কলকাতা, 23 ডিসেম্বর: দক্ষিণ কলকাতার ফুসফুস রবীন্দ্র সরোবর । শতবর্ষ পুরনো এই সরোবররক্ষায় প্রথমবার হবে জলাশয় থেকে পলি নিষ্কাশনের কাজ ৷ এমনটাই খবর পাওয়া যাচ্ছে কলকাতা মেট্রোপলিটন ডেভলপমেন্ট অথরিটি (কেএমডিএ) সূত্রে ৷
কেএমডিএ-র তরফে জানা গিয়েছে, তথ্য ভাণ্ডার তৈরির স্বার্থে ইতিমধ্যে রবীন্দ্র সরোবরের খুঁটিনাটি পরীক্ষা শুরু হয়েছে । সেই কাজ শেষেই শুরু হবে এই হ্রদের পুনরুজ্জীবনের কাজ । রবীন্দ্র সরোবরে হাল ফেরানোর কেএমডিএ-র এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা ।
পরিবেশ বিজ্ঞানী স্বাতী নন্দী চক্রবর্তী বলেন, "অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ । সরোবর রক্ষা করতে দ্রুততার সঙ্গেই পলি নিষ্কাশন প্রয়োজন । সরোবর বাঁচলে সেখানকার বাস্তুতন্ত্র বাঁচলে পরিবেশ রক্ষা পাবে । তার ইতিবাচক ফল পাবেন দক্ষিণের অসংখ্য মানুষ । সাম্প্রতিক সময় ঝাঁকে ঝাঁকে মাছের মৃত্যু ভাবাচ্ছে । সেটাও হবে না । তবে শুধু পলি তোলা হলেই কাজ শেষ এমন নয়, কেএমডিএকে নিয়মমাফিক জলের গুণমান, গভীরতা, অক্সিজেন মাত্রা-সহ সমস্ত পরীক্ষা ও নজরদারি করে যেতে হবে ।"
তবে সরোবর প্রেমী ও প্রাতঃভ্রমণকারীদের দাবি, পলি নিষ্কাশনের কাজ নিয়ে দুই বছর ধরে টালবাহানা চলছে ৷ কাজ শুরু না-হলে বিশ্বাস নেই ৷ প্রাতঃভ্রমণকারী বা পরিবেশবিদ সোমেন্দ্রমোহন ঘোষের কথায়, "লেকের জন্ম থেকে শতবর্ষ কেটে গেলেও পলি নিষ্কাশন হয়নি । খুবই প্রয়োজন । সেই কাজ এত দিনে করে ফেলা উচিত ছিল । কেন কেএমডিএ গড়িমসি করছে জানা নেই । পদক্ষেপ নিক আগে কাজ করুক তবেই সাধুবাদ জানাব ।"
কেএমডিএ সূত্রে খবর, সরোবরের তথ্য হাতে পেলেই জাতীয় পরিবেশ আদালতের কাছে মেকানিকাল ড্রেজিং করার জন্য আর্জি করা হবে । শতবর্ষের বেশি বয়স রবীন্দ্র সরোবরের । তবে অবাক করার বিষয় হল জলাশয়ের আশপাশে লোকজন দিয়ে অল্প বিস্তর পলি কেটে তোলা হয় ৷ কিন্তু 72 একর প্রশস্ত সরোবর সার্বিকভাবে পলি উত্তোলন করে জলাশয় সতেজ করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি কখনও ।
স্থানীয়দের দাবি, বছরের পর বছর পাঁক জমেছে সরোবরে । গভীরতা কমার সঙ্গেই পাঁক ও শ্যাওলা স্তরে নানা বিষাক্ত গ্যাস উৎপন্ন হচ্ছে । জলে অক্সিজেনের মাত্রা কমছে অনেক ক্ষেত্রে । কলিফর্ম দেখা মিলছে । অর্থাৎ শতাব্দী প্রাচীন লেক ক্রমশ রোগগ্রস্ত হয়ে মৃত্যুর মুখে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে । আর এর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে বিরাট সরোবরের জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতে ।
শুধু তাই নয়, এর প্রভাব সার্বিকভাবে সরোবরের বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে । এর জেরে দূষণের লাল চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কলকাতায় পরিবেশ বিপর্যস্ত হবে দক্ষিণ অংশের ফুসফুসের । কিন্তু এই সমস্ত বিপদ জেনেও বড় ধরনের কাজ করতে পারছে না কলকাতা মেট্রোপলিটন ডেভলপমেন্ট অথরিটি ।
কেএমডিএ সূত্রে খবর, এই কাজ করতে গিয়ে তাদের প্রথম ও প্রধান অন্তরায় হল এই সরোবরের নির্দিষ্টভাবে কোনও তথ্যই তাদের হাতে নেই । অর্থাৎ সরোবরের জলের গভীরতা কতটা ছিল এখনই বা কতটা? কোন কোন অংশে কতটা দূষিত হয়েছে জল? কোনও বিষাক্ত গ্যাস আছে কি না? জমে থাকা পলি ও শ্যাওলার কোনও স্তরে কোনও রাসায়নিক বিক্রিয়া হচ্ছে কি না, যার জেরে জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর ক্ষতি হচ্ছে কি না, তার কিছুই তথ্য সঠিকভাবে নেই কেএমডিএ'র কাছে ।
কেএমডিএ'র অনুমান, একটা সময় রবীন্দ্র সরোবরের মাঝ অংশের গভীরতা 30-40 ফুটের বেশি ছিল, যা পলি পড়তে পড়তে এখন 12-15 ফুটে কমে এসে দাঁড়িয়েছে । এই পরিস্থিতিতে সরোবর রক্ষার দায়িত্বে থাকা কেএমডিএ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আগে সরোবরের সমস্ত তথ্য নিয়ে একটি তথ্য ভাণ্ডার তৈরি করা হবে । সেই লক্ষ্যে জলের বিভিন্ন ধরনের মান পরীক্ষা করেছে কেএমডিএ । তবে বাকি সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য পরিকাঠামো নেই কেএমডিএ কর্তৃপক্ষের ৷ যার ফলে তারা রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহায্য নিচ্ছে । চলতি মাসেই বাকি পরীক্ষাগুলির জন্য নমুনা সংগ্রহের কাজ শেষ হবে বলেই জানা গিয়েছে ।
এই প্রসঙ্গে এক কেএমডিএ আধিকারিক বলেন, "আমরা এই তথ্য হাতে পেলে বুঝতে পারব ড্রেজিং করার প্রয়োজনীয়তা । সেই মতো জাতীয় পরিবেশ আদালতকে অনুমতি নিতে পারব । মেকানিকাল ড্রেজিং করার দরকার আছে । এর জেরে সামান্য হলেও লেকের জলজ পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলেই আশঙ্কা । দূষণ সৃষ্টি করে এমন যন্ত্র জলে নামানো নিষেধ আছে । তাই পরিবেশ আদালত অনুমতি দিলেই, মেকানিকাল ড্রেজিং করা হবে । প্রতিবছর লেকের সীমানা ধরে সামান্য পলি তোলা হয় । তবে সার্বিকভাবে গভীরে পলি তোলা কখনোই হয়নি । এবার সেই পদক্ষেপ করা হবে ।"
এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সরোবর প্রেমী সুমিতা চক্রবর্তী বলেন, "পরিবেশ আদালত অনেক দিন আগেই বলেছে ভালো করে পলি নিষ্কাশন করাতে । লেক রক্ষার দায়িত্ব কেএমডিএ-র । তারা এই কাজ করলে আদালত খুশি হবে । তারা আবার কেন অনুমতি নেবে? বরং তারা এই কাজ ঝুলিতে রেখেছে আদালতে দাবি করেছিল খনন কাজ হলে লেক শুকিয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কায় ।"
উল্লেখ্য, জল দূষণ মুক্ত করতে সাময়িকভাবে বিশেষ রাসায়নিক স্প্রে করা হয়েছে গোটা রবীন্দ্র সরোবরে । একাধিক ফোয়ারা চালানো হচ্ছে ৷ যাতে জলে অভ্যন্তরীণ অক্সিজেনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায় ।