জলপাইগুড়ি, 29 অগস্ট: ভারতের নাগরিক হয়েও নেই জমির অধিকার ৷ ফলে যাবতীয় সরকারি সুযোগ সুবিধে থেকে বঞ্চিত ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের পাঁচটি গ্রামের বাসিন্দারা ৷ জরিপ না-হওয়ায় তাঁরা জমি কেনাবেচাও করতে পারেন না ৷ এই নিয়ে দীর্ঘদিন আন্দোলন চালিয়েও কোনও লাভ হয়নি বলে অভিযোগ ৷ এই সমস্যা না-মেটার জন্য জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসন তথা রাজ্য সরকারের উদাসীনতাকে দায়ী করেছেন এলাকার মানুষ ৷
দীর্ঘ 77 বছর ধরে সমস্যায় জর্জরিত জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের দক্ষিণ বেরুবাড়ির পাঁচটি ভারতীয় গ্রামের বাসিন্দারা ৷ 2015 সালে দুই দেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়ের সময় স্থল সীমান্ত চুক্তি কার্যকর হলেও জমির জরিপ না হওয়ার ফলে তাঁর পাননি জমির অধিকার । জমি জরিপ না-হওয়ায় তাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারের কিষান নিধি প্রকল্পই হোক বা রাজ্য সরকারের কৃষক বন্ধু প্রকল্প, কিছুই পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ । এই সমস্যার নিরসনের জন্য তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালাচ্ছেন ৷
দেশভাগের সময় দক্ষিণ বেরুবাড়ির মধ্যে চলে আসে দুই বাংলার সীমান্তের পাঁচটি গ্রাম - কাজলদিঘি, চিলাহাটি, বড়শশী, নাওতারিদেবত্তর এবং পড়ানিগ্রাম ৷ লোকসংখ্যা প্রায় 10 হাজার । 1974 সাল পর্যন্ত ভারতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দাবিতে সেখানে আন্দোলন চলে । সে বছরই চুক্তি হয় দু'দেশের রাষ্ট্রনেতা ইন্দিরা গান্ধি ও মুজিবুর রহমানের মধ্যে । ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্ত নির্ধারণের সময় দেখা যায় এই পাঁচটি গ্রাম ভারতে নেই ।
যদিও 1989 সালে বোঝা যায় যে, ভারতের মূল ভূখণ্ডের মধ্যে থাকলেও এই পাঁচটি গ্রামকে ভারতের মানচিত্রে দেখানো হয়নি । ফলে এই পাঁচটি গ্রামের জমির খাজনা আদায়, জমি বিক্রি, সরকারি প্রকল্প রূপায়নে সমস্যায় পড়তে হয় । এরপর 2015 সালে দুই দেশের ছিটমহল বিনিময় ও অ্যাডভার্স পজিশনে থাকা জমির বিনিময় হয় । কিন্তু তারপর 9 বছর কেটে গেলেও আজও এই পাঁচটি গ্রামের জমির জরিপ হয়নি ৷ ফলে দেশের স্বাধীনতার এত বছর পরও জমির অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সীমান্তের এই পাঁচ গ্রামের মানুষ ৷
স্থানীয় বাসিন্দা সারদাপ্রসাদ দাস জানান, "সীমান্তে আমরা নানা যন্ত্রণার মধ্যে আছি । সীমান্তে অ্যাডভার্স পজিশন ছিল, তবে 2014 সালে স্থল সীমান্ত চুক্তির পর আমরা আমাদের ভিটে মাটি পেয়ে গেলাম । কিন্তু 10 বছর হতে চলল আজ পর্যন্ত জমির জরিপ হল না । ভারতের নাগরিক হওয়ার পরও জমি কেনাবেচা করতে পারছে না এখানকার লোকেরা । কোনও সার্ভে হয়নি । জমির কোনও খতিয়ান নেই । আধার কার্ড, ভোটার কার্ড থাকলেও ভারতের মানচিত্রে আমরা নেই । আমরা জমির অধিকার চাই । সীমান্তে 16 কিলোমিটার কাঁটাতারের বেড়া নেই, সেটাও যাতে দিয়ে দেওয়া যায় তার দাবি জানাচ্ছি । আমাদের চারখানা মৌজা আছে, যার জমির কাগজ নেই ।"
আরেক বাসিন্দা গোপালচন্দ্র রায় বলেন, "আমরা যে জমিতে চাষাবাদ করি, সেই জমির কোনও খতিয়ান নেই । ফলে আমরা রাজ্য বা কেন্দ্রের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি । ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সীমান্ত চুক্তি হয়ে যাওয়ার পর সীমান্তে পিলার দেওয়া হলেও এখনও জমির জরিপ হয়নি । রাজ্য সরকারের কৃষকবন্ধু প্রকল্প, কেন্দ্র সরকারের কিষান সম্মান নিধি পাচ্ছি না । চাষিরা কোনও সরকারি সুযোগ সুবিধা পাচ্ছি না । বেড়ার ওপাশের জমির কোনও নিরাপত্তা নেই ।" সরকারের খামখেয়ালিপনার জন্যই জমির জরিপ হচ্ছে না বলে অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের ।
সীমান্তের চিলাহাটি গ্রামেই বাড়ি জলপাইগুড়ি সদর বিধানসভার প্রাক্তন ফরোয়ার্ড ব্লক বিধায়ক গোবিন্দ রায়ের । 2006 সালে তিনি বিধায়ক ছিলেন । তিনিও এই সমস্যা সমাধানে সরকারের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ৷
তাঁর কথায়, "2015 সালে দুই দেশের মধ্যে স্থল সীমান্ত চুক্তি কার্যকর হলেও, সীমান্তের পিলার বসানো হলেও, সীমান্তে বসবাসকারী মানুষের জমির জরিপ করে জমির কাগজ দেওয়ার কাজ রাজ্য সরকার করছে না । নয় বছর হয়ে গেলেও জমির জরিপ হয়নি । জমির জরিপ না-হওয়ায় জমির কাগজ নেই । ফলে সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত বাসিন্দারা । সীমান্তের মানুষরা কী ভারতের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক ? মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আমরা জবাব চাই । জেলা প্রশাসনের উদাসীনতায় জমির জরিপ হচ্ছে না । বঞ্চিত দক্ষিণ বেরুবাড়ির কয়েকটি মৌজার কয়েক হাজার বাসিন্দা । আমরা সরকারের কাছে দ্রুত জমির জরিপের দাবি জানাচ্ছি । সরকার শিবির বসিয়ে জমি জরিপ করতে পারে না, এটা বিশ্বাস করি না । শুধু সদিচ্ছার অভাব ।"
জলপাইগুড়ি জেলা পরিষদের সভাধিপতি কৃষ্ণা রায় বর্মন এবিষয়ে বলেন, "আমরা বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখছি ।" এদিকে, জেলাশাসকের সঙ্গে এবিষয়ে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তাঁকে ফোনে পাওয়া যায়নি ৷