কলকাতা, 19 সেপ্টেম্বর: জামিন পেলেন ডিওয়াইএফআই নেতা কলতান দাশগুপ্ত ৷ বৃহস্পতিবার কলকাতা হাইকোর্ট তাঁকে জামিন দেয় ৷ হাইকোর্ট এ দিন 500 টাকার বন্ডে কলতান দাশগুপ্তকে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ৷ একই সঙ্গে আদালত জানিয়েছে যে সিপিএমের এই যুবনেতার বিরুদ্ধে এই মামলায় আর কোনও পদক্ষেপ করা যাবে না ৷
গত শনিবার কলতান দাশগুপ্তকে গ্রেফতার করে বিধাননগর পুলিশ ৷ তাঁর বিরুদ্ধে জুনিয়র চিকিৎসকদের ধরনা মঞ্চে হামলার ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ উঠেছে ৷ গত মঙ্গলবার সেই নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়ের হয় ৷ সেই মামলাতেই বৃহস্পতিবার এই নির্দেশ দিয়েছেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি রাজর্ষি ভরদ্বাজ ৷
সেখানে তাঁর পর্যবেক্ষণ, ইতিমধ্যেই পুলিশ কলতানকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে । তাঁকে আর হেফাজতে রাখার প্রয়োজন আছে বলে আদালতের মনে হচ্ছে না । সেই জন্য ওই নেতাকে ছেড়ে দিতে হবে । বিধাননগর নিম্ন আদালতে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে 500 টাকার বন্ড জমা রাখতে হবে জামিনের শর্ত হিসাবে ।
এ দিন হাইকোর্টে এই মামলার শুনানিতে সবপক্ষের বক্তব্য় শোনেন বিচারপতি ভরদ্বাজ ৷ সেখানে বর্ষীয়ান আইনজীবী তথা সিপিএম নেতা বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য সওয়াল করেন যে ডিওয়াইএফআই নেতা কলতান দাশগুপ্তকে পরিকল্পিত ভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে । তাঁর গ্রেফতারের আইনগত ভিত্তি নেই । তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া এফআইআর অবিলম্বে খারিজ করা উচিত ৷
কিন্তু রাজ্যের তরফে অ্যাডভোকেট জেনারেল কিশোর দত্ত একটি রিপোর্ট পেশ করেন ৷ সেই রিপোর্টে জানানো হয় যে ডাক্তারদের ধরনা কর্মসূচিতে হামলা করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল । গত 5 মাসে 171টি ফোন কল হয়েছে কলতান দাশগুপ্ত ও এই ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া আরও একজনের মধ্যে । ফলে দু’জন অপরিচিত নন ।
তখন পালটা বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, "কলতান নিজে ফোন করেননি । একটি অচেনা নম্বর থেকে তাঁর কাছে ফোন আসে । এক্ষেত্রে জামিন অযোগ্য ধারার কোনও প্রশ্নই ওঠে না । অথচ যিনি ফোন করলেন তাঁকে জামিনযোগ্য ধারা দেওয়া হলেও যিনি ফোন পেলেন তাঁকে জামিন অযোগ্য ধারা দেওয়া হয়েছে ।"
এই কথা শুনে বিচারপতি রাজর্ষি ভরদ্বাজ বলেন, "যে পেন ড্রাইভ পাওয়া গিয়েছে, সেটি তো এই দুজনের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি । আমি শুনেছি এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের থেকে পাওয়া গিয়েছে । এটা কেন হবে ? দু’জনের ক্ষেত্রে দু’ধরনের ধারা কেন দেওয়া হয়েছে ?" তখন রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল কিশোর দত্ত বলেন, "না না, আমাদের রেকর্ড, তা বলছে না । পেন ড্রইভ কে দিল সেটা এক্ষেত্রে বিচার্য নয় । কারণ, দু’জনে কথপোকথনের কথা মেনে নিয়েছেন ।"
কিন্তু রাজ্যের উদ্দেশ্যে বিচারপতি রাজর্ষি ভরদ্বাজ প্রশ্ন করেন, "এই ধরনের বৈষম্য কেন হল ? রাজ্য তো অভিযোগ করেছে সন্ত্রাসবাদী হামলা হতে পারে । তাহলে এফআইআরের ক্ষেত্রে এই ধরনের অভিযোগ কেন ? একজনের ক্ষেত্রে জামিনযোগ্য আর একজনের ক্ষেত্রে জামিন অযোগ্য ধারা কেন হবে ?" রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল এই বিষয়ে সদুত্তর দিতে পারেননি ।"
বিকাশরঞ্জন আরও বলেন, "কলতান গ্রেফতার হয়েছেন 14 সেপ্টেম্বর । সঞ্জীবের বয়ানের ভিত্তিতে কলতানকে গ্রেফতার করা হয়েছে । একটি পেন ড্রাইভের ভিত্তিতে গ্রেফতার, যা এভিডেন্স আইনের বিরুদ্ধ । পেন ড্রাইভ কে দিল, তার উল্লেখ নেই । গ্রেফতারের আগে পেন ড্রাইভের বিষয়টি সোশাল মিডিয়ায় প্রকাশিত হয় ।"
বিচারপতি তখন পালটা প্রশ্ন করেন, "কথোপকথনে আরও যাঁদের নাম এসেছে, তাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে কি ? ভয়েস রেকর্ড কি টেস্ট করেছে পুলিশ ? না হলে কিসের ভিত্তিতে গ্রেফতার ?" রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল যুক্তি দেন, "আর কেউ গ্রেফতার হননি । পুলিশ দেখছে । কিন্তু কথোপকথনে এটা স্পষ্ট যে কলতান কাজটা করতে বলছেন সঞ্জীবকে ।"
বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, "কথোপকথনে কোথাও কলতানের নাম আসেনি । সঞ্জীবের থেকে কলতানের নাম পায় পুলিশ । 13 সেপ্টেম্বর সঞ্জীব গ্রেফতার হন । তারপর 14 সেপ্টেম্বর কলতান গ্রেফতার হন । পেন ড্রাইভ দিয়েছে অন্য ব্যক্তি । পেন ড্রাইভ হল সেকেন্ডারি এভিডেন্স । গোটা বিষয়টি আইটি আইন ও এভিডেন্স আইন বিরোধী ।"
আদালতে তিনি আরও বলেন, "আসলে যেহেতু কলতান এই আন্দোলনের অন্যতম মুখ বা চালিকাশক্তি এবং চিকিৎসকদের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছে দিতে এটা একটা ষড়যন্ত্র বলেই মনে হচ্ছে ।" মামলা প্রসঙ্গে বিকাশ বলেন, "এক্ষেত্রে তিনটি সিজার লিস্ট দেওয়া হয়েছে, যেখানে সাক্ষী যাঁরা, তাঁরা সবাই পুলিশ । এখানেই সবচেয়ে বড় সন্দেহ যে এক্ষেত্রেও কেস সাজানো হয়েছে । সঞ্জীবের কাছে কিপ্যাড ফোন ছিল, যাতে রেকর্ড করা যায় না । তাহলে কে রেকর্ড করল । ফোন যদি ট্যাপ করা হয়, তাহলে সেটাও আইনের পরিপন্থী । আমরা তাই কলতানের বিরুদ্ধে করা এফআইআর খারিজের আবেদন করছি ।"
এদিকে রাজ্যের আইনজীবী আরও বলেন, "টেলিফোনিক কথোপকথন দেখুন, সেখানে কলতান যা বলেছেন, তাতে যাঁরা গন্ডগোল বাঁধাতে চাইছেন, তাঁদেরকে বাধা দেওয়ার বদলে তাঁকে এই কাজ করতে অনুপ্রাণিত করছেন এবং অশান্তি পাকানোর কাজ করতে নির্দেশ দিচ্ছেন । অর্থাৎ এখানে অভিযুক্তের প্রত্যক্ষ যোগ রয়েছে ।"
বিচারপতি প্রশ্ন করেন, "একজন রাজনৈতিক ব্যক্তির কাছে পেন ড্রাইভ পাওয়া গেল ? যেহেতু অভিযুক্তের ফোন থেকে রেকর্ড করা যায় না, তাহলে পেন ড্রাইভ এল কোথা থেকে ? সাত দিন গ্রেফতারির পর পুলিশ কেন একথা বলছে না ? যেটা নিয়ে পুলিশের তদন্ত চলছে, সেটা মিডিয়ার কাছে গেল কীভাবে ?"
রাজ্যের তরফে যুক্তি দেওয়া হয় যে পুলিশ কলতানকে নিয়ম মেনেই গ্রেফতার করেছে । পেন ড্রাইভ অবশ্যই একটি ডকুমেন্ট । তাঁর ভিত্তিতে গ্রেফতারি নিয়ে কোনও অসুবিধা থাকার কথা নয় । পুলিশ তাই করেছে । সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন মামলার ক্ষেত্রেও এই ধরনের ঘটনায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করা হয়েছে । পুলিশ নিয়ম মেনেই গ্রেফতার করেছে ।
এর পর বিচারপতি রায়দান স্থগিত রাখেন ৷ পরে জানা যায় যে বিচারপতি 500 টাকার বন্ডে ডিওয়াইএফআই নেতা কলতান দাশগুপ্তকে জামিন দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট ৷ সেই রায় যখন জানা যায়নি, সেই সময়ই ধর্মতলায় এক প্রতিবাদ সভায় হাজির হন আইনজীবী তথা সিপিএম নেতা বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য ৷ সেখানে তিনি ইটিভি ভারতকে বলেন, "কলতানের বিষয়টি পরিকল্পিত চক্রান্ত । এখন আদালতে বিষয়টি রয়েছে । আমাদের আইনি লড়াই শুরু হয়েছে । এই আইনি লড়াই দীর্ঘস্থায়ী লড়াই হবে । আজ না হোক কাল কলতানকে বের করে আনা হবেই ।"
পাশাপাশি আরজি কর প্রসঙ্গ টেনে বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য অভিযোগ করেন, "গোটা রাজ্য প্রশাসন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে । দুর্নীতিবাজদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে সরকার । রাজনৈতিক পরিচালনাতে যাঁরা আছেন, তাঁরাও এই দুর্নীতি প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত । তাঁদের দ্বারা সাধারণ মানুষ নির্যাতিত হচ্ছে । কিন্তু সাধারণ মানুষ শান্তিপ্রিয় । স্থিতিবস্তার পক্ষে । খুব সহজে পরিবর্তন চান না । কিন্তু হাসপাতালে মধ্যে কর্তব্যরত অবস্থায় সাধারণ ঘরের মেয়ের মৃত্যু মানুষের চোখ খুলে দিয়েছে । এখন এই আন্দোলনটা শুধুমাত্র ওই নির্যাতিতার পরিবারের নয় । সাধারণ মানুষেরও । জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনটা একটা স্ফুলিঙ্গ । সেই আন্দোলনটা এখন গণ-আন্দোলনের চেহারা পেয়েছে । যেখানে সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমেছে ।"
এদিন বিকাশ যে অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন, তা আয়োজন করেছিল, জনচেতনা মঞ্চ ৷ সেখানে কথায়, গানে, নাটকে, কবিতায়, ছবিতে আরজি কর-কাণ্ডের ন্যায় বিচারের দাবি তোলা হয় । পবিত্র সরকার, মানসী সিনহা, অপরাজিতা আঢ্য, সুদীপ্তা চক্রবর্তী, সৌরভ পালৌধী, সনাতন দিন্দা, দেবদূত ঘোষ, বাদশা মৈত্র, ড. অভিজিত চৌধুরী, ড. সুবর্ণ গোস্বামী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন ৷