কলকাতা, 9 মে: রাজনৈতিক দলের কোনও কর্মসূচি থেকে ভোটের প্রচারে পোস্টার ছাপা, রক্তদান থেকে যাত্রাপালা, মিষ্টির বাক্স থেকে জামা জুতোর বাক্স, শাড়ির খাম- সব ধরনের ছাপার কাজ হত একসময় লিথো মেশিনে । ভোট এলে এত বেশি কাজের চাপ থাকত যে, রাজনৈতিক দলগুলিকে অনেক ক্ষেত্রে সময়মতো তাঁদের অর্ডার ডেলিভারি করা সম্ভব হত না ৷ তবে সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে ধীরে ধীরে অফসেট ও ডিজিটাল প্রিন্টিং-এর যুগে কিছুটা পিছিয়ে পড়ে লিথো মেশিন ৷ বাজারে মন্দা দেখা দেয় ৷ ধুঁকতে শুরু করে এই ব্যবসা ৷ ভোটে একসময়ে দাপিয়ে চলা সেই লিথো মেশিন আজকের লোকসভা ভোটের সময় হাতে গোনা দু-একটি ৷ তবুও সে লড়ে যাচ্ছে ৷ টিম টিম করে হলেও জুতোর বাক্স, মিষ্টির প্যাকেটে প্রিন্ট করে আধুনিকতার সঙ্গে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী লিথো মেশিন ৷
বর্তমানে মুদ্রণ মাধ্যমের সঙ্গে জড়িত অনেক সংস্থার নামের শেষে লিথো লেখা থাকে । তবে সেটা শুধুই ট্রেড লাইসেন্স রক্ষায় । তারা এখন অফসেট প্রিন্টিং করে । উত্তর কলকাতার গরানহাটা এলাকায় এখনও একজনের কাছে এই মেশিন আছে । সেই মুক্ত দাসের তিন পুরুষের ব্যবসা ছিল । এখন ওই যন্ত্র শুধু রাখা আছে । আবেগ, স্মৃতি মিশে আছে বাপ-ঠাকুরদার সেই যন্ত্রে ৷ সেই মেশিনের বয়স প্রায় শতবর্ষ ছুঁইছুঁই । কিন্তু এখনও তা চালু করলে ঝরঝরে ভাবে চলে । ভোটের বাজার মন্দা হলেও নিত্যদিনের বেশকিছু প্রিন্টিং-এর জন্য এখনও ভরসা লিথো মেশিন ৷
লিথো মেশিনের মালিক মুক্ত দাস বলেন, "জার্মান থেকে এই যন্ত্র এনেছিলেন ঠাকুরদা । 90 বছরের পুরনো । জার্মানির মেশিন আজও জং পড়েনি । তিন পুরুষ ধরে খেয়েছি এই মেশিন থেকে ব্যবসা করে । ঠাকুরদাদা কালীপদ দাসের পর বাবা নিরাপদ দাস, তারপর আমি । এই মেশিন চালাতে কমপক্ষে তিনটি লোক লাগে । সেই সব লোক এখন নেই । এই যন্ত্রে এক ঘণ্টায় 1000-1200টি পোস্টার ছাপা হয় । উলটো হরফ লিখে পাথর খোদাই করে প্লেট হত । সেই প্লেট তৈরির লোকের এখন অভাব ।"
তিনি আরও জানান, অল্প টাকায় অল্প কর্মী দিয়ে অফসেটে বেশি প্রিন্টিং সম্ভব, যা লিথোয় হয় না ৷ সেই কারণে মানুষ মুখ ফেরাচ্ছে লিথোর থেকে ৷ তিনি বলেন, "লিথোয় 1000 পোস্টার করতে 800-900 টাকা খরচ। তবে এখন অফসেট মেশিনে একটা লোক রাখলেই হয়। ঘণ্টায় 5000 ছাপা হয় । 1300-1500 টাকা খরচ পড়ে । লিথোয় সময়ের সঙ্গে আধুনিক যন্ত্র আসেনি। ভোট এলে আগে কুলিয়ে পারতাম না, দিনরাত কাজ করতে হত । এখন আর তা হয় না ৷"
প্রিন্টিং ব্যবসায়ী বাবলু সামন্তের কথায়, "লিথো মেশিনে প্রিন্টিং-এর আভিজাত্যই আলাদা ৷ তবে এখন অফসেটে সবাই বেশি ঝুঁকছে ৷ তাই জুতোর বাক্স, মিষ্টির বাক্স, কিংবা রক্তদান শিবিরের পোস্টারে ছাপার কাজ করে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে লিথো ৷"
আরেক লিথো প্রিন্টিং কারবারি দিব্যেন্দু বসু বলছেন, "ভোটের আগে দম ফেলার ফুরসত হত না । সেই ব্যবসার অবস্থা ভালো নেই । আগে 5টা মেশিন ছিল, এখন একটা । এখন ফ্লেক্স, ডিজিটাল চলছে । অফসেট হাইফাই হয়ে গিয়েছে । ফলে ভোটের কাজ সে সব দিয়েই বেশি হয় ৷ এখন লিথোর একটা মেশিনে কখনও রক্তদান, কখনও সম্মেলনের পোস্টার হয় । হয় জুতো ও মিষ্টির বাক্সে ছাপার কাজ ৷"
প্রিন্টিং ব্যবসায়ী বাবলু সামন্ত জানালেন, বিদেশের বাজারে এখনও কদর রয়েছে লিথো মেশিনের ৷ অনেকে তাঁদের কাছ থেকে সেই মেশিন কিনতেও চেয়েছেন ৷ তবে যতদিন সম্ভব ঘরের মেশিন ঘরে রাখারই পক্ষপাতী তাঁরা ৷ অফসেট ও ডিজিটাল প্রিন্টিং-এ লিথো মেশিনের বাজার কমেছে ঠিকই ৷ তবে আজও মুদ্রণে বনেদিয়ানার আর এক নাম লিথো ৷ সেই আভিজাত্যই ধরে রাখায় চেষ্টায় লিথোর কারবারিরা ৷
আরও পড়ুন: