মালদা, 17 সেপ্টেম্বর: প্রলয় কি আসন্ন ? মানচিত্র থেকে মালদা জেলা মুছে যাওয়া কি শুধু সময়ের অপেক্ষা ? এমন সব প্রশ্নই উড়ে বেড়াচ্ছে গোটা জেলায় ৷ কারণ, গঙ্গা-ফুলহরের মিলনের আর খুব দেরি নেই ৷
বর্ষা প্রায় শেষের দিকে ৷ মাঝেমধ্যে নিম্নচাপের প্রভাবে বৃষ্টি হলেও দক্ষিণ-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তা কমছে ৷ তার প্রভাবে কমতে শুরু করেছে গঙ্গা-ফুলহরের জলস্তরও ৷ নদীর জল যত কমছে, ততই ভাঙনের তীব্রতা বাড়ছে গঙ্গার ৷ অল্পবিস্তর পাড় ভাঙছে ফুলহরেরও ৷ কয়েক বছর ধরেই গঙ্গা-ফুলহরের সাঁড়াশি আক্রমণে রতুয়া 1 নম্বর ব্লকের মহানন্দটোলা আর বিলাইমারি গ্রাম পঞ্চায়েতের বেহাল অবস্থা ৷ হাজারো ঘরবাড়ি তলিয়ে গিয়েছে দুই নদীর গর্ভে ৷ শ্রীকান্তটোলা-কান্তটোলা প্রায় নিশ্চিহ্ন ৷ এবার গঙ্গার নজর পড়েছে মহানন্দটোলা গ্রাম পঞ্চায়েতের নয়া বিলাইমারি সংলগ্ন খাকসাবোনায় ৷ এই জায়গাটিতেই গঙ্গা আর ফুলহর মিশে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে ৷
এই মুহূর্তে খাকসাবোনা এলাকা মালদার মূল ভূমি থেকে সড়কপথে বিচ্ছিন্ন ৷ যোগাযোগের মাধ্যম শুধু নৌকা ৷ নয়া বিলাইমারির বাসিন্দা আকবর আলি জানাচ্ছেন, "গঙ্গার জল কমছে ৷ জল কমছে ফুলহরেরও ৷ কিন্তু জল কমার সঙ্গে পাড় কাটাও শুরু হয়ে গিয়েছে গঙ্গার ৷ 3-4 দিন ধরে খাকসাবোনায় বেজায় ভাঙন চলছে ৷ আগে এখানে প্রায় 400 পরিবার বাস করত ৷ ভাঙনের ভয়ে সবাই চলে গিয়েছে ৷ এখন আমাদের গ্রামের মাত্র 15-20 পরিবার রয়েছে ৷ গঙ্গার মতো নদী যদি গ্রাম থেকে 100 মিটার দূরত্বে থাকে, ভয় তো হবেই ৷ অথচ প্রশাসনের হুঁশ নেই ৷ এখনও পর্যন্ত ভাঙন রোধের কোনও কাজ শুরু হয়নি ৷ যদি উপরের জল আরও দ্রুত গতিতে নীচে নেমে আসে, এবারই গঙ্গা-ফুলহর মিশে যাবে ৷ তখন কিন্তু মালদা জেলাটাই মুছে যেতে পারে ৷"
এর আগেই জেলার বাসিন্দা তথা রাজ্যের সেচ দফতরের প্রতিমন্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন এনিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন ৷ তিনি জানিয়েছিলেন, "গঙ্গা আর ফুলহর কোনওভাবে মিশে গেলে গঙ্গার প্রবাহই অন্য পথে ঘুরে যাবে ৷ সেক্ষেত্রে মালদার অস্তিত্ব তো বিপন্ন হবেই, প্রভাব পড়বে গোটা উত্তরবঙ্গ এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে ৷ আমরা বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারকে অনেকবার জানিয়েছি ৷ কিন্তু তারা কোনও তোয়াক্কাই করছে না ৷ তাই নিজেদের সীমিত ক্ষমতার মধ্যে যতটা ভাঙন রোধের কাজ করা যায়, সেটাই করছে রাজ্য সরকার ৷"
গঙ্গা-ফুলহর তো বটেই, জেলার ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হাতের তালুর মতো চেনেন রতুয়ার বিধায়ক সমর মুখোপাধ্যায় ৷ তিনি নিজেও ভাঙন প্রবণ মহানন্দটোলার বাসিন্দা ৷ তিনি বলছেন, "এসবই কেন্দ্রের ষড়যন্ত্র ৷ ওরা উত্তরবঙ্গকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে চাইছে ৷ ওরা জানে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যতক্ষণ রয়েছেন, ততক্ষণ ওদের এমন স্বপ্ন পূরণ হবে না ৷ তাই তারা প্রকৃতিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের প্ল্যান সফল করতে চাইছে ৷ গঙ্গার পলিমাটি দিয়ে তৈরি এই জেলার ভূভাগ দিয়ারা নামে পরিচিত ৷ মহানন্দটোলা আর বিলাইমারি কাটাহা দিয়ারার মধ্যে পড়ে ৷ উলটোদিকে রয়েছে মানিকচকের ভূতনি দিয়ারা ৷ দুই দিয়ারাকে ভাগ করেছে কোশি নদী ৷ দুই দিয়ারারই একদিকে গঙ্গা, অন্যদিকে ফুলহর ৷ এই সুযোগটাই নিতে চাইছে বিজেপি ৷"
সমর মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, "একসময় গঙ্গা আর ফুলহরের মধ্যবর্তী দূরত্ব ছিল 14 কিলোমিটার ৷ এখন দূরত্ব কমে দাঁড়িয়েছে 400 মিটার ৷ গঙ্গা-ফুলহর মিশে যাবেই ৷ তাহলেই মহানন্দটোলা, বিলাইমারি আর ভূতনি ভেসে যাবে ৷ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে রতুয়া 1 নম্বর ব্লকের কাহালা আর বাহারাল গ্রাম পঞ্চায়েতও ৷ গঙ্গা মোথাবাড়ি হয়ে পাগলা নদীর খাত দিয়ে বইতে শুরু করবে ৷ সেই খাত ধরেই গঙ্গা মিশে যাবে পদ্মায় ৷ ফরাক্কা ব্যারেজ স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থেকে যাবে ৷ সেখানে জল থাকবে না ৷ ফিডার ক্যানেল শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে ৷ বিজেপি এটাই চাইছে ৷ এটা হলেই উত্তরবঙ্গের আটটি জেলা-সহ দেশের উত্তর-পূর্ব অংশ ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে ৷ এই প্ল্যান সফল করার জন্যই কেন্দ্রীয় সরকার গঙ্গা ভাঙন রোধে কোনও টাকা দিচ্ছে না ৷ ফরাক্কা ব্যারেজ চুক্তির সময় বলা হয়েছিল, আপ স্ট্রিমে 60 কিলোমিটার আর ডাউন স্ট্রিমে 10 কিলোমিটার ভাঙন মোকাবিলার দায়িত্ব কেন্দ্রের ৷ অর্থাৎ মুর্শিদাবাদের সামশেরগঞ্জ থেকে ভাগলপুরে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি পর্যন্ত গঙ্গার দু'দিক রক্ষণাবেক্ষণ করবে কেন্দ্র ৷ কিন্তু তারা সেই চুক্তি মানছে না ৷ কেন্দ্রীয় বঞ্চনার প্রতিবাদে এর আগে আমরা ফরাক্কা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষকে ঘেরাও করেছি ৷ আবার করব ৷"
যদিও বিজেপি সাংসদ খগেন মুর্মুর দাবি, বারবার বলা সত্ত্বেও রাজ্য সরকারের তরফে ভাঙন রোধে কোনও প্রস্তাব পাঠানো হয়নি কেন্দ্রের কাছে ৷ সেই কারণেই এই ব্যাপারে পদক্ষেপ করতে পারছে না কেন্দ্রীয় সরকার ৷ প্রস্তাব পাঠানো হলেই সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ করা হবে বলে জানান তিনি ৷