বোলপুর, 15 মার্চ: সিপিএমের সোমনাথ চট্টোপাধ্য়ায় এখানকার সাংসদ ছিলেন ৷ বীরভূমের বোলপুর লোকসভা আসনের নাম উঠলেই প্রয়াত এই বামনেতার প্রসঙ্গ এখনও উঠে আসে ৷ লোকসভার অধ্য়ক্ষের পদ ছাড়া নিয়ে সিপিএমের সঙ্গে বিরোধিতার জেরে 2009 সালে তিনি আর ভোটে লড়েননি ৷ কিন্তু 15 বছর পর এখনও তিনি প্রাসঙ্গিক ৷ এলাকার ভোটারদের অনেকেই মনে করেন যে বোলপুরের পরবর্তী তিন সাংসদ সোমনাথ চট্টোপাধ্য়ায়ের মতো উন্নয়ন করতে পারেননি ৷
যদিও 2009-এর পরবর্তী 15 বছরে বাংলার এই ‘লাল-মাটির দেশে’ অনেক পরিবর্তন এসেছে ৷ একসময়ের ‘লাল-গড়’ অতীত হয়ে তা চিহ্নিত হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের অনুব্রত মণ্ডলের খাসতালুক হিসেবে পরিচিত হয়েছে এই লোকসভা কেন্দ্র ৷ 2014 সালে এখানে প্রথম ঘাসফুল ফোটান অনুব্রত ওরফে কেষ্ট মণ্ডল ৷ সাংসদ হন অনুপম হাজরা ৷ 2019 সালের লোকসভা ভোটের আগে অনুপমের বিজেপি-যাত্রায় সেখানে প্রার্থী হন কেষ্ট অনুগামী বলে পরিচিত অসিত মাল ৷
গত পাঁচ বছর তিনিই এই আসনের সাংসদ ৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় এবারও অসিতের উপরই ভরসা করেছেন ৷ কিন্তু পাঁচ বছর আগের ভোটের চেয়ে এবারের নির্বাচন যে অনেকটাই আলাদা, তা নিজেই জানেন তৃণমূলের এই নেতা ৷ বীরভূমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা অনুব্রত এখন গরুপাচার মামলায় জেলে ৷ বীরভূম থেকে অনেক দূরে আপাতত তিনি তিহাড় জেলে বন্দি ৷ ফলে কেষ্ট-হীন এই নির্বাচনে গত পাঁচ বছরের রিপোর্ট কার্ডই যে ভোটে জেতার অন্যতম চাবিকাঠি হবে, সেটা অজানা নয় অসিত মালের ৷
তাই তিনি প্রচারে তুলে ধরছেন বোলপুরের উন্নয়নের খতিয়ান৷ বলছেন, "আমি আমার সাংসদ তহবিলের টাকায় জেসিবি মেশিন, জল প্রকল্প, রাস্তা, অ্যাম্বুল্যান্স, পথবাতি, কালভার্ট প্রভৃতি করে দিয়েছি । আগামীতেও করব ।" পাশাপাশি তিনি কেন্দ্রীয় বঞ্চনার কথা বলছেন ৷ অসিত মালের কথায়, "কেন্দ্রীয় সরকার বহু ক্ষেত্রে আমাদের টাকা আটকে দিয়েছে । টাকা দেয়নি । বারবার উন্নয়নের জন্য দাবি করেছি, তাও পাইনি ।"
একনজরে দেখা নেওয়া যাক কী কী কাজ করেছেন অসিত মাল ?
- জেসিবি মেশিন দিয়েছেন ।
- গ্রামাঞ্চলে ছোট ঢালাই রাস্তা ও পিচ রাস্তা করেছেন ।
- পানীয় জল প্রকল্পের জন্য বিভিন্ন জায়গায় বরাদ্দ করেছেন ৷
- বোলপুর শহর-সহ বিভিন্ন মফ্ফসল এলাকায় পথবাতি দিয়েছেন ।
- বেশ কিছু আধুনিক অ্যাম্বুল্যান্স দিয়েছেন ।
- বোলপুর পৌরসভা-সহ গ্রামে গ্রামে কালভার্ট করা হয়েছে ।
- চাষিদের জন্য ধান ছাঁটার মেশিন, ট্রাক্টর দিয়েছেন ৷
- বেশ কিছু স্কুলে পানীয় জলের ব্যবস্থা করেছেন ৷
বোলপুর লোকসভা আসনের মধ্যেই পড়ছে শান্তিনিকেতন ৷ রবি ঠাকুরের হাতে তৈরি বিশ্বভারতী, যা এখন কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় ৷ সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামোগত উন্নয়নের জন্যও সংসদে সরব হয়েছেন বলে দাবি করলেন এই তৃণমূল সাংসদ ৷ তিনি বলেন, "আমি সংসদে বিশ্বভারতীর উন্নয়নের জন্য একাধিকবার প্রশ্ন তুলেছি । কারণ, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য খোদ প্রধানমন্ত্রী ।’’
যদিও সাংসদের উন্নয়নের দাবির সঙ্গে এলাকার বাস্তব পরিস্থিতি মেলাতে পারছেন না স্থানীয় বাসিন্দারাই ৷ অধিকাংশই এই সাংসদকে ব্যর্থ তকমা দিচ্ছেন ৷ অকপটে জানাচ্ছেন যে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের পর আর কোনও সাংসদ বোলপুরের জন্য তেমন কিছু করেননি ৷ বোলপুরের টোটোচালক সুকেশ চক্রবর্তী বলেন, "বোলপুরে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের পর কোনও সাংসদ কিছু কাজ করেছে বলে দেখিনি ৷ অনুব্রত মণ্ডলের ঘনিষ্ঠ তাই দাঁড় করানো হয়েছে, জিতেছেন উনি ৷ নতুন কাজ বলতে নীল-সাদা রং হয়েছে ।"
এলাকার আরেক বাসিন্দা সোনা মুর্মু বলেন, "অসিত মালকে সামনাসামনি কোনোদিন দেখিনি ৷ শুধু ভোটের সময় পোস্টারেই দেখি । কিছুই কাজ করেননি ৷ তাই ওঁর থেকে কিছুই আশা করতে পারছি না ।" সুবীর মণ্ডল নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, "চোখে পড়ার মতো কিছুই কাজ দেখিনি । তবে আশা করছি আবার যদি উনি নির্বাচিত হন, ভালো কাজ করবেন ৷ অনুব্রত মণ্ডল প্রার্থী করেছিলেন, এখন উনিই জেলে আছেন ৷ শান্তিনিকেতন এলাকায় কোনও কাজ করেছেন বলে জানা নেই ।"
বোলপুরের আরেক বাসিন্দা হারাধন চক্রবর্তীরও একই কথা ৷ তিনি বলেন, "আমি ওনাকে কখনও দেখিনি এলাকায় ৷ তাঁর তেমন কোনও কাজ দেখিনি ৷ যা কাজ করেছে বোলপুর পৌরসভা করেছে । আর সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় বোলপুর বাইপাস, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করেছিলেন ৷ নতুন করে কোনও কাজ দেখিনি ।"
কী কী কাজ হয়নি, সেটাই দেখা নেওয়া যাক একনজরে -
- সংস্কৃতির শহর হিসাবে পরিচিত বোলপুরে আধুনিক জাতীয় মানের কোনও লাইব্রেরি নেই ।
- গ্রীষ্মকালে গ্রামাঞ্চলে তীব্র গরম পড়ে, সেখানে পর্যাপ্ত পানীয় জল নেই ।
- নিকাশি ব্যবস্থার চরম অভাব ।
- বোলপুর শহরে রাস্তার চরম অভাব, ফ্লাইওভার নেই । তাই ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয় ৷
- বিশ্বভারতীর জন্য কোন কিছু করেনি কোনোদিন ৷
- ধুঁকছে বল্লভপুর অভয়ারণ্যে, তার সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কিছু করেননি ।
- ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের জন্য খ্যাত শান্তিনিকেতন, সেখানে শিল্প হাব নেই ৷
- কেতুগ্রামে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো নেই ৷ রোগীদের 30 থেকে 35 কিলোমিটার দূরে বোলপুর সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল বা বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যেতে হয়৷
- অজয় নদ থেকে বেআইনিভাবে বালি তোলার ফলে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৷ ফলে নানুর, মঙ্গলকোট, আউসগ্রাম এলাকার মানুষ বন্যার আতঙ্কে দিন কাটান ৷ এমনকি বালি ভর্তি ট্রাক, লরি যাতায়াতে গ্রামের রাস্তা বেহাল হয় ৷
সোমনাথ চট্টোপাধ্য়ায় 1985 সালের উপ-নির্বাচনে জিতে সাংসদ হন ৷ তার পর 2004 পর্যন্ত তাঁকে হারানো যায়নি ৷ 2009 সালে তিনি প্রার্থী না হওয়ায় রামচন্দ্র ডোমকে প্রার্থী করে সিপিএম ৷ তিনিও জেতেন ৷ 2014 সালে অনুপম হাজরা বোলপুরের সাংসদ হন তৃণমূলের টিকিটে জিতে ৷ অসিত মাল আদতে কংগ্রেসী ৷ তিনি 1996 সাল থেকে 2016 সাল পর্যন্ত বীরভূমের হাঁসন বিধানসভার কংগ্রেস বিধায়ক ছিলেন ৷ পরে তৃণমূলে চলে আসেন৷ আর 2019 সালে তিনি তৃণমূলের টিকিটে ভোটে জিতে সাংসদ হন ৷
কিন্তু সাধারণ মানুষের তাঁর সম্পর্কে যা মনোভাব, তাতে অনুব্রত-হীন বোলপুরে কি তিনি আবার ঘাসফুল ফোটাতে পারবেন ? উত্তরের অপেক্ষায় সকলে ৷
আরও পড়ুন: