কলকাতা, 8 অগস্ট: বিতর্ক কখনও পিছু ছাড়েনি তাঁর। যখন মন্ত্রী ছিলেন তখনও যেমন আবার যখন মুখ্যমন্ত্রী তখনও। কেউ কেউ বলেন, সমনামের আরও একজনের মতো তিনিও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কতগুলো সামাজিক বাধাকে সরানোর চেষ্টা করেছিলেন ৷ সেই কারণেই হয়ত সময়ের সমালোচনা বারবার বিদ্ধ করেছিল তাঁকে।
তিনি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ছয়ের দশকের যুব আন্দোলনের নেতা। ছুটে বেড়াচ্ছিলেন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ৷ তৎকালীন সংবাদমাধ্যম বলতে খবরের কাগজ ৷ আর সেখানে এই সমস্ত খবর প্রকাশিত হত না। বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর থেকে উত্তরবঙ্গ, সংগঠনের কাজে দৌড়ে বেড়ানোর কাহিনি তাই সেভাবে লেখা নেই । সেকারণেই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে যখন বন্যাবিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শনে গিয়েছেন, পড়তে হয়েছে সমালোচনার মুখে।
2000 সালে তিরুবন্তপুরমে সিপিআইএমের বিশেষ সম্মেলনের শেষে কলকাতায় ফিরে জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিলেন ৷ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী হলেন। সেবার পুজোর সময় উত্তর 24 পরগনা ও নদিয়ায় ভয়ঙ্কর বন্যা । 'মুখ্যমন্ত্রী' বুদ্ধবাবু বন্যাত্রাণ পরিদর্শনে বেরিয়ে হঠাৎ মাঝরাস্তায় কনভয় থামিয়ে নেমে পড়লেন গাড়ি থেকে। একবার নয়, একাধিকবার। কথা বললেন গ্রামের গরিব মানুষগুলোর সঙ্গে, বন্যায় যাঁরা সব হারিয়েছেন । সমালোচনার উপরে উঠতে বেশি সময় লাগল না।
2006 সালের বিধানসভা নির্বাচন। তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ডাক দিলেন, 'হয় এবার। নয় নেভার।' কিন্তু বুদ্ধদেবকে বাজি ধরে ক্ষমতায় ফিরল বামফ্রন্ট। যে বুদ্ধদেব শিল্পপতিদের থেকে শতহাত দূরে থাকতেন, তিনিই তখন তাঁদের বন্ধু । তাঁর ডান হাত শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন। বুদ্ধবাবু বলতেন, "কিছু করতে পারি বা না পারি, সবার কথা শোনা দরকার। মানুষ কী বলতে চায়, আগে হয়ত এড়িয়ে যেতাম এখন সবার কথা শুনি। সমস্যা থাকলে সমাধানের চেষ্টা করি। না পারলেও মানুষ ভাবে, উনি চেষ্টা তো করছেন।"
তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের সময়কালে শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থান সবথেকে জরুরি বিষয় ছিল পশ্চিমবঙ্গে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পাখির চোখ করে এগোচ্ছিলেন এই দুটি বিষয় নিয়ে। একের পর এক শিল্প সম্মেলন বা বণিক মহলের সভায় ব্যস্ত বুদ্ধদেব। রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা বা কবিতা পাঠের অতটা সময় পান না। রাজ্যে তখন পরিচিত শব্দ 'ব্র্যান্ড বুদ্ধ'। তবে একটু সময় পেলেই আড্ডা থেকে কখনও বিমুখ হতে দেখা যায়নি, তা সেটা বিধানসভায় উপস্থিত থাকলে লবিতে, কিংবা জেলা সফরে গিয়ে। হাতে সিগারেট, ধবধবে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি আর পায়ে কোলাপুরি চটিতে আপাদমস্তক বাঙালি ৷ দমদমে জোড়া খুনের আসামি বাম নেতা দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে দিল্লিতে উপ-প্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবানির সঙ্গে সাক্ষাৎ - একবার আড্ডায় বসলে বুদ্ধদেব সবসময় অকপট। ইউপিএ-1 সরকার গঠিত হয় 2004 সালে। দিল্লিতে বদ্ধবাবুর কদর আরও বাড়ে । দেশের রাজধানী থেকে সিঙ্গাপুর, হায়দরাবাদ, কেরল, তামিলনাড়ু - সর্বত্রই তখন 'বুদ্ধবাবু আর ব্র্যান্ড বুদ্ধ'।
সংবেনদনশীল মনকে হঠকারী হিসেবে দেগে দেওয়া সহজ। তখন তিনি মুখ্যমন্ত্রী নন। 1993 সালের মাঝামাঝি বুদ্ধবাবু দুম করে জ্যোতি বসুর মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিলেন, ছেড়ে দিলেন সরকারি গাড়ি। মহাকরণ তো নয়ই, আলিমুদ্দিনমুখীও হলেন না বেশ কিছুদিন। কেন সেই ইস্তফা, কী বৃত্তান্ত, তা দীর্ঘ আলোচনার বিষয়। কিন্তু এত কিছুর মধ্যে একটা জায়গায় তাঁকে নিয়মিত সন্ধেবেলায় পাওয়া যেত ৷ নন্দনের তিনতলায় সত্যজিৎ রায় আর্কাইভের 300 বর্গফুটের একটা ঘরে। একটা বড় কাঠের টেবিল ঘিরে চামড়ায় মোড়া ছটা চেয়ার, টেবিলে দুটো রিমোট, একটা টেলিভিশন, একটা ডিভিডি চালানোর যন্ত্র আর একটা ফোন। পরে, ওই টেবিলের পাশে যোগ হয়েছিল একটা কম্পিউটার। দুধ-চিনি ছাড়া চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে এই ঘরেই বুদ্ধদেবের সন্ধ্যা কাটত - কখনও সিনেমায়, কখনও বইয়ের প্রুফ দেখে, আবার কখনও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিংবা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে নিখাদ আড্ডায়।
2007 সালের 14ই মার্চ। গুলি চলল নন্দীগ্রামে। পুলিশের গুলিতে 14 জনের মৃত্যু। সেদিন বিধানসভার অধিবেশন চলছিল, বুদ্ধবাবু নিজেও সভায় উপস্থিত ছিলেন। প্রথম খবর পেয়েই উদভ্রান্তের মতো বুদ্ধদেব ছুটে আসেন তৎকালীন স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিমের ঘরে ৷ ডেকে নেন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেনকে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে সেদিন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, "পুলিশ কিন্তু এতজন বলছে না ৷ ওরা পুলিশকে আক্রমণ করেছিল।" পরে সেই বুদ্ধদেবকে প্রকাশ্য সভায় বলতে শোনা গিয়েছিল, নন্দীগ্রামের ঘটনার জন্যে তিনিই "দায়ী"।
এককথায় নজিরবিহীন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর উত্তরসূরি হিসেবে শপথ নেওয়ার পর সাংবাদিক থেকে সাধারণ মানুষ, সকলের মনে প্রবল সংশয়, বাম আন্দোলনের পিতৃপুরুষের জুতোয় পা গলানো কি সহজ হবে ? পারবেন কী তিনি ? সংশয়-সন্ধিগ্ধতার জাল কেটে বেরিয়ে এসে উদাহরণ হয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
দলের সর্বোচ্চ কমিটির সদস্য। পরে অবশ্য প্রাক্তন। শারীরিক অসুস্থতার কারণেই নিজেকে সরিয়ে নেন ওই পদ থেকে ৷ শৈলেন্দ্র সরকার স্কুল থেকে পাশ করার পর প্রেসিডেন্সি কলেজ। আরও পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৷ অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ারে সাধারণ স্কুলের ছাত্র হিসেবে শুরু করে বিখ্যাত কলেজে পাঠ । সাদামাঠা শুরু থেকে একদম শীর্ষে ওঠা ছিল মেধা আর পরিশ্রমের ফসল। স্বাভাবিকভাবেই খুব কাছ থেকে চিনেছিলেন ওপরতলা আর নিচুতলার তফাৎ-পার্থক্য, ভালো-মন্দের দ্বন্দ্ব। 1967 থেকে 1972 রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন যেমন দেখেছিলেন, তেমনই মাত্র 36 বছর বয়সে কাঁধে চেপেছিল মন্ত্রিত্বের গুরুদ্বায়িত্ব। সেটা 1977 সাল ৷ রাজ্যের প্রথম বামফ্রন্ট সরকার।
দলের অভ্যন্তরে কান পাতলে এখনও শোনা যায়, প্রমোদ দাশগুপ্তর হাতেগড়া পাঁচ নবীন প্রজন্মের নেতার একজন ছিলেন বুদ্ধদেব ৷ সেটা তাঁর পড়াশোনা, সংগঠন চালানোয় গণতান্ত্রিকতা, বিরোধী মতের সহনশীলতা - এমন কারণে হতেই পারে ৷ তবে সমালোচকরা বলতেন, কোনওদিনই বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের বাঁধাধরা নিয়মশৈলীর বাইরে তিনি হাঁটেননি। যা বলেছেন, তা সরাসরি বলেছেন। বিতর্ক আর সমালোচনা সেকারণেই পিছু ছাড়েনি তাঁর। কখনও কঠোর শব্দ, কখনও আলাগা কিছু মন্তব্য বিতর্ক তৈরি করেছে। কখনও বলেছেন, আমরা 235 ওরা 30 ! আবার কখনও বলেছেন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঘটনা ব্যতিক্রম ।
বিতর্ক তাড়া করে বেড়িয়েছে, কিন্তু কখনও নিজের অবস্থান থেকে পিছিয়ে আসেননি। তাঁর সমালোচকরা বলেছেন এই পিছিয়ে না আসাই নাকি তাঁর সরকারের পতনের অন্যতম কারণ। কিন্তু অনড় থেকেছেন বুদ্ধদেব। সেটা সরকার পরিচালনাই হোক অথবা দলের নেতৃত্ব দেওয়ার প্রশ্নেই হোক। 36 থেকে 63 বছর বয়সে - মন্ত্রিত্ব থেকে মুখমন্ত্রী অবধি বুদ্ধদেব রয়ে গিয়েছেন তাঁর ঘোষিত জায়গায়।
কীভাবে মনে রাখা হবে আপনাকে ? একটা সাক্ষাৎকারে এই প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিলেন, "নেতা বা মন্ত্রী হিসেবে নয়, একজন ভাল মানুষ হিসেবে মনে রাখুক সবাই।" কখন বলছেন এমন কথা ? ২০১১ সালে রাজ্যে নির্বাচনের আগে। এমন একটা সময়ে, যখন বিরোধীরা রাজনৈতিকভাবে তাঁকে ছিঁড়ে ফেলছে, তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের বিরুদ্ধে তীব্র জনমত। সাক্ষাৎকারে ওই উত্তরের বাক্যটির শেষে বলেছিলেন, "...একজন যিনি চেষ্টা করেছিলেন রাজ্যে শিল্পস্থাপন করতে, ছেলেমেয়েদের কাজের নিরাপত্তা দিতে ।" ইতিহাস সাক্ষী থেকেছে, তিনি সবটা বোঝাতে পারেননি। না দলকে, না ফ্রন্টকে, না বিরোধীদের। আবারও সেই মধ্যপন্থার সমঝোতা - মধ্যবিত্তের পিছুটান। সর্বক্ষণ চেয়েছেন যুযুধান দু'পক্ষকে বুঝিয়ে ঐকমত্য তৈরি করতে। কখনও পেরেছেন ৷ কখনও পারেননি।
ওরহান পামুকের ভক্ত ছিলেন পাঠক বুদ্ধদেব ৷ ছিলেন লাতিন সাহিত্যের অনুরাগী। তাঁর পূর্বসূরি (জ্যোতি বসু) বলতেন, "ওসব কালচার-টালচার বুদ্ধ বোঝে।" রাজনীতিক বুদ্ধদেব আর সাহিত্যের পাঠক বুদ্ধদেব কি আলাদা ? মায়াকোভস্কির কবিতার অনুবাদক বুদ্ধদেব আর শিল্প-সম্ভাবনা খুঁজে চলা বুদ্ধদেব কি ভিন্ন ? এ নিয়ে বিতর্ক চলবেই। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের রাজনীতি করতেন, কিন্তু কোনওদিন দ্বন্দ্বকে বিরোধিতার অঙ্গনে আনেননি।
বারবার বলতেন শতফুল বিকশিত হোক । শত বিতর্কের মধ্যে থেকেও জীবনের আলো খুঁজেছেন বুদ্ধদেব। নাড়া দিতে চেয়েছেন জড়তার মস্তিষ্ককে । কৃষি-শিল্পের মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন কাজের শক্তি হিসেবে । আর এইখানেই রাজনীতির কাছে খানিকটা হেরে গিয়েছিলেন বুদ্ধদেব। কিন্তু, তাঁর সাদা পোশাকে কেউ এক ফোঁটা কালির দাগ খুঁজে পাননি শেষদিন পর্যন্ত। না ক্ষমতায় থাকাকালীন, না ক্ষমতাহীন ঘরোয়া জীবনে। আদ্যন্ত সাদামাটা জীবনে বিশ্বাসী বুদ্ধদেব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বোধের রাজনীতি আর বোধহীন নৈরাজ্যের পার্থক্য। পরিবর্তনের গতি সব সময়েই বোধের দিকে। মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকে সরে গেলেও প্রাক্তন হিসেবে বিন্দুমাত্র কোনও সুযোগ কোনওদিন নেননি ৷ আজীবন দু'কামরার ফ্ল্যাটে কাটিয়ে স্বেচ্ছায় ফিরিয়ে দিয়েছেন সরকারি সব সুবিধা। বুদ্ধদেব নেই। বুদ্ধ-বোধের রাজনীতিটা হয়ত রয়ে গেল।