কলকাতা, 26 মে: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, "নীরার অসুখ হলে কলকাতার সবাই বড় দুঃখে থাকে৷" সেই ভাবনা ধার করে বলা যায় উত্তর কলকাতায় কী হচ্ছে, তার দিকে তাকিয়ে থাকে গোটা বাংলা ৷ একসময় মেঘনাদ সাহা বা অশোককুমার সেনের মতো বিশিষ্টদের সংসদের নিম্নকক্ষে পাঠিয়েছে উত্তর কলকাতা ৷ পরে সেই ধারা বয়ে নিয়ে যান অজিত পাঁজা, দেবী প্রসাদ পাল, সুধাংশ শীল এবং মহম্মদ সেলিমরা ৷ তখন অবশ্য উত্তর কলকাতার লোকসভাগুলির নাম আলাদা আলাদা ছিল ৷ 2009 সালে তৈরি হয় কলকাতা উত্তর কেন্দ্রটি ৷ প্রথম থেকে এই কেন্দ্রের সাংসদ বদলায়নি ৷ তৃণমূলের বিদায়ী সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখোমুখি এবার বিজেপির তাপস রায় ও বাম-কংগ্রেসের প্রদীপ ভট্টাচার্য ৷
লোকসভা নির্বাচনের সব খবর পেতে চোখ রাখুন এখানে
এখানে তিন কংগ্রেসির লড়াই ৷ লড়াই তিন পক্বকেশের ৷ লড়াই সংসদে যাওয়ার ৷ তাপস রায় বিজেপিতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত উত্তর কলকাতা নিয়ে তেমন একটা চিন্তিত ছিল না তৃণমূল ৷ তৃণমূলের তিনবারের বিধায়ক ও বেশ কয়েকবারের কাউন্সিলর দল পরিবর্তন করে ঘাসফুল শিবিরের চাপ যেমন বাড়িয়েছেন, তেমনই মনোবল জুগিয়েছেন গেরুয়া শিবিরের ৷ কলকাতার উত্তরাংশে একসময় খান দুয়েক কাউন্সিলর জিতলে যে বিজেপির তৎকালীন শীর্ষ নেতা লালকৃষ্ণ আদবানি অভিনন্দন বার্তা পাঠাতেন, সেই দলই এবার উত্তর কলকাতায় জয়ের আশায় বুক বেঁধেছে ৷
আরও পড়ুন: কোটিপতি কলকাতা উত্তরের তৃণমূল প্রার্থী, স্থাবর সম্পত্তিতে সুদীপকে টেক্কা স্ত্রী নয়নার
এই দু'জনের থেকে বয়সে এবং রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় কিছুটা হলেও প্রবীণ বাম-কংগ্রেসের প্রার্থী প্রদীপ ভট্টাচার্য ৷ ইন্দিরা গান্ধির অভিভাবকত্বে রাজনীতিতে আসা প্রদীপ বাম আমলে পণ করেছিলেন নুন খাবেন না ৷ আমিষ বলতে আনুনি মাছ ভাজা করে দিতেন পেশায় অধ্যাপক-রাজনীতিকের মা ৷ এবার তাঁর পণ তৃণমূল-বিজেপির ভোটব্যাঙ্কে থাবা বসিয়ে বাম-কংগ্রেসের সুদিন ফিরিয়ে আনা ৷
2009 সালে পুনর্বিন্যাসের পর কলকাতার দুই লোকসভা কেন্দ্র উত্তর - পশ্চিম ও উত্তর -পূর্ব যুক্ত হয়ে কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রের উৎপত্তি। উত্তর-পশ্চিমের সাংসদ ছিলেন সিপিএমের সুধাংশু শীল, উত্তর-পূর্বের সাংসদ ছিলেন সিপিএমের মহম্মদ সেলিম। তবে কলকাতা উত্তর কেন্দ্র তৈরি হওয়ার পর সিপিএমের মহম্মদ সেলিমের বিরুদ্ধে তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। সেলিমকে হারান 1 লাখেরও বেশি ভোটে।
সেই থেকে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় হারেননি। 2014 সালে দ্বিতীয় স্থানে থাকা বিজেপি প্রার্থী রাহুল সিনহাকে পরাজিত করেন 96 হাজার 226 ভোটে। সিপিএম চলে যায় তৃতীয় স্থানে। 2019 সালে ফের বিজেপি প্রার্থী রাহুল সিনহাকে পরাজিত করেন তিনি। এবার জয়ের ব্যবধান আরও খানিকটা বাড়ে। সুদীপ জেতেন 1,27,95 ভোটে । 2024 সালে তিনি ফের তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে কলকাতা উত্তরের প্রার্থী।
আরও পড়ুন: জো ডর গ্যায়া... গব্বর সিংয়ের সংলাপকে হাতিয়ার করে তাপসকে তোপ মমতার
পাঁচ বছরে বদলে গিয়েছে প্রেক্ষাপট। আর গোলাপ বিছানো জয়ের পথ নেই। সেই পথে কাঁটা এখন একদা তাঁর সঙ্গী তৃণমূলের প্রাক্তন বিধায়ক তাপস রায়। তিনি চলতি লোকসভার আগেই সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বিরুদ্ধে তোপ দেগে দল ত্যাগ করেন। সবমিলিয়ে রাজনৈতিক মহল মনে করছে সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন লড়াইয়ের সামনে সুদীপ ৷
তাপসকে ঘিরে সাধারণ ভোটারদের পাশাপাশি তৃণমূলের একাংশের মধ্যেও যে আবেগের চোরাস্রোত বইছে তা জানেন দলের শীর্ষ নেতারাও ৷ তাই কাউন্সিলরদের নিয়ে বৈঠকও করেছেন কলকাতার মহানাগরিক ফিরহাদ হাকিম ৷ সেখানে স্পষ্ট বলে দেওয়া হয়েছে, তাপস এখন 'রাজনৈতিক শত্রু' ৷ তাঁকে গোপনে গোপনে সমর্থন করলে তৃণমূল নেতৃত্বের বিরাগভাজন হতে হবে ৷ দল ব্যবস্থাও নিতে পারে ৷
আরও পড়ুন: ভোটের মাঝে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা পেলেন তাপস রায় ও তমোঘ্ন ঘোষ, কিন্তু কেন ?
অঙ্কের হিসেব বলছে, গত লোকসভায় তৃণমূল প্রার্থী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রাপ্ত ভোট ছিল 4,74,891। দ্বিতীয় স্থানে থাকা রাহুল সিনহা পেয়েছিলেন 3 ,47,796 ভোট। তৃতীয় স্থানে থাকা সিপিএম প্রার্থী কনীনিকা ঘোষ বোসের প্রাপ্ত ভোট ছিল 71, 080। মোট 26,093 ভোট পেয়ে চতুর্থ স্থানে ছিলেন কংগ্রেস প্রার্থী সৈয়দ সাহি ইমাম। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় জয়লাভ করেছিলেন 1,27,095 ভোটে। তবে 20টি ওয়ার্ডে এগিয়ে ছিল বিজেপি।
এই লোকসভার অন্তর্গত 7টি বিধানসভা। চৌরঙ্গি, এন্টালি, বেলেঘাটা, জোড়াসাঁকো, শ্যাম পুকুর, মানিকতলা, কাশিপুর বেলগাছিয়ার প্রত্যেকটি অবশ্য তৃণমূলের হাতে। 2021 সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের বিচারে চৌরঙ্গি থেকে 45,394 ভোট জিতেছিল তৃণমূল বিয়ায়ক নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়। এন্টালি থেকে 58,257 ভোটে জেতেন তৃণমূলের বিধায়ক স্বর্ণকমল সাহা। বেলেঘাটা কেন্দ্রে 67,140 ভোট জেতেন পরেশ পাল। জোড়াসাঁকো কেন্দ্রে 12,743 ভোটে জেতেন তৃণমূলের বিবেক গুপ্তা। শ্যামপুকুর কেন্দ্রে 22,520 ভোটে জেতেন শশী পাঁজা। মানিকতলা কেন্দ্রে 20,238 ভোটে জয়লাভ করেছিলেন প্রয়াত বিধায়ক তৃণমূলের সাধন পাণ্ডে। কাশিপুর-বেলগাছিয়া কেন্দ্রে 35,390 ভোট জেতেন অতীন ঘোষ।
প্রতিটি বিধানসভায় দ্বিতীয় স্থানে ছিল বিজেপি। কিন্তু দু'বছরে কমবেশি সব কেন্দ্রেই বিজেপির শক্তি বেড়েছে। তবে ব্যক্তি সুদীপের ক্যারিশমাও তৃণমূলের পুঁজি ৷ এরই মধ্যে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির প্রদীপ কোন পক্ষের ভোটে থাবা বসাবেন, সেটাই নির্ণায়ক ভূমিকা নিতে পারে উত্তর কলকাতায় ৷ সব ধাঁধার জবাব পেতে অপেক্ষা করতে হবে আগামী 4 জুন পর্যন্ত।
আরও পড়ুন: ইডি-সিবিআইয়ের ভয়ে দল বদলেছেন তাপস, তোপ মমতার