মালদা, 2 সেপ্টেম্বর: চারদিকে জল ৷ মানুষে ভর্তি ত্রাণ শিবিরগুলি ৷ একই পরিস্থিতি ভূতনির উত্তর চণ্ডীপুর বিপি হাইস্কুলের শিবিরেও ৷ গোপনীয়তা রক্ষার কোনও উপায় নেই ৷ সেই শিবিরেই হঠাৎ সদ্যোজাতের কান্না ৷ নাড়ি কাটা হল প্রসূতির ৷ এক লহমায় গোটা শিবির জুড়ে আনন্দের ঢেউ খেলে গেল ৷ সবাই বলছে, মেয়ে হয়েছে, ফুটফুটে মেয়ে ৷ কিন্তু কী নাম রাখা হবে মেয়ের ? শিবিরে উপস্থিত সবার একটাই দাবি, গঙ্গার বানে চোখ খুলেছে মেয়ে ৷ এর নাম হবে 'বন্যা' ৷ সেই দাবি মেনে নিয়েছেন মা মর্জিনা ৷ এই মুহূর্তে মানিকচক গ্রামীণ হাসপাতালে বেশ রয়েছে মা-মেয়ে ৷ প্রতিদিন পরীক্ষা করছেন চিকিৎসকরা ৷
মর্জিনার কথায়, "প্রথমবার সন্তানের জন্ম দেব ৷ অনেকদিন আগে থেকেই অনেক স্বপ্নের জাল বুনেছি ৷ কিন্তু বাঁধ ভেঙে সব স্বপ্নের দফারফা হয়ে গেল ৷ তবে শিবিরের সবাই যেভাবে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে, কখনও ভুলব না ৷ একটা সময় মনে হয়েছিল, যন্ত্রণায় মরেই যাব ৷ কিন্তু ওরাই আমাকে বাঁচিয়েছে, আমার মেয়েকে বাঁচিয়ে রেখেছে ৷ এখন দু'জনেই সুস্থ আছি ৷ শিবিরের সবাই চেয়েছিল, মেয়ের নাম বন্যা রাখি ৷ যাদের জন্য মেয়ে আলো দেখল, তাদের কথা ফেলি কী করে ! মেয়ে বন্যা নামেই পরিচিত হোক ৷"
যেদিন কেশরপুর বাঁধ ভেঙেছিল, তার পরদিনই বানভাসি হয়েছিলেন চম্পানগরের বাসিন্দারা ৷ যে যেখানে পারে আশ্রয় নেয় ৷ পরিবারের সবার সঙ্গে মর্জিনাও উঠে গিয়েছিলেন গঙ্গার বাঁধে ৷ মাত্র দু'বছর বিয়ে হয়েছে তাঁর ৷ স্বামী সেলিম শেখও ভাবছিলেন, প্রথমবার অন্তঃসত্ত্বা মর্জিনাকে বাঁধে রাখা ঠিক হবে কি না ৷ তিনি নিজে বিশেষভাবে সক্ষম ৷ চোখে দেখেন না ৷ রাতবিরেতে হঠাৎ স্ত্রীর প্রসব যন্ত্রণা উঠলে কী করবেন ! সেলিম ভাবনার বিষয়টি জানান শ্বশুরবাড়িতে ৷ পরদিন বাঁধে উপস্থিত হন শাশুড়ি জোনাকি বিবি ৷ মেয়েকে নিয়ে যান নিজের বাড়ি সামিরুদ্দিনটোলায় ৷ তখনও সেখানে বানের জল ঢোকেনি ৷
সবাই ভেবেছিল, সেচ দফতর দ্রুত বাঁধের ভাঙা অংশ মেরামত করে দেবে ৷ তা হয়নি ৷ দিন তিনেক পর জল ঢুকল সামিরুদ্দিনটোলাতেও ৷ অন্তঃসত্ত্বা মেয়েকে নিয়ে উত্তর চণ্ডীপুর বিপি হাইস্কুলের শিবিরে আশ্রয় নিলেন জোনাকি বিবি ৷ তখনও যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রয়েছে ৷ তাই পরদিনই মেয়েকে নিয়ে যান মানিকচকে ৷ চিকিৎসক আশ্বাস দেন, ভয় নেই, সন্তানের জন্ম নিতে আরও মাসখানেক সময় লাগবে ৷ চিকিৎসকের কথায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন জোনাকি, স্বস্তি পান মর্জিনাও ৷
কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক ৷ গত রবিবার সন্ধেয় হঠাৎ তীব্র প্রসব বেদনা শুরু হয় মর্জিনার ৷ যত সময় গড়ায়, যন্ত্রণা তীব্রতর হয় ৷ কিন্তু বানভাসি এলাকায় রাতে কোনও অন্তঃসত্ত্বাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টার ভাবনা বাতুলতা মাত্র ৷ এগিয়ে আসেন ওই শিবিরে থাকা মহিলারা ৷ সবার চেষ্টায় ত্রাণ শিবিরেই মেয়ের জন্ম দেন মর্জিনা ৷ রাত কেটে যায় ভালোয় ভালোয় ৷ ভোরের আলো ফুটলে সবার চোখেই যুদ্ধজয়ের আনন্দ ৷
সোমবার এই খবর যায় ভূতনি থানার ওসি পবিত্র মাহাতোর কানে ৷ দেরি করেননি তিনি ৷ দুপুরেই নৌকায় চাপিয়ে সদ্যোজাত-সহ মর্জিনাকে নিয়ে আসেন মানিকচক গ্রামীণ হাসপাতালে ৷ এখনও সেখানেই রয়েছেন তাঁরা ৷ দু'জনেই সুস্থ ৷ নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছেন চিকিৎসকরা ৷ মানিকচক ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক অভীকশংকর কুমার বলেন, "এই মুহূর্তে মা ও মেয়ের ত্রাণ শিবিরে ফিরে যাওয়া ঠিক হবে না ৷ সেখানে সংক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে ৷ তাই দু'জনকে হাসপাতালেই রাখা হয়েছে ৷"