মালদা, 8 জানুয়ারি: টানা 16 ঘণ্টার জেরা ৷ তারপরেই তৃণমূল নেতা দুলাল সরকার খুনের ঘটনায় গ্রেফতার করা হল শাসকদলেরই ইংরেজবাজার শহর সভাপতি নরেন্দ্রনাথ তিওয়ারিকে ৷ গ্রেফতার করা হয়েছে স্বপন শর্মা নামে আরও একজনকে ৷ এই স্বপন শর্মা বাম আমলের ত্রাস হিসাবেই চিহ্নিত ৷ ধৃত দু'জনকেই বুধবার মালদা জেলা আদালতে পেশ করা হয় ৷ এই নিয়ে মামলায় এখনও পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেফতার করা হল ৷
পুলিশ সুপার প্রদীপকুমার যাদব বলেন, "দুলাল সরকার খুনকাণ্ডে আরও দু'জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে ৷ ধৃতদের নাম নরেন্দ্রনাথ তিওয়ারি ও স্বপন শর্মা ৷ ধৃতদের আজই জেলা আদালতে পেশ করা হবে ৷ এই মামলায় এনিয়ে মোট সাতজনকে গ্রেফতার করা হল ৷ তবে এখনও পর্যন্ত কৃষ্ণ রজক আর বাবলু যাদবের সন্ধান মেলেনি ৷ তাঁদের খোঁজ চলছে ৷ গোটা ঘটনা নিয়ে পুলিশি তদন্ত জারি রয়েছে ৷"
গত 2 জানুয়ারি দুষ্কৃতীদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যান তৃণমূল নেতা দুলাল সরকার ৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি ৷ তাঁর খুনের ঘটনায় পুলিশকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী ৷ ঘটনার দিনই ঝাড়খণ্ডে পালানোর সময় মানিকচকে গঙ্গার ঘাটে গ্রেফতার করা হয় শামি আখতার ও টিংকু ঘোষ নামে দুই দুষ্কৃতীকে ৷ তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে অভিজিৎ ঘোষ আর অমিত রজক নামে আরও দু'জনকে জালে তোলে পুলিশ ৷
এরপর বিহারের কাটিহার জেলার শালমারা থেকে গ্রেফতার করা হয় আবদুল গনি নামে আরও এক শার্প শ্যুটারকে ৷ জেরা করে পুলিশ জানতে পারে, তাঁদের এই কাজে নিয়োগ করেছিলেন কৃষ্ণ রজক ওরফে রোহন ৷ তিনি এখনও পলাতক ৷ পলাতক এই ঘটনায় আরেক চক্রী বাবলু যাদবও ৷ তাঁদের খোঁজ পেতে প্রত্যেকের জন্য দু'লাখ টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা করেছে জেলা পুলিশ ৷
কিন্তু পাঁচজনের গ্রেফতারির পরও প্রশ্ন ছিল, এই খুনের পিছনে আসল মুখ কে বা কারা ? প্রয়াত নেতার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে এসে প্রশ্ন তুলেছিলেন রাজ্যের স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যও ৷ বিশেষ সূত্রে খবর, এক্ষেত্রে পুলিশের সন্দেহের তালিকায় রয়েছে বেশ কয়েকটি নাম ৷ সেই তালিকা থেকেই মঙ্গলবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ইংরেজবাজার থানায় ডেকে পাঠানো হয় শহর তৃণমূলের সভাপতি তথা দলের হিন্দি সেলের জেলা সভাপতি নরেন্দ্রনাথ তিওয়ারি-সহ তাঁর দুই ভাই বীরেন্দ্রনাথ ও অখিলেশকে ৷
বেলা দুটো নাগাদ থানায় উপস্থিত হন তিন ভাই ৷ বীরেন্দ্রনাথকেই প্রথমে জেরা করা হয় ৷ বিকেল পাঁচটা নাগাদ নরেন্দ্রনাথ ও অখিলেশকে জেরা শুরু করেন পুলিশকর্তারা ৷ প্রথমে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গ্রামীণ) আবু বক্কর, তারপর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) সম্ভব জৈন তাঁদের জেরা করেন ৷ সঙ্গে ছিলেন অন্যান্য পুলিশ অফিসাররাও ৷ রাত পৌনে দশটা নাগাদ থানায় ঢোকেন পুলিশ সুপার প্রদীপকুমার যাদব ৷ জেরা শুরু করেন তিনি ৷ রাতেই থানায় নিয়ে আসা হয় স্বপন শর্মাকে ৷
বুধবার সকাল পৌনে ন'টা পর্যন্ত টানা জেরার পর থানা থেকে বেরিয়ে যান তিনি ৷ অবশেষে সকাল 10টা নাগাদ জেলা পুলিশের তরফে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়, দুলাল সরকার খুনের ঘটনায় নরেন্দ্রনাথ তিওয়ারি ও স্বপন শর্মাকে গ্রেফতার করা হয়েছে ৷ ধৃত দু'জনকে এদিনই জেলা আদালতে পেশ করা হয় ৷
জেলা পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, গতকাল রাতে নরেন্দ্রনাথকে শুধু একা নন, এই ঘটনায় আগে ধৃত দুই দুষ্কৃতী অমিত রজক ও শামি আখতারকে মুখোমুখি বসিয়েও জেরা করা হয় ৷ অমিত রজকের পরিবার নরেন্দ্রনাথের পূর্ব পরিচিত ৷ তাঁদের বাড়ি নরেন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত দফতর থেকে মেরেকেটে 50 পা ৷ ফলে অমিত ও তাঁর দাদা কৃষ্ণের সবকিছু তাঁর নখদর্পণে ৷ জেরায় বেরিয়ে আসে স্বপন শর্মার নাম ৷
বাম আমলে মালদার ত্রাস হিসাবে তিনি কুখ্যাত ৷ একাধিক খুনের আসামি ৷ এখন অবশ্য ধর্মকর্ম নিয়ে তাঁকে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় ৷ তাঁকেও থানায় নিয়ে আসা হয় ৷ দীর্ঘ জেরায় একসময় ভেঙে পড়েন নরেন্দ্রনাথ ও স্বপন ৷ এই ঘটনায় নিজেদের যোগের কথা স্বীকার করে নেন ৷ তারপরেই তাঁদের গ্রেফতার করা হয় ৷ কিন্তু পুলিশের একাংশের বদ্ধমূল ধারণা, শুধু এই দু'জনই এই ঘটনায় মূল অভিযুক্ত নন ৷ এই ঘটনার পিছনে আরও মুখ রয়েছে ৷ সেই মুখগুলির মুখোশ খোলার চেষ্টা চালানো হচ্ছে ৷
এদিকে গ্রেফতারির পর শারীরিক পরীক্ষা করানোর জন্য মালদা মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়ার পথে নরেন্দ্রনাথ দাবি করেন, "আমি চক্রান্তের শিকার ৷ বড় মাথার শিকার হলাম ৷ বাবলাও সেই বড় মাথার শিকার হয়েছে, আমিও হলাম ৷" অন্যদিকে স্বপন শর্মা বলেন, "আমি কিছুই জানি না ৷ দোকান থেকে আমাকে তুলে আনা হয়েছে ৷"