জলপাইগুড়ি, 31 অগস্ট: আরজি কর-কাণ্ড সামনে আসার পর স্বাস্থ্য দফতরের একাধিক দুর্নীতি নিয়ে নতুন করে সরব হয়েছেন অনেকেই ৷ যে সমস্ত ‘প্রভাবশালী’ চিকিৎসকের নাম আসছে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ড. সুশান্ত রায় ৷ উত্তরবঙ্গে স্বাস্থ্যবিভাগের প্রাক্তন ওএসডি-র বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ তো রয়েছেই ৷ পাশাপাশি তাঁর ছেলের বিরুদ্ধে বাবার ‘প্রভাব খাটিয়ে’ বেআইনি কাজের অভিযোগ রয়েছে ৷ আরজি কর আবহে তা আবার নতুন করে সামনে চলে এসেছে ৷
ড. সুশান্ত রায়ের ছেলে ড. সৌত্রিক রায় ৷ তিনি উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমডি পড়েন ৷ সেখানে তিনি শীর্ষস্থানাধিকারীদের মধ্যে একজন ছিলেন ৷ এর জন্য তিনি স্টাইপেন্ডও পেতেন ৷ অথচ যে সময় তিনি এমডি পাঠরত, সেই সময়ই আবার জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালে থ্যালাসেমিয়া কট্রোল ইউনিটের মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে কাজ করতেন বলে অভিযোগ ৷ তার জন্য টাকাও পেতেন ৷
প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে তিনি কি ক্লাসে যেতেন না ? নাকি এমডি পড়ছিলেন, আর মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে কাজ না করেই টাকা পেতেন ?
তবে এই প্রশ্ন যে এখন উঠছে, তা নয়৷ আগেও উঠেছিল ৷ তদন্তও শুরু হয়েছিল ৷ জলপাইগুড়ির তৎকালীন মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক জগন্নাথ সরকার সদর হাসপাতালে সেই সময় দায়িত্বে থাকা সুপার ড. গয়ারাম নস্করকে শোকজ করেছিলেন ৷ কীভাবে এমডি পাঠরত অবস্থায় হাসপাতাল থেকে বেতন পেতেন সৌত্রিক রায়, সেই প্রশ্নের উত্তরই জানতে চেয়েছিলেন জগন্নাথ সরকার ৷
উল্লেখ্য, ড. সৌত্রিক রায় 2013 সালের 5 ডিসেম্বর জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালে জলপাইগুড়ি ডিস্ট্রিক্ট হেলথ ও ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার সমিতির অধীনে থ্যালাসেমিয়া কন্ট্রোল ইউনিটের কন্ট্রাকচ্যুয়াল ডাক্তার হিসেবে যোগ দেন ৷ সেই কাজ করতে করতেই তিনি চলে যান এমডি পড়তে ৷ 2018 সালের 25 মে থেকে 2019 সালের 12 এপ্রিল পর্যন্ত একদিকে এমডি পড়ার সময় তিনি স্টাইপেন্ড পেয়েছেন ৷ অন্যদিকে জলপাইগুড়ি হাসপাতাল থেকে টাকাও পেয়েছেন ৷ স্বাস্থ্য দফতরে তাঁর নামে ওয়ার্কিং স্টেটমেন্টও গিয়েছে ৷
এটা বেআইনি বলেই দাবি করলেন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন বা আইএমএ-র প্রাক্তন সম্পাদক ড. পান্থ দাশগুপ্ত ৷ কারণ, চাকরি থেকে অব্যাহতি নিয়েই এমডি পড়তে যেতে হয় ৷ এটাই নিয়ম ৷ কিন্তু তদন্ত কোনও এক অজানা কারণে মাঝপথে থেমে যাওয়ায় সেই রহস্য়ের সমাধান হয়নি ৷
এই নিয়ে ড. পান্থ দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘দুই জায়গা থেকে বেতন নেওয়ার বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে শোনা গিয়েছিল । সরকারি নির্দিষ্ট নিয়ম আছে ৷ এর বাইরে কেউ নন । একদিকে সরকারি বেতন নেব । আবার এমডি পড়াকালীন স্টাইপেন্ড নেব । যদি এটা হয়ে থাকে এটা ঘোরতর বেআইনি কাজ হয়েছে । সঠিক তদন্ত হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নিলে এমডি পদও চলে যেতে পারে । এর ক্ষেত্রেও উত্তরবঙ্গ লবি যুক্ত ।’’
আরজি কর-কাণ্ড সামনে আসার পর থেকেই স্বাস্থ্যক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গ লবির কথাটি বারবার উঠে আসছে ৷ সৌত্রিক রায়ও এই লবির জোরেই বেআইনি কাজ করেছেন বলে অভিযোগ ৷ এক্ষেত্রে তাঁর বাবা ড. সুশান্ত রায়ের প্রভাবই সবচেয়ে বেশি ছিল বলে অভিযোগ উঠেছে ৷
এই নিয়ে অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টরসের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুবর্ণ গোস্বামী বলেন, ‘‘ড. সুশান্তকুমার রায় আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ । তার ছেলে একদিকে কন্ট্রাকচুয়াল মেডিক্যাল অফিসার হিসাবে থ্যালাসেমিয়া কন্ট্রোল ইউনিটে কাজ করার সময় সেখান থেকেও সে মাইনে তুলেছে । আবার এমডি পড়ার সময়েই স্টাইপেন্ড তুলেছে ।’’
সুবর্ণ গোস্বামী শুধু এখানেই থামেননি ৷ তাঁর আরও দাবি, এমডি পড়ার সময় ক্লাস না করেই সৌত্রিককে টপার করে দেওয়া হয়েছে । স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করে ধরে টপার করা হয়েছে ।
আর এখানেও জড়িয়ে যাচ্ছে আরজি করের নাম৷ কারণ, আরজি কর-কাণ্ডের পর পরই যাঁকে সেখানকার অধ্যক্ষ করা হয়, সেই সুহৃতা পালই সেই সময় স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন ৷ ফলে এই বেনিয়মে তিনিও জড়িত বলে অভিযোগ ৷ তিনি এখন বারাসত মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের অধ্যক্ষ ৷ তাঁর সঙ্গে এই নিয়ে যোগাযোগ করা হয়েছিল ৷ কিন্তু তিনি কোনও বৈঠকে আছেন বলে জানান৷ ফলে তাঁর কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি ৷
অন্যদিকে ড. সুশান্ত রায়ের ছেলে ড. সৌত্রিক রায়কে ফোন করা হলে তিনি ফোন ধরেননি । ফলে তার প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি । তাই তিনি কিভাবে একই সময় সরকারি টাকা দু’টি জায়গা থেকে পেলেন, কিভাবে তিনি এমডি-তে টপার হলেন, সব প্রশ্নের উত্তরও অধরা রইল ৷ যেমন উত্তর মেলেনি এমডি পড়ার ক্ষেত্রে 80 শতাংশ বাধ্যতামূলক উপস্থিতি তাঁর ছিল কি না !
উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অধ্যক্ষ ড. ইন্দ্রজিৎ সাহা বলেন, নিয়ম অনুযায়ী এমডি-র ছাত্রদের 80 শতাংশ উপস্থিতি থাকতে হয় । অন্যদিকে জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালের তৎকালীন সুপার ড. গয়ারাম নস্কর জানান, তিনি কিছুই বলতে পারবেন না । এমনটি হওয়ার কথা নয় । সৌত্রিক রায় তাঁর স্টাফ ছিলেন না ।
তাই জলপাইগুড়িতে অনেকে প্রশ্ন করছেন যে আরজি করের সূত্র ধরে কি স্বাস্থ্য দফতরের এমন নানা বেনিয়মের অভিযোগের তদন্ত নতুন করে শুরু হবে ? নাকি সবটাই ধামাচাপা পড়ে থাকবে ? প্রশ্ন অনেকে ৷ উত্তরও আপাতত অজানা ৷