কলকাতা, 25 সেপ্টেম্বর: আরও একটি দুর্গাপুজোর দোরগোড়ায় বাংলা । তবে এবারের দুর্গাপুজো অন্যান্য বারের থেকে অনেকটাই আলাদা ৷ কারণ গত 9 অগস্ট কলকাতায় ঘটে গিয়েছে চিকিৎসক ছাত্রীকে ধর্ষণ ও খুনের মতো নারকীয় ঘটনা ৷ আরজি করের ঘটনা শুধু রাজ্য বা দেশকে নয়, নাড়িয়ে দিয়েছে সারা বিশ্বকে । তাই অনেক আন্তর্জাতিক পর্যটক টিকিট বাতিল করে দিচ্ছেন । আরজি কর-কাণ্ডের জেরে বিদেশি পর্যটকরা কলকাতায় আসতে ভয় পাচ্ছেন ৷ তাঁরা সুরক্ষিত মনে করছেন না কলকাতাকে ৷ এর ফলে বাংলার সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপুজোয় লোকসানের মুখে পড়তে চলেছে পর্যটন শিল্প ।
পর্তুগালবাসী রুথ বলেন, "শারদোৎসবের সময় কলকাতায় আসার ইচ্ছে থাকলেও বর্তমান পরিস্থিতি দেখে আমি কিছুটা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি ৷ আরজি করের ঘটনায় প্রতিবাদ চলছে ৷ তাই ইচ্ছা থাকলেও আমি এই বছর কলকাতায় আসা নিরাপদ বলে মনে করছি না ।"
দুর্গাপুজো দেখার একমাত্র ডেস্টিনেশন যদি বলতে হয়, তবে তা হল পশ্চিমবঙ্গ । আর এই উৎসব দেখতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা আসেন এই রাজ্যে । 2021 সালের ডিসেম্বর মাসে ইউনেস্কোর 'ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ'-এর তালিকায় স্থান করে নিয়েছে বাংলার দুর্গোৎসব । এর ফলে বাংলার দুর্গাপুজো আনুষ্ঠানিকভাবে পৌঁছে যায় বিশ্ব দরবারে ।
জানা গিয়েছে, ইউনেস্কোর স্বীকৃতি মেলায় আন্তর্জাতিক বাজারে এক ধাক্কায় দুর্গাপুজোর বাণিজ্যিকীকরণ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে ৷ তেমনই ভারতের সঙ্গে অন্যান্য দেশের সাংস্কৃতিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে । বরাবরই বাংলার দুর্গাপুজোর সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রভাব প্রবল । তার উপর এই স্বীকৃতি বাংলার শারদ উৎসবকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা দিয়েছে । স্বাভাবিকভাবেই বাংলার দুর্গাপুজো যে আন্তর্জাতিক পর্যটকদের উইশ লিস্টে থাকবে সেটা অনুমেয় ।
তবে এই বছরে ছবিটা একেবারেই অন্যরকম । আরজি কর-কাণ্ডের সুবিচারের দাবিতে আন্দোলন চলছে রাজ্যজুড়ে ৷ বেশিরভাগ প্রতিবাদী মানুষ উৎসবে না-ফেরার স্লোগান তুলেছেন ৷ অন্যান্য বছরের মতো এবার দুর্গাপুজোর আড়ম্বর নেই । বেশিরভাগ বারোয়ারী পুজো এবং বাড়ির পুজোর উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, কোনও রকম উৎসব নয়, বরং মায়ের আরাধনা হবে শুধুমাত্র নিয়ম মেনেই । রঙিন এবং আড়ম্বরযুক্ত দুর্গাপুজো এবার হয়তো হবে হাতে গোনা ৷
আর এই ঘটনার জেরে বিদেশি পর্যটকদের অনেকেই এবার কলকাতার পুজো দেখতে আসতে নারাজ ৷ ফরাসি পর্যটক জুলিয়া এর আগে তিনবার কলকাতার দুর্গাপুজোয় সামিল হয়েছেন ৷ কিন্তু তাঁর এ বছরে শহরে আসার কথা থাকলেও তিনি তা বাতিল করে দিয়েছেন । আর তিনি এটি করেছেন বর্তমান পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে ৷
কানাডাবাসী মার্টিন এই বছর তাঁর ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে একেবারে সপরিবারে দুর্গাপুজো দেখতে আসবেন বলে অনেক আগে থেকেই পরিকল্পনা করেছিলেন ৷ তিনি একেবারে শেষ মুহূর্তে টিকিট বাতিল করেছেন । মার্টিন বলেন, "কলকাতার বর্তমান পরিস্থিতি বিচার করেই এই বছর একজন আন্তর্জাতিক পর্যটক হিসেবে নিজের পরিবারকে বাংলায় আনতে তেমন একটা ভরসা পাচ্ছি না । বাংলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হলে তবেই আমি আবার এখানে আসতে ভরসা পাব ।" স্পেনের দম্পতি হোসে ও সোনিয়া জানিয়েছেন, তাঁরা এর আগেও কলকাতায় দুর্গাপুজোয় ঘুরে গিয়েছেন । তবে আরজি কর আবহে কলকাতায় আসতে ভরসা পাচ্ছেন না তাঁরাও ।
কলকাতার এক পর্যটন সংস্থার কর্ণধার জয়দীপ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, "বিদেশিদের মধ্যে কলকাতার দুর্গাপুজো দেখার একটা বিশেষ ঝোঁক থাকে । দুর্গাপুজোকে ঘিরে পর্যটন শিল্পের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকেন বিদেশি পর্যটকরা । তবে এই বছর আরজি করের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিদেশি পর্যটকদের একাংশ এই রাজ্যে আসতে তেমন নিরাপদ বোধ করছেন না । তাই অনেক বুকিং বাতিল হয়েছে । শুধু তাই নয়, দুর্গাপুজোকে ঘিরে সারা বছর বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় নানা রকম অনুষ্ঠান হয় । সম্প্রতি আমেরিকায় সেই ধরনের তিনটি অনুষ্ঠান বাতিল হয়েছে ।"
দুর্গাপুজোকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার জন্য সারা বছর বিভিন্ন দেশে পর্যটনকেন্দ্রিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয় ৷ সেখানে বাংলার দুর্গাপুজো যে মাতৃশক্তির আরাধানা, সেই ভাবনা তুলে ধরা হয় । আর যেই রাজ্যে এত ঘটা করে মাতৃশক্তির আরাধনা হয়, সেই রাজ্যেই একজন মহিলার উপর এহেন ন্যক্কারজনক ঘটনা বিদেশি পর্যটকদেরও কোথাও যেন বেশ কিছুটা নাড়া দিয়েছে ।
সূত্রের খবর, কানাডা, নর্থ আমেরিকা-সহ আরও কয়েকটি রাষ্ট্রে প্রতিটি দেশি ও বিদেশি পর্যটন সংস্থাকে 'কনজিউমার প্রোটেকশন লাইসেন্স' চড়া টাকা দিয়ে পেতে হয় । মূলত ওই দেশগুলি থেকে পর্যটকরা সংস্থার অধীনে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে গিয়ে যদি কোনও সমস্যার সম্মুখীন হন তাহলে এই লাইসেন্সের নিয়ম অনুসারে, পুরো দায়ভার বর্তাবে সংশ্লিষ্ট পর্যটন সংস্থার উপরেই ।
বিদেশে ভারতীয় পর্যটন সংস্থার আধিকারিক সগুনা মুখোপাধ্যায় জানান, সম্প্রতি 30 জনের একটি আন্তর্জাতিক পর্যটকদের দলের বাংলার দুর্গাপুজো দেখতে যাওয়ার কথা ছিল ৷ তাঁরা তাঁদের সফর বাতিল করেছেন । আন্তর্জাতিক পর্যটকরা অনেকেই মনে করছেন, তাঁরা অর্থ দিয়ে দুর্গাপুজো দেখতে যেতে চান এবং কয়েকটা দিন আনন্দ করতে চান, কিন্তু তার বদলে যদি তাঁদের কোনও সমস্যায় পড়তে হয় । তাই তাঁরা কলকাতায় আসতে চাইছেন না এখন ৷
এই বিষয়ে পর্যটন মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেনের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি । তবে পরিবহণমন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী বলেন, "অন্যান্য শহরের তুলনায় কলকাতা অন্যতম নিরাপদ শহর । সমীক্ষাতেই এটা উঠে এসেছে । এমনকি মহিলা নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও বাংলা এগিয়ে । যে ঘটনা ঘটে গিয়েছে তা প্রতিদিন ভারতে প্রতি 15 মিনিটে ঘটে যাচ্ছে । কারণ এটা একটা সামাজিক ব্যাধি ৷ এটাকে দূর করতে হলে সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং সবাইকে সচেতন করতে হবে । আসলে কিছু মানুষ বাংলাকে ছোট করার চেষ্টায় বদনাম করছে ।"