মালদা, 23 ডিসেম্বর: টাকার জন্য মেয়েকে অপহরণ করার অভিযোগে গ্রেফতার বাল্যবন্ধুরা ৷ হরিশ্চন্দ্রপুরের ঘটনায় হতবাক নাবালিকার বাবা ৷ এ যেন খাল কেটে কুমির আনার মতো ঘটনা ৷
বাল্যবন্ধুরাই যে মেয়েকে অপহরণের ছক কষেছে, তা কোনোভাবেই আগে অনুমান করতে পারেননি ওই নাবালিকার বাবা ৷ একই অবস্থা মায়েরও ৷ যাদের বাড়িতে ডেকে নিজের হাতে রান্না করে খাইয়েছেন, তাঁরা যে এমন ছক সাজাতে পারে, কল্পনায় আসেনি তাঁরও ৷ অথচ সেটাই ঘটেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ ৷
এই ঘটনা প্রশ্ন তুলে দিয়েছে, এমন হলে মানুষ কি মানুষের উপর বিশ্বাস রাখতে পারবে? এই ঘটনার তদন্তে যেন কোনোভাবেই রাজনীতি না ঢুকে পড়ে, তার জন্য পুলিশ প্রশাসনের কাছে আর্জি জানিয়েছেন নাবালিকার বাবা ৷
উত্তর দিনাজপুর থেকে পাকড়াও অপহরণকারীদের
শনিবার হরিশ্চন্দ্রপুরের সালালপুর থেকে অপহৃত হয় সাত বছরের শিশু ৷ ঘণ্টা ছয়েক পর তাকে উত্তর দিনাজপুরের টুঙ্গিদিঘি এলাকায় 12 নম্বর জাতীয় সড়ক থেকে উদ্ধার করে করণদিঘি থানার পুলিশ ৷ ধরে ফেলা হয় দুই অপহরণকারীকেও ৷ তাদের হেফাজত থেকে উদ্ধার হয় একটি আগ্নেয়াস্ত্র, কার্তুজ, ক্লোরোফর্ম ও মুখ বাঁধার টেপ ৷
সেদিন সন্ধেতেই তিনজনকে হরিশ্চন্দ্রপুর থানার পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয় ৷ পুলিশের তরফে নাবালিকাকে তুলে দেওয়া হয় মায়ের কোলে ৷ রবিবার ধৃত দুই অপহরণকারীকে 14 দিনের পুলিশি হেফাজতের আবেদন জানিয়ে চাঁচল মহকুমা আদালতে পেশ করা হয় ৷ তবে বিচারক 12 দিনের জন্য হেফাজত মঞ্জুর করেছেন ৷ ইতিমধ্যে ধৃত ইজাজ আহমেদ ও মনসুর আলম শেখকে দফায় দফায় জেরা করতে শুরু করে দিয়েছে হরিশ্চন্দ্রপুর থানার পুলিশ ৷
ধৃতরা শিশুর বাবার বাল্যবন্ধু
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ইজাজ আর মঞ্জুর, দু'জনেই শিশুর বাবার বাল্যবন্ধু ৷ তিনজনে একসঙ্গে, একই স্কুলে পড়াশোনা করতেন ৷ ইজাজ পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিলেন ৷ ইজাজ কলকাতায় ফার্মাসির উপর ডিপ্লোমা করেছেন ৷ স্থানীয় তুলসিহাটা এলাকায় তাঁর ওষুধের দোকানও রয়েছে ৷ ভালো পরিবারের ছেলে ৷ বাবা প্রাথমিক শিক্ষক ৷ স্ত্রী স্বাস্থ্য দফতরের কর্মী ৷
ওদিকে মনসুর হরিশ্চন্দ্রপুর 1 নম্বর ব্লক ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরে মুহুরির কাজ করে ৷ একইসঙ্গে জমির ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত ৷ দু'জনেরই বাড়ি হরিশ্চন্দ্রপুরের গাংনদিয়া গ্রামে ৷ বাল্যবন্ধু হওয়ার সুবাদে তারা মাঝেমধ্যেই পাশের গ্রাম, সালালপুরে অপহৃত নাবালিকার বাড়িতে যেতেন ৷ ওই বাড়ির অন্দরমহল পর্যন্ত তাঁদের ছিল অবাধ যাতায়াত ৷
শপিং মল খুলতে বাল্যবন্ধুর মেয়েকে অপহরণ
এরপরেও ইজাজ আর মনসুর বাল্যবন্ধুর মেয়েকে অপহরণ করলেন কেন? পুলিশি জেরায় তাঁরা নাকি দাবি করেছে, তাঁরা তুলসিহাটায় একটি বড় শপিং মল খোলার পরিকল্পনা করেছিলেন ৷ তার জন্য বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণের আবেদন করেছিলেন ৷ কিন্তু কোনও ব্যাংকই তাঁদের ঋণ দিতে রাজি হয়নি ৷
এদিকে সাত বছরের শিশুর বাবা ও তাঁদের বন্ধু ওই ব্যক্তি কোটিপতি ব্যবসায়ী ৷ অনেক চিন্তাভাবনা করে তারা তাই বন্ধুর মেয়েকেই অপহরণ করার ছক কষেন ৷ মুক্তিপণের টাকায় তাঁরা সেই শপিং মল খোলার পরিকল্পনা করেন ৷ শনিবার সেই মতো শিশুটিকে বাইকে তুলে তাঁরা প্রথমে বিহারে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন ৷ কিন্তু পুলিশ তড়িঘড়ি বাংলা-বিহার সীমান্ত সিল করে দেওয়ায় সমস্যায় পড়ে যান তাঁরা ৷ তাই তাঁরা ডালখোলা হয়ে বিহারে ঢোকার পরিকল্পনা করেন ৷ কিন্তু তার আগেই টুঙ্গিদিঘিতে পুলিশের জালে ধরা পড়ে যান ৷
অপহৃত শিশুর বাবার বক্তব্য, "হরিশ্চন্দ্রপুর থানার পুলিশ আমার মেয়েকে উদ্ধারে যথেষ্ট তৎপরতা দেখিয়েছে ৷ মেয়ে ঘরে ফিরে এসেছে ৷ খুব খুশি আমি ৷ যারা মেয়েকে অপহরণ করেছিল, তারা আমারই ছোটবেলার বন্ধু ৷ একসঙ্গে পড়াশোনা করেছি ৷ ওরা যে এমন করবে, ভাবতে পারিনি ৷ বন্ধুত্বের বিশ্বাসই উঠে গেল ৷ ওদের টাকার দরকার ছিল সেটা আমাকে তো বলতে পারত ৷ আমি এলাকার সবাইকেই সাহায্য করি ৷ বন্ধুদের করতাম না !"
তাঁর কথায়, "ওরা আমার বাড়িতে আসত ৷ খাবার খেত ৷ একসঙ্গে ঘুরতে যেতাম ৷ ওদের এই কাজ মেনে নিতে পারছি না ৷ আমি ওদের কঠোর শাস্তি দাবি করছি ৷ আর এই ঘটনায় যাতে কোনোভাবে রাজনীতি ঢুকে না পড়ে, তার জন্য পুলিশ প্রশাসনের কাছে আবেদন জানাচ্ছি ৷ ওদের কঠোর শাস্তি না হলে ভবিষ্যতেও এমন ঘটনা ঘটাতে পারে ৷ অন্য কারও মেয়ে অপহরণ করতে পারে ৷ তাই ওদের জামিন হওয়া চলবে না ৷"
একই বক্তব্য শিশুর মায়েরও ৷ তাঁর সাফ কথা, "ওদের রান্না করে খাইয়েছি ৷ আমার স্বামীর বন্ধু ৷ একসঙ্গে স্কুলে পড়াশোনা করত ৷ একসঙ্গে থাকত, ঘোরাফেরা করত ৷ ওরা যে এমন করবে, কেউ ভাবতে পারে? মেয়েকে ওরা মারধর করেনি৷ উলটে বলেছিল, ওরা তার বাবার বন্ধু ৷ মেয়েকে ওর বাবার সঙ্গে কথা বলাতেও চেয়েছিল ৷ তবে মেয়ে কান্নাকাটি করায় ওরা হুমকি দিয়েছিল, কান্না বন্ধ না-করলে গুলি চালিয়ে দেবে ৷ আমি ওদের কঠোর শাস্তি চাই ৷"
নিজের বিধানসভা এলাকায় এমন ঘটনা নিয়ে উদ্বিগ্ন মন্ত্রী তজমুল হোসেনও ৷ শিশুর বাড়ি যান তিনি ৷ কথা বলেন ওই কিশোরী ও তার অভিভাবকদের সঙ্গে ৷ সেখান থেকেই স্থানীয় থানাকে নির্দেশ দেন, যাতে ঘটনার তদন্ত যথাযথ হয় ৷ তাঁর দাবি, "পুলিশের তৎপরতায় মেয়েটিকে খুব তাড়াতাড়ি উদ্ধার করা গিয়েছে ৷ এর জন্য হরিশ্চন্দ্রপুর থানার পুলিশ অফিসার জাকির হোসেনকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই ৷ শিশুর বাবা আমাদের গ্রামের জামাই ৷ সেই হিসাবে ওরা আমার আত্মীয় ৷ তার বন্ধুরাই ওর মেয়েকে অপহরণ করেছিল ৷ ওদের কঠোর শাস্তির দাবি রাখছি ৷ মুখ্যমন্ত্রী এই ঘটনায় কঠোর পদক্ষেপ করেছেন ৷ ফলে এখানে রাজনীতির কোনও বিষয় নেই ৷"
হরিশ্চন্দ্রপুর থানার আইসি মনোজিৎ সরকার বলেন, "আদালতের নির্দেশে পুলিশি হেফাজতে নিয়ে দুই অপহরণকারীকে দফায় দফায় জেরা করা হচ্ছে ৷ কী উদ্দেশ্যে তারা ওই নাবালিকাকে অপহরণ করার চেষ্টা করেছিল, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে ৷ এখনও পর্যন্ত তারা পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে ৷"