বর্ধমান, 19 জুলাই: খড়গপুর আইআইটিতে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পড়তেই হাতে একে-47 তুলে নিয়েছিলেন অর্ণব দাম । মাওবাদী নেতা কিষাণজির ঘনিষ্ঠ অর্ণব দাম ওরফে বিক্রমের ভয়ে কাঁপত জঙ্গলমহল । সেই অর্ণব আজ বর্ধমান কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে দেশ বিদেশের ইতিহাস খুঁজতে গবেষণা শুরু করেছেন ।
অন্যদিকে, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়ে প্রেমিকের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে স্বামীকে খুন করেছিলেন মনুয়া মজুমদার । দু'জনেই এখন বর্ধমান কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে বসে জীবন নিয়ে নতুন করে বাঁচার রসদ খুঁজছেন । 15 অগাস্ট স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নাচের মাধ্যমে নিজেকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছেন মনুয়া মজুমদার ।
অর্ণব দামের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে । বিনপুরের শিলদা ইএফআর ক্যাম্পে মাওবাদী হামলা চালানোর অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে । 2010 সালে 15 ফেব্রুয়ারি শিলদা ক্যাম্পে মাওবাদী হামলার ঘটনা ঘটে । সেই হামলায় 24 জন ইএফআর কর্মীর মৃত্যু হয় । সেই মামলায় অর্ণব সহ 23 জনকে অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয় । এরপর জেল থেকে পরীক্ষা দিয়েই অর্ণব স্টেট এলিজিবিলিটি টেস্ট (সেট ) এ উত্তীর্ণ হন । গড়িয়ার বাসিন্দা অর্ণব দাম । তাঁর বাবা এসকে দাম ছিলেন প্রাক্তন বিচারপতি ।
অর্ণব ছোট থেকেই মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত । খড়গপুর আইআইটি থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করার সময় তিনটে সেমেস্টার দেওয়ার পরে তিনি ক্যাম্পাস থেকে পুরুলিয়া-ঝাড়খন্ড জঙ্গলে একে-47 চালানোয় হাত পাকায় অর্ণব। 2012 সালে আসানসোল থেকে ধরা পড়েন অর্ণব । তারপর জেলে আসার পরে তাঁর নতুন জীবন শুরু হয়। একে-47 ছেড়ে জেলে বসেই উচ্চশিক্ষার জন্য পড়াশোনা শুরু করেন । ইতিহাস নিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন । ইতিহাসে অনার্সে প্রথম শ্রেণিতে পাশ করার পরে স্নাতকোত্তর স্তরেও 66% নম্বর পেয়ে প্রথম শ্রেণিতে পাশ করেন অর্ণব । এরপর ইতিহাসে গবেষণা করার চিন্তাভাবনা আসে তাঁর মাথায় । সেইমতো বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার জন্য প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে প্রথম হন তিনি ।
ইতিহাস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সৈয়দ তানভীর নাসরিন বলেন, "অর্ণব দামকে সমাজের মূলস্রোতে ফেরানোর জন্য সরকার বিচারবিভাগ কারাবিভাগ, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় সকলের ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছে, তাকে সাধুবাদ জানাই । তাঁকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সমাজে আমাদের সকলের কর্তব্য।"
অন্যদিকে, 2017 সালের মে মাসে বারাসতের হৃদয়পুরের নিজের বাড়িতে খুন হয় অনুপম সিংহ । সেই ঘটনায় 2019 সালের 26 জুলাই বারাসতে অনুপম সিংহ হত্যা মামলায় অনুপমের স্ত্রী মনুয়া মজুমদার ও তাঁর প্রেমিক অজিত রায়কে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেয় বারাসত আদালত । বিভিন্ন সংশোধনাগার ঘুরে আজ বর্ধমান কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের চার দেওয়ালে তাঁর দিন কাটে । অন্যান্য আবাসিকদের সঙ্গে সাংস্কৃতিক চর্চায় মেতে ওঠেন তিনি । 2017 সালে খুনের ঘটনা আজ তাঁর কাছে অতীত । নৃত্যের মাধ্যমে নিজের অতীতকে ভুলতে চাইছেন তিনি । এর আগেও 'আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে' কিংবা 'আলোকের এই ঝরণা ধারায় ধুইয়ে দাও' এর গানের তালে মনুয়ার নৃত্য পরিবেশন দর্শকদের মন ভুলিয়েছে ।
পূর্ব বর্ধমান জেলা সংশোধনাগারে আবাসিকদের নৃত্য প্রশিক্ষণ দেন ডা. মেহবুব হাসান। মেহবুব হাসান বলেন, "দীর্ঘদিন ধরে আমি সংশোধানাগারে নৃত্য প্রশিক্ষণ দিচ্ছি । অন্যান্য আবাসিকদের যেখানে নাচের ছন্দ তোলাতে সময় লাগে সেখানে মনুয়াকে স্টেপ তোলানো অনেক সহজ । আসলে মনুয়া ছোট থেকেই নাচের মধ্যে আছে । নাচের প্রতি তাঁর একটা আলাদা ভালোবাসা আছে । সংশোধনাগারে মূলত রবীন্দ্রনৃত্য, আধুনিক গানের উপর নৃত্য, ফোক ড্যান্স নিয়ে চর্চা করা হয় । সেগুলো মনুয়া খুব তাড়াতাড়ি রপ্ত করে নেয় । অন্যদের সঙ্গে তার তফাত হচ্ছে অন্যান্যদের মতো তাকে শেখাতে বিশেষ পরিশ্রম করতে হয় না । আশা করি সংশোধনাগার থেকে ছাড়া পেয়ে ও যখন সমাজের মূল স্রোতে ফিরবে, তখন সে নৃত্য নিয়ে নিজের কেরিয়ার গড়ার কথা ভাবতেই পারে ।"