জয়দেব (বীরভূম), 13 জানুয়ারি: মাসকয়েক আগেই দু’জনে একে অপরের চরম ‘বিরোধী’ ছিলেন ৷ এমনকি বীরভূম জেলা কোর কমিটির বৈঠকেও যেন কেষ্ট-কাজল দুই শিবির ছিল ৷ মাস দু’য়েকের মধ্যেই ছবিটা আমূল বদলে গেল ৷ সোমবার 400 বছরের প্রাচীন জয়দেব মেলার উদ্বোধনে সেই কেষ্ট-কাজল একে অপরের কাছাকাছি এলেন ৷ শুধু কাছাকাছি নয়, মঞ্চে অনুব্রত মণ্ডলের পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে দেখা গেল ফায়জুল হক ওরফে কাজল শেখকে ৷
আর এই দৃশ্যই এখন রাজনৈতিকমহলে আলোচ্য বিষয় ৷ তাহলে বীরভূমের রাজনীতিতে তৃণমূলের যে অন্তর্দ্বন্দ্বের অভিযোগ রয়েছে, তা কি পুরোপুরি মিটে গেল ? আরও স্পষ্ট করে বললে, তৃণমূলের অনুব্রত মণ্ডল এবং কাজল শেখের মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের অবসান হল ! সত্যিই তা হল, নাকি পুরোটাই লোক দেখানো, তা সময় বলবে ৷
এ দিন 400 বছরের প্রাচীন জয়দেব মেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অনুব্রত, কাজল ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের কারামন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিনহা ৷ হ্যাঁ সেই চন্দ্রনাথ, যাঁকে অনুব্রত জেল থেকে ফেরার পর নিজের বাড়ির দরজা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন সংবাদ মাধ্যমের উপস্থিতিতে ৷ আর আজ দু’জনকে হাতেহাত রেখে জয়দেব মেলার উদ্বোধনে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করতে দেখা গেল ৷ এই সবের রাজনৈতিক কোনও ব্যাখ্যা আছে কি না, তা অবশ্য সময় এলেই জানা যাবে ৷
তবে, রাজ্য গ্রামোন্নয়ন পর্ষদের সভাপতি হিসাবে বীরভূমের ঐতিহ্যবাহী জয়দেব মেলার উদ্বোধন করলেন অনুব্রত মণ্ডল ৷ কবি জয়দেবের স্মৃতিবিজড়িত এই মেলা 'আউল-বাউলের মেলা' নামেও পরিচিত ৷ মকরসংক্রান্তির দিন অজয় নদের জলে পুণ্যস্নান সেরে রাধা-বিনোদের মন্দিরে পুজো দেওয়ার রীতি রয়েছে ৷ লক্ষ-লক্ষ ভক্ত-বাউল-ফকিরের সমাগম হয় এই মেলায় ৷
1683 সালে বর্ধমানের রাজা কীর্তিচন্দ্র বীরভূমের অজয় নদের তীরে রাধা-বিনোদের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ৷ এই স্থানটির সঙ্গে কবি জয়দেবের নাম জড়িয়ে রয়েছে ৷ 400 বছরের প্রাচীন এই মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার শিল্পের মাধ্যমে বর্ণিত রয়েছে বহু পৌরাণিক কাহিনি ৷ রয়েছে নানান দেবদেবীর মূর্তি ৷ এই জয়দেব মেলা মূলত বাউল-ফকিরের মেলা হিসাবে পরিচিত ৷
এবার আবহাওয়া ভালো থাকায় অন্যান্যবারের তুলনায় 20 শতাংশ বেশি পুণ্যার্থী সমাগমের আশা করছে প্রশাসন ৷ তাই এই প্রথম ঐতিহ্যবাহী জয়দেব মেলাকে শিশুবান্ধব মেলা করা হয়েছে ৷ শিশুদের সুরক্ষার জন্য তাদের হাতে বেল্ট লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে ৷ সেখানে নাম ও ফোন নম্বর লেখা থাকছে ৷ অনুব্রত মণ্ডল ছাড়াও উদ্বোধনে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের কারামন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিনহা, বীরভূম জেলা পরিষদের সভাধিপতি ফায়জুল হক ওরফে কাজল শেখ, জেলাশাসক বিধান রায়, বোলপুরের সাংসদ অসিত মাল, সিউড়ির বিধায়ক বিকাশ রায়চৌধুরী-সহ অন্যান্যরা ৷
জেলা পুলিশ ও প্রশাসনের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এবার জয়দেব মেলায় 88টি স্থায়ী আখড়া রয়েছে ৷ এছাড়া প্রায় 250টি অস্থায়ী আখড়া গড়ে উঠেছে ৷ 600টি স্টল এসেছে ৷ অজয়ের জলে পুণ্যস্নান সারার জন্য ছ’টি ঘাট তৈরি করা হয়েছে ৷ ঘাটের কাছে মহিলাদের পোশাক বদলের জন্য প্রায় তিরিশটি ঘর থাকছে ৷
দশটি বিপর্যয় মোকাবিলা দল থাকছে ৷ যেকোনও পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য দু’টি বোট সর্বক্ষণ স্নানের ঘাটে মোতায়েন থাকছে ৷ তাছাড়া, দু’শোর বেশি অস্থায়ী শৌচাগার তৈরি করা হয়েছে ৷ যদিও, এবার বীরভূম জেলা পরিষদ ও ইলামবাজার পঞ্চায়েত সমিতির টাকায় একশোর বেশি স্থায়ী শৌচালয় নির্মিত হয়েছে ৷ পর্যাপ্ত পানীয় জলের জন্য ট্যাঙ্কের ব্যবস্থাও থাকছে ৷
এছাড়া, নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ও সিভিক ভলান্টিয়ার মিলিয়ে 2700 কর্মী মোতায়েন থাকছে ৷ তারমধ্যে প্রায় 900 জন পুরুষ ও 230 জন মহিলা পুলিশ ৷ আর 1600 সিভিক ভলেন্টিয়ার ৷ থাকছে স্নানের ঘাট-সহ বিভিন্ন জায়গায় 16টি ওয়াচ টাওয়ার ৷ প্রায় 180টি সিসিটিভি ক্যামেরা থাকছে মেলা প্রাঙ্গণ, আখড়া, স্নানের ঘাটের রাস্তা প্রভৃতি জায়গায় ৷ 23টি ড্রপ গেট, 8টি পার্কিং জোন থাকছে ৷ এমনকি, 3টি ড্রোন ক্যামেরার মধ্যমেও নজরদারি চালানো হবে ৷
মেলা প্রাঙ্গণে জরুরি পরিষেবার জন্য 5টি মেডিক্যাল টিম ও 5টি অ্যাম্বুলেন্স থাকবে ৷ মেলাজুড়ে থাকছে পুলিশ অ্যাসিস্ট্যান্ট বুথ, হেল্প সেন্টার, কুইক রেসপন্স টিম এবং 20 জনে মহিলা র্যাফের একটি দল ৷