আরামবাগ, 18 সেপ্টেম্বর: মাথার ঘোমটা খুলে ফেলে, বেঁধে রাখা শিকল ভেঙে ঢাকের বোলে সাধারণের মন মাতাচ্ছে আরামবাগ সালেপুরের মহিলা ঢাকির দল। নারীদের পিছিয়ে থাকার দিন যদিও অনেকদিন আগেই শেষ, তাও গ্রামে-গঞ্জে অনেকক্ষেত্রেই মহিলাদের বিভিন্ন সময় অধিকাংশ কাজে বাধার মুখে পড়তেই হয়। সব বাধাকে ক্ষান্ত করে মনের আনন্দে ঢাক পেটাচ্ছেন কালীমাতা ঢাকি সম্প্রদায়ের মহিলা ঢাকিরা।
শরতের আকাশ ইতিমধ্যেই পুজোর আগমনী বার্তা দিয়ে দিয়েছে। এবার আরজি কর আবহে মানুষ পুজোর উৎসবে না-মাতলেও মা দুর্গার আগমনের আর বেশি দেরি নেই ৷ পঞ্চমী থেকে দশমী বেজায় ব্যস্ত ওই মহিলা ঢাকিরা। শুধু যে দুর্গাপুজো তা না, সারা বছর প্রতিটা পুজোতেই বায়না আসে তাঁদের। ঢাক নিয়ে মনের আনন্দে বেরিয়ে পড়ছেন তাঁরা। অন্যরুপী দুর্গা রূপে ঢাকের বোলে মন মাতাচ্ছে মহিলা ঢাকির দল।
ইতিমধ্যেই সংখ্যাটা 24, পাশাপাশি আরও কিছুজন প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। 5-7 টি জেলায় যায় এই দল। শুরুটা মোটেও মসৃণ ছিল না বলছেন তাঁরাই। বিভিন্ন বাধা অতিক্রম করে সফলতার শিখরেই প্রায় পৌঁছে গিয়েছে এই দল।
মহিলাদের ঢাকি হিসাবে পথচলা-
- হুগলি জেলার সালেপুর 1 নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের রামনগরের ঢাকিদের পথচলার শুরুটা হয়েছিল 1426 বঙ্গাব্দের 1লা আশ্বিন ৷ পাঁচ বছর হয়ে গেল তাঁদের কর্মজীবন ৷ শুরুর দিকে 'মহিলা ঢাকি'এই শব্দ শুনলেই হাসির রোল পড়ত। হাসির খোরাক হওয়ার ভয়েই পিছিয়ে যেতেন মহিলারা। পরে সকলের সমালোচনার ঊর্ধ্বে গিয়ে নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্য চিনে নিয়েছেন।
- ঢাকিদের প্রশিক্ষণ দেন দিলীপ কুমার দাস ও সুকুমার দাস। রামনগর পীরতলা ও বলরামপুরে মহিলাদের প্রশিক্ষণ হয় নিয়মিত। শুধু দুর্গাপুজোয় না সারা বছর নানা পুজোতেই ডাক আসে তাঁদের। 20-30 ধরনের বোল বাজান তাঁরা। রামনগর ও পার্বতীচকের মেয়েরাই মূলত ঢাক বাজাচ্ছেন ৷ শুধু এলাকাতেই না তার বাইরেও ডাক আসে তাঁদের। দুই দলে ভাগ হয়ে কাজ করেন তাঁরা। বছরে প্রায় 50 হাজারের বেশি আয় করেন এক একজন মহিলা। সংসার সামলে, লোকলজ্জার ভয় ত্যাগ করে, ঢাক বাজিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে দিচ্ছেন নিন্দুকদের দলে। রাত কিংবা দিন তোয়াক্কা না-করেই ঢাক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ঢাকির দল।
কী বলছেন মহিলা ঢাকিরা?
- ঢাকির দলের প্রথম মহিলা চম্পা মল্লিক ৷ তিনি বলেন, "প্রথমে স্বামী রাজি ছিলেন না। 100 দিনের কাজও বন্ধ হয়ে যায়। অগত্যা উপায় না-দেখে শুরু করেছিলাম। এখন ঢাক বাজিয়ে নিজেরা যেমন আনন্দ পাই তেমনই অন্যদের আনন্দ দিতে আমরা সক্ষম। তবে প্রথম দিলীপবাবুর কাছে এই প্রস্তাব শুনে হেসেছিলাম। বলেছিলাম শেষে ঢাক পেটাব? লোকে কী বলবে? লোকলজ্জার ভয় কাটিয়ে অনেক মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে এখন দিব্যি আছি।"
- আরও এক ঢাকি নমিতা দলুই বলছেন, এই কর্মসূত্রে আমরা যেরকম আনন্দ দিতে পারি তেমনি নিজেরাও আনন্দে মেতে উঠতে পারি। কর্মসূত্রে মণ্ডপ ও ঠাকুর দর্শনও হয়।
ঢাকির উদ্যোক্তারা কী বলছেন?
- এই দলের কর্তা বা উদ্যোক্তা দিলীপ কুমার দাস বলেন, "প্রথমে মহিলা ঢাকিদের একটি সংগঠন বানানোর প্রস্তাবে আমি হাসির খোরাক হয়েছিলাম ৷ তবে ক্রমেই আমার ডাকে সাড়া দেয় চম্পা ও লক্ষ্মী। আস্তে আস্তে আরও মেয়েরা যোগ দেয়। মূলত নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মহিলাদের নিয়েই এই দল। যারা দু'বেলা দু'মুঠো ভাতের সংস্থান করতে পরে না। দিন আনা, দিন খাওয়া যাদের হাঁড়ির হাল তাদের নিয়েই সংগঠন শুরু করি। প্রথমে সমাজের ভয়ে, লজ্জাতে কেউই বেরোতে চয়ত না। এমনকী লজ্জায় পালিয়ে যেত। তাঁরাই এখন আগ্রহী এই কাজে। তারকেশ্বর, ঘাটাল, বর্ধমান, আরামবাগ-সহ আরও অনেক জায়গা থেকেই তাঁদের বুকিং আসে। দু'টো টিমে ভাগ হয়ে বর্তমানে তারা কাজ করে।"
- এবিষয়ে ঢাকির শিক্ষক সুকুমার দাস বলেন, "শেখাতে খানিক বেগ পেতে হয়েছে ঠিকই, তবে কষ্টের ফল মিষ্টি তা মানতেই হবে। বর্তমানে এই কাজ করে মহিলারা যেমন খুশি তেমন মহিলাদের এই নতুন উদ্যোমে খুশি সাধারণ মানুষ। প্রথমে তাঁরা মাঠে ও লোকের বাড়িতে কাজ করত। এখন এই কাজে তাঁদের আয়ও যথেষ্ট ভালো হচ্ছে।"