কলকাতা, 21 ফেব্রুয়ারি: আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে ভালো খেলবে, এই প্রত্যাশা যশস্বী জয়সওয়ালকে ঘিরে তাঁর ছোটবেলার কোচ জ্বালা সিংয়ের ছিল ৷ কিন্তু, ছাত্র যে পরপর দু’টি ডাবল সেঞ্চুরি করবেন, তা স্বপ্নেও ভাবেননি তিনি ৷ ইটিভি ভারতকে ফোনে দেওয়া একান্ত সাক্ষাতকারে সে কথাই জানালেন যশস্বীর কোচ ৷
কেরিয়ারের শুরুতেই এই পারফরম্যান্স যশস্বী করবেন বলে আশা করেছিলেন ?
দেখুন প্রত্যাশা একটা ছিল ৷ ছোট থেকেই ও যখন যেখানে খেলেছে সেখানেই ভালো খেলেছে ৷ যে দলেই খেলেছে বড় বড় রান করেছে ৷ তাই একটা প্রত্যাশা ছিল, দেশের হয়ে খেলবে এবং বড় রান করবে ৷ কিন্তু, দু’টো পরপর ডাবল সেঞ্চুরি করবে মানে একটা আলাদা কিছু করে ফেলেছে ৷ রেকর্ড গড়া এক জিনিস ৷ ভালো খেলা আলাদা ব্যাপার ৷ পরপর ডাবল সেঞ্চুরি প্রত্যাশার বাইরে ছিল ৷ রান করছে, আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটেও রান করছে ৷ তাই ওর রান করাটা আমার কাছে বিস্ময়ের নয় ৷
'বাজবল' ক্রিকেট নিয়ে সিরিজ শুরুর আগে অনেক বলা হচ্ছিল ৷ এখন 'যশবল' ক্রিকেটে সিরিজটা পরিণত হয়েছে ৷ ডাবল সেঞ্চুরির পরে ছাত্রের সঙ্গে কি কথা হয়েছে ?
না, আমার সঙ্গে কথা হয়নি ৷ খেলা চলাকালীন কোনও কথা আমি বলি না ৷ পরে দেখব ৷ সিরিজটা শেষ হোক, তখন আমি ডাকব ৷ কথা বলব ৷ এখন ভারতীয় দলে অনেক বড় বড় কোচ রয়েছেন ৷ তাঁদের পরামর্শ পাচ্ছে ৷ ব্যাটিং কোচ, বোলিং কোচ, অধিনায়ক রয়েছেন ৷ ওরা ওকে পরামর্শ দিচ্ছেন ৷ সেই কারণেই ভালো খেলছে ৷
বড় বড় কোচের রয়েছে ৷ কিন্তু আপনি ওকে তৈরি করেছেন ৷ তাই আপনার পরামর্শ সবসময়ই তো মূল্যবান ৷ ঠিক কি না ?
ও যখন পারফরম্যান্স করতে পারে না, তখন আমি পরামর্শ দিয়ে থাকি ৷ যখন পারফর্ম করছে তখন পরামর্শের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না ৷ যখন যশস্বী মানসিকভাবে তলানিতে থাকে, রান করতে পারে না, তখন আমি ওর সঙ্গে কথা বলি ৷ মোটিভেট করে থাকি ৷ অতীতে যে সব নিয়ে আলোচনা করেছিলাম সেগুলি বলি ৷ তবে, এখন তো প্রয়োজন নেই ৷ যখন ঠিকঠাক চলে না, তখন আমি কাজে আসি ৷ এখন অনেক লোক আছে ওখানে যারা সামলে দিচ্ছে ৷
আর্ন্তজাতিক ক্রিকেট খেলছে ৷ রান পাচ্ছে ৷ তা সত্ত্বেও আপনার চোখে কি কোনও টেকনিক্যাল ঘাটতি চোখে পড়েছে ?
এখন টানা রান করে চলেছে ৷ এই অবস্থায় টেকনিক্যাল বা মানসিক দিক দিয়ে আধিপত্য দেখাচ্ছে ৷ আপনি শুরুতেই বলেছেন 'যশবল' ক্রিকেট খেলছে যশস্বী ৷ আজ আপনারা যে ব্যাটিং যশস্বীর দেখছেন, তা নিয়ে আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা একসময় কাজ করেছি ৷ ও যখন আমার কাছে এসেছিল তখন প্রাথমিকভাবে কী করতে হবে, সে বিষয় নিয়ে কোনও ধারনা ছিল না ৷ তারপর থেকে পরামর্শ দিয়ে আমি ঠিক করেছি ৷ ক্রিকেটীয় শট খেলার ওপর জোর দিতে বলেছি ৷ যে কোনও ক্রিকেটে নয় জনই ফিল্ডার থাকবে ৷ তাদের মধ্যে দিয়ে গ্যাপ খুঁজে বা তাদের উপর দিয়ে বল মেরে আপনাকে রান করতে হবে ৷ ওই সব নিয়ে আমি কাজ করেছি ৷
যখন যশস্বী অনূর্ধ্ব-19 দলে ছিল, তখন টেকনিক নিয়ে কাজ করেছিলাম ৷ অনূর্ধ্ব-19 বিশ্বকাপে ও ছিল ৷ তারপর করোনা অতিমারি শুরু হল ৷ লকডাউনের সময় আমরা হতাশ হয়ে পড়েছিলাম ৷ তারপরেই আইপিএল চলে এসেছিল ৷ সেখানে যশস্বী রান করতে পারেনি ৷ সেইসময় হতাশ হয়ে কাঁদত, আর বলত ক্রিকেট জীবন শেষ হয়ে গিয়েছে ৷ ওই সময় ওকে ফের গড়ে তুলি ৷ কুড়ি-পঁচিশ দিন ওকে টি-20 ক্রিকেট কীভাবে খেলতে হয়, তা শিখিয়েছিলাম ৷ কোথা দিয়ে বল মারতে হয় ? ফাস্ট বোলারদের কীভাবে সামলাতে হবে ? তা শিখিয়ে ছিলাম ৷
আইপিএলে প্রথমবার খেলতে গিয়ে ট্রেন্ট বোল্টের বিরুদ্ধে গতিতে পরাস্ত হচ্ছিল ৷ তারপর সেটা নিয়ে কাজ করেছিলাম আমরা ৷ সেখান থেকেই বদলটা শুরু হয়েছিল ৷ আমরা সেইসময় ব্যাটিং টেকনিক নিয়ে প্রচুর কাজ করেছি ৷ মানসিকতার উন্নতির জন্য কাজ করেছিলাম ৷ সেই গড়ে ওঠার পরিশ্রমের ফল আপনারা দেখতে পাচ্ছেন ৷ আইপিএলে যখন যায়, তখন কোচেরাও ওকে নিয়ে কাজ করেছে ৷ আমি মনে করি 2021-22 সালে আমি ওকে পুরো তৈরি করে দিয়েছিলাম ৷ তারপর বড় ক্রিকেটারদের কাছে গিয়ে পরামর্শ পেয়েছে ৷ আমার মনে হয় না টেকনিক নিয়ে কাজ করার আরও কিছু আছে ৷
আমার মনে হয় যেবার প্রথম আইপিএল খেলেছিল, তখন চ্যালেঞ্জটা এসেছিল ৷ রানই করতে পারছিল না ৷ মনে হয়েছিল আইপিএলে ওকে আর নেবে না ৷ ওর প্রথম ও দ্বিতীয় আইপিএলের মাঝের সময়ে আমরা প্রচুর পরিশ্রম করেছি ৷ প্রচুর প্র্যাকটিস করেছি ৷ ওই সময় প্লাস্টিক বলে ওকে প্র্যাকটিস করাতাম ৷ আর বলতাম প্রচুর মারতে ৷ আমার মনে হয় ওর প্রথম ও দ্বিতীয় আইপিএলের মাঝের সময়ে যে পরিশ্রম করেছিলাম তার জন্যই এখন ভয়ডরহীন ক্রিকেট যশস্বী খেলতে পারছে ৷
সেই সময় ও বলত আইপিএল, টি-20 কীভাবে খেলতে হয়, বুঝতে পারছে না ৷ আমি তখন ইতিবাচক মানসিকতা বজায় রাখার কথা বলতাম ৷ কীভাবে খেলতে হবে, কোন বোলারের বিরুদ্ধে কী কৌশল নিতে হবে, তা দ্বিতীয় ভাগ ৷ যেকোনও বোলারের বিরুদ্ধে মানসিকভাবে ইতিবাচক থাকা জরুরি ৷ বোলারকে বুঝতে দিলে চলবে না, আমি ভয় পাচ্ছি ৷ ইতিবাচক থাকতে হবে মানসিকভাবে ৷ আপনি দেখুন জেমস অ্যান্ডারসনকে যশস্বী তিনটে ছয় মেরেছে ৷ এটা সম্ভব হয়েছে টেকনিক, মানসিক এবং শারীরিকভাবে ইতিবাচক থাকার কারণে ৷
দুই দিন আগে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন যশস্বী জয়সওয়ালের হাতে ভারতীয় ক্রিকেটের ভবিষ্যত ৷ সব ধরনের ক্রিকেটেই ওর খেলার ক্ষমতা রয়েছে ৷ এই ব্যাপারে আপনি কী বলবেন ?
দাদা যখন বলেছে, তখন তো গুরুত্ব দিতেই হবে ৷ দেশের সেরা ক্রিকেটারদের অন্যতম ৷ অধিনায়কদের মধ্যেও অন্যতম সেরা ৷ ওনার ক্রিকেটীয় জ্ঞান প্রচুর ৷ যশস্বীর মধ্যে কিছু দেখেছেন বলেই বলেছেন ৷ ক্রিকেটে ভবিষ্যত বলে কিছু নেই ৷ বর্তমানেই যা কিছু হয় ৷ তবে ওকে যদি এগোতে হয়, দাদার মতো হতে হয়, শচিন তেন্ডুলকরের মতো হতে হয়, তাহলে পরিশ্রম ধারাবাহিকভাবে করে যেতে হবে ৷ তাহলেই যশস্বী আরও উপরে, ওই পর্যায়ে পৌঁছতে পারবে ৷
যশস্বীর মানসিক কাঠিন্য কি ওর বেড়ে ওঠার মধ্যে লুকিয়ে ?
যখন যশস্বী মুম্বইতে এসেছিল তখন ছোট ছিল ৷ ওই সময় ওকে সমর্থন বা পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ ছিল না ৷ কোথাও একটা জীবন সংগ্রাম ছিল ৷ তবে, 2013 সালে আমার কাছে আসার পরে, ওকে কোনও কষ্টের মধ্যে পড়তে হয়নি ৷ আমি নিজের সন্তানের মতো করে যশস্বীকে বড় করেছি ৷ 1995 সালে আমি উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর থেকে মুম্বই এসেছিলাম ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ৷ আমি প্রচুর কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছি ৷ আমার কঠিন সময়ের কথা ওকে বলতাম ৷ আমি যে কষ্ট করেছি, তা যাতে যশস্বীকে করতে না হয়, সেটা দেখতে বলতাম ৷ কষ্ট আমি করব, তুই শুধু খেলে যা বলতাম ৷
অনেক ক্রিকেটার আছে যারা প্রতিভাবান হয়েও কিছু করতে পারেনি ৷ আবার অনেকে দারুণ শুরু করেও হারিয়ে গিয়েছে ৷ আমি সেইসব গল্প বলতাম ৷ যখন খেলত তখন সবসময় ওর পরীক্ষা নিতাম ৷ মানসিকভাবে উদ্বুদ্ধ করতাম আমি ৷ এটায় সফল হলে এই জিনিসটা দেব বলতাম ৷ মুম্বইয়ের হয়ে খেলা সবসময়ই কঠিন ৷ মুম্বই দলে ভালো পারফরম্যান্স না করে টিকে থাকা যায় না ৷ ভারতীয় দলে ঢুকে পড়া জরুরি ৷ ভারতীয় দলে না খেলে মুম্বই দলে টিকে থাকা কঠিন ৷ দীর্ঘসময় ভারতীয় দলে না খেললে, মুম্বইতে টিকে থাকা যায় না ৷
যশস্বী অনেক ছোটবেলা থেকে বড়বড় ক্রিকেটাদের দেখে বেড়ে উঠেছে ৷ যশস্বীর দারিদ্রতা নিয়ে কথা অনেকেই বলেন ৷ 2013 সালের পরে ওকে, কোনও কষ্টের মধ্যে থাকতে হয়নি ৷ বিশ্বমানের ক্রিকেটীয় পরিকাঠামো আমার অ্যাকাডেমিতে যশস্বী পেয়েছে ৷ ওয়াসিম জাফর আমার খুব ভালো বন্ধু ৷ আমি ওকে প্র্যাকটিস করাতাম ওয়াসিমদের সঙ্গে ৷ বলতাম ওর মতো ব্যাট করতে ৷
যশস্বী জয়সওয়াল দারিদ্রতার মধ্যে দিয়ে বড় হয়নি ৷ ওর কষ্টের জীবন অনেক আগের ৷ যখন কেউ দেখত না ৷ মা-বাবা দেখত না ৷ আমি যশস্বীকে সেরা সুবিধার মধ্যে দিয়ে তৈরি করেছি ৷ ওয়াসিম জাফর, দিলীপ বেঙ্গসরকর এবং অনেক বড় বড় ক্রিকেটারের সঙ্গে মেশার সুযোগ পেয়েছে ৷ মুম্বই রঞ্জি দলের হয়ে যাঁরা খেলছেন, তাঁদের সঙ্গে প্র্যাকটিস করেছে ৷ যশস্বী মুম্বই লিগের কনিষ্ট ক্রিকেটার হিসেবে খেলেছে ৷ কাঙ্গা লিগে ওকে খেলাত না ৷ প্রচুর ঝামেলা হয়েছিল ৷ আমি সংশ্লিষ্ট অধিনায়কদের সঙ্গে পাঙ্গা নিয়েছি ৷ আমি বলতাম একটা সুযোগ দিন ৷ যশস্বী সমস্ত সুবিধা পেয়েছে ৷
কোচের লড়াই কি যশস্বীর অনুপ্রেরণা ?
আমি 1995 সালে মুম্বইতে এসেছিলাম ৷ আচেরকর স্যারের অ্যাকাডেমিতে ছিলাম ৷ সারদাশ্রম স্কুলে ছিলাম ৷ কিন্তু পেশির চোটে আমি ছিটকে যাই ৷ তারপর থেকেই আমি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে এসেছি ৷ ক্রিকেটার তৈরি করার পরিকল্পনা নিই ৷ আমি সবসময় আমার কঠিন সময়ের কথা বলতাম ৷ শুধু খেলে যাওয়ার কথা বলতাম ৷ বাকিটা আমি দেখে নেওয়ার কথা বলতাম ৷ এখন ভারতের হয়ে খেলছে তাতে আমি দারুণ খুশি ৷
আরও পড়ুন: