6টায় কলেজের প্রিন্সিপাল আমার মেয়ের মৃত্যুর খবর জানতে পারেন ৷ অথচ আমাদের খবর দেওয়া হয়, আরও 6 ঘণ্টা পরে ৷ দুপুর 12 থেকে সাড়ে 12টা নাগাদ আমাদের ফোন করে জানানো হয় ৷"
পরিবারের অভিযোগ, ময়নাতদন্তের পরে দেহ দাহ করতে নিয়ে যাওয়ার সময় কলেজের সিনিয়র ছাত্ররা তাঁদের ঘিরে রেখেছিল ৷ যে তিন জন ছাত্রীটির বন্ধু ছিল, মৃত্যুর পর একবারও তাঁদের কথা বলতে দেওয়া হয়নি ৷ তাঁদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ। মৃতার বাবা-মায়ের আক্ষেপ, আর্থিক অবস্থা ভালো না-থাকায় তাঁরা কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করতে পারেননি ৷ পাশাপাশি পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে মৃতার পরিবার।
মৃতার বাবা বলেন, "ফোনেই পুলিশ জিজ্ঞাসা করে, তারা বডি ময়নাতদন্তের জন্য পাঠাবে কি না ? তবে আমরা অনুমতি না-দেওয়ায়, তখন পুলিশ আর কিছু বলেনি ৷ পুলিশে অভিযোগ করতে পারিনি ৷ কারণ পুলিশ আমাদের মিসগাইড করেছিল ৷ পুলিশের থেকে কোন সহযোগিতা পাইনি ৷ অথচ তার আগের দিন রাতেই আমার সঙ্গে, ওর মা ও দিদির সঙ্গে কথাও মেয়ে কথা বলেছিল ৷ দিদির কাছে কেঁদে বলেছিল আমাদের জন্য ওর মন খারাপ করছে ৷ ওই কলেজে পড়াশোনার পরিবেশ নেই ৷ তবে কয়েকজন সিনিয়র ছাত্রছাত্রী খুব সাহায্য করত ৷ আমরা চাই মৃত্যুর সঠিক কারণ সামনে আসুক। আগামী দিনে যারা ডাক্তারি পড়বে, তাদের যেন এই ধরনের সমস্যার মুখে পড়তে না হয় ৷"
মৃতার মা বলেন, "ঘটনার আগের রাতে মেয়ে ফিজ চেয়ে ফোন করে ৷ তবে যা শুনেছি, ওর তিন বন্ধুর সঙ্গে কোন তর্কবিতর্ক হয় ৷ পরের দিন সকালে মেয়ের দেহ উদ্ধার হয় ৷ দুপুরে আমাদের খবর দেওয়া হয় ৷ এদিকে ওই তিন ছাত্রীর অভিভাবকেরা আগেই সেখানে পৌঁছে যায় ৷ তারা তাঁদের মেয়েদের নিয়ে চলে যায় ৷ কী কারণে মেয়ের মৃত্যু হল, সেই উত্তর আজও পাইনি ৷ ওই তিন ছাত্রীর শাস্তি হওয়া উচিত ৷ আমার মনে হয়, ওরাই ঘটনায় যুক্ত ৷ কলেজ তাদের আড়াল করছে ৷ আমাদের সঙ্গে ওই ছাত্রীদের যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি। পুলিশও বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।"
বুধবার মৃতার পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন সিনিয়র চিকিৎসক সংগঠনের নেতা ডাঃ সুবর্ণ গোস্বামী ৷ তিনি বলেন, "আমরা খবর পাই, কোচবিহার মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রীর অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছিল । বাড়ির লোককে জানানো হয় মেয়ে আত্মঘাতী হয়েছে । চিকিৎসক সংগঠনের তরফে আমরা ছাত্রীর বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলি । কলেজ কর্তৃপক্ষ ঘটনার 6 ঘণ্টা পরে বাড়ির লোককে জানিয়েছিল । আর যিনি ইনভেস্টিগেশন অফিসার ছিলেন, তাঁর কাছে ওই ছাত্রীর ফোন ছিল । ছাত্রীর বাড়ি থেকে বারবার করে ফোন করা হলেও ওই অফিসার ফোন ধরেননি । মেয়েটি যে ঘরে আত্মহত্যা করে, সেই ঘরটি মেয়ের মা-বাবা দেখতে দেওয়া হয়নি ৷ আরও বেশ কিছু জিনিস তারা জানতে পেরেছেন ৷ পরিবারের লোকের মনে হয়েছে, তাঁদের মেয়ে থ্রেট কালচারের শিকার ৷ আমরা বলেছি, আইনি লড়াই লড়তে চাইলে চিকিৎসক সংগঠন সাহায্য করবে ৷"