শিলিগুড়ি, 19 জুন: কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনায় প্রথম থেকেই রেলবোর্ড এই ঘটনার দায় চাপাচ্ছে মালগাড়ির মৃত চালক ও জীবিত সহকারী চালকের উপর ৷ তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত দু'জন চালককে কাঠগড়ায় তোলার বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখছেন না রাজ্যের মন্ত্রী থেকে প্রাক্তন রেল কর্তারা ৷
এদিকে রেলের তদন্তে শুরু থেকে অসঙ্গতি ধরা পড়েছে ৷ কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস ট্রেন দুর্ঘটনার দিন 17 জুন বেলায় রেলবোর্ডের সিইও জয়া বর্মা জানিয়েছিলেন, পণ্যবাহী ট্রেনের চালক ও সহকারী চালকের মৃত্যু হয়েছে ৷ এদিকে পরে জানা যায়, চালক অনিল কুমারের মৃত্যু হলেও জীবিত রয়েছেন সহকারী চালক মনু কুমার ৷ তাঁকে প্রথমে রেলের হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও পরে বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় ৷ এখন তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন ৷
একটি ভাইরাল হওয়া ভিডিয়োয় দুর্ঘটনার পর তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়া মিলেছে । মনু কুমার জিজ্ঞেস করেন, "ড্রাইভার সাব ক্যায়সে হ্যয় (চালক কেমন আছেন) ৷" যদিও তাঁকে মালগাড়ির চালকের মৃত্যুর খবর জানানো হয়নি ৷ তাঁর চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ । বাড়ির লোককে দুর্ঘটনার খবর দিতে চান না তিনি ৷ খুব বেশি কথা বলতে পারছেন না মনু । তবে এই ভিডিয়োটির সত্যতা যাচাই করে দেখেনি ইটিভি ভারত ৷
কেন হল কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা ? কী করে এক লাইনে চলে এল দু'টি ট্রেন ? কী করেই বা মালগাড়িটি সজোরে ধাক্কা মারল কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসকে ? এসবেরই উত্তর খুঁজছেন রেলওয়ে সেফটির আধিকারিকরা ।
তদন্তে নেমেছেন এনএফ রেলের চিফ কমিশনার অফ রেলওয়ে সেফটি জনক কুমার গর্গও ৷ মঙ্গলবার সকাল থেকে তদন্ত চলছে । দুর্ঘটনার সময় রেলের কাজের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন বিভাগের 41 জনকে জিজ্ঞাসাবাদ ও বয়ান নেওয়া হয় । গার্ড ম্যান, সিগন্যাল, কন্ট্রোল রুম, কমিউনিকেশন, ট্রেন ম্যানেজার, স্টেশন মাস্টার-সহ আরও একাধিক কর্মীর বয়ান শোনেন জনককুমার গর্গ ।
তবে এই গোটা ঘটনার একমাত্র সাক্ষী মালগাড়ির সহকারী চালক মনু কুমার । এখন একমাত্র তিনি পারেন এর রহস্য উন্মোচন করতে । কিন্তু তিনিও এখন শিলিগুড়ির একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ।
প্রাক্তন রেল কর্তাদের মতে, রেলবোর্ডের কথায় একাধিক অসঙ্গতি ধরা পড়েছে ৷ একদিকে দুর্ঘটনার দিন মনু কুমারকে মৃত বলে ঘোষণা করেছিল রেলবোর্ড ৷ অন্যদিকে মালগাড়ির চালক ও সহকারী চালকের বিশ্রাম নেওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে ৷ সিগন্যালিংয়ের জন্য রেলে কর্মীর ঘাটতি রয়েছে । তাই কর্মীদের উপর অতিরিক্ত চাপ থাকে ৷ ট্রেনের চালক ও সহকারী চালকের দু'দিন নাইট ডিউটি করার পর একদিন ছুটি পাওয়ার কথা ।
রেলের একটি সূত্র বলছে, মালগাড়ির সহকারী চালক মনু কুমারকে তিন রাত টানা ডিউটি করতে হয়েছিল ৷ রাতে ছুটি পেলেও পরের দিন অর্থাৎ সোমবার ভোরে তাঁকে ফের কাজে যোগ দিতে বলা হয় ৷ এই দাবি করেছেন মনু কুমারেরই এক সহকর্মী ৷ রেলের আরেকটি সূত্র মারফত জানা গিয়েছে, মনু কুমার ও মৃত অনিল কুমার সোমবারের আগে 30 ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বিশ্রাম নিয়েছিলেন ৷
পাশাপাশি ঘটনার দিন সকাল থেকেই অটোমেটিক সিগন্যালিং কাজ করছিল না ৷ ফলে মেমো সই করে চলছিল ট্রেন চলাচল । মেমোর মাধ্যমেই কোন কোন সিগন্যাল খারাপ রয়েছে এবং কোন কোন সিগন্যালে দেখে যেতে হবে তা দেখার জন্য জানানো হয়েছিল । সেই মেমো দিতেও নাকি ভুল করেছিলেন রাঙাপানির স্টেশন মাস্টার ।
এছাড়া ট্রেনে ভিজিল্যান্স কন্ট্রোল ডিভাইস থাকার কথা । যা ওই ট্রেনে থাকলেও কাজ করেনি । সব শেষে দুটি ট্রেনের অবস্থান ও গতিবেগ মনিটরিংয়ের জন্য স্টেশনে প্যানেল রুম থাকে যার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে ৷ তবে তদন্ত শেষ হওয়ার আগে চালকদের উপর দায় চালিয়ে দেওয়াটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে মত অনেকের ।
তবে ঘটনার সময় যে একাধিক সমস্যা ছিল তা এ দিন তদন্তে পরিষ্কার । এখন রেল কর্তৃপক্ষ গোটা ঘটনা ধামাচাপা দিতে একপ্রকার নিহত মালগাড়ির চালক অনিল কুমার ও সহকারী চালক মনু কুমারের উপর দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে । আর তাতে চেপে দেওয়া হচ্ছে ঘটনার মূল কারণ বলে ওয়াকিবহলের মত ।
উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী উদয়ন গুহ বলেন, "এটা রেলের কাছে খুব সহজ । মৃতের উপর দায় চাপালে বলার কেউ থাকবে না । এ দিকে নিজেদের ভুলটা তারা ধরবে না ।" এনএফ রেলওয়ে মজদুর ইউনিয়নের সম্পাদক তথা প্রাক্তন ট্রেন চালক আশিস বিশ্বাস বলেন, "এখানে সঠিক কী হয়েছে তা তদন্ত করে দেখা উচিৎ । তবে যেখানে সিগন্যাল খারাপ থাকায় 15 কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায় ট্রেন যাওয়ার কথা । সেখানে দুর্ঘটনায় মালগাড়ির ধাক্কা ও ক্ষতির পরিমাণ দেখে বোঝা যাচ্ছে গতিবেগ অনেকটাই বেশি ছিল । এছাড়াও আরও অনেক ত্রুটি থাকতে পারে, যার তদন্তের প্রয়োজন ।"