কলকাতা, 15 ডিসেম্বর: ঘরে-বাইরে সমালোচনার মুখে কলকাতার মেয়র তথা রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম ৷ বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে দলের অন্দরে তো তিনি সমালোচনার মুখে পড়েছেন ৷ পাশাপাশি বিজেপি ও কংগ্রেসের তরফে তাঁর মন্তব্যের সমালোচনা করা হয়েছে ৷ ফিরহাদের মন্তব্যের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন কার্তিক মহারাজ ৷ এমনকী, রাজভবনে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে এই নিয়ে সমালোচনা করেন কেরালার রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খানও ৷
উল্লেখ্য, শনিবার ‘ফিরহাদ 30’ নামে এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন কলকাতার মেয়র ৷ সেখানে তিনি বলেন, "পশ্চিমবঙ্গে আমরা 33 শতাংশ রয়েছি ৷ আর গোটা দেশে 17 শতাংশ ৷ তাই আমাদের সংখ্যালঘু বলা হয় ৷ কিন্তু, আগামিদিনে আমরা আর সংখ্যালঘু থাকব না ৷ আমরা সংখ্যাগুরু হব ৷ এখন আমাদের সঙ্গে অন্যায় হলে, রাস্তায় বিচারের দাবিতে মোমবাতি হাতে মিছিল করি ৷ কিন্তু, এমন দিন আসবে যখন আমরা বিচার দেব ৷ আমাদের সেই জায়গায় পৌঁছতে হবে ৷"
সেই নিয়েই বিতর্ক তৈরি হয় ৷ শনিবারই এই নিয়ে সমালোচনায় সরব হয়েছিলেন বঙ্গ বিজেপির সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার ৷ কিন্তু রবিবার ফিরহাদ দলের অন্দরেই সমালোচনার মুখে পড়েন ৷ এই নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেন প্রাক্তন আইপিএস তথা ডেবরার বিধায়ক তৃণমূলের হুমায়ুন কবীর ৷
তিনি লেখেন, “জিন্দেগি লম্বি নেহি, বড়ি হোনি চাহিয়ে হুজুর হামিকজি ৷’’ যার অর্থ - জীবন দীর্ঘ নয়, জীবনের ব্যপ্তি বেশি হওয়া উচিত ৷ এখানে তিনি সরাসরি ফিরহাদ হাকিমের নাম লেখেননি ৷ তবে তিনি ইঙ্গিত যে কলকাতার মেয়রকে করেছেন, তা বলাই বাহুল্য ৷
হুমায়ুন অবশ্য এটুকু বলেই থামেননি ৷ তিনি আরও লিখেছেন, ‘‘কোয়ান্টিটি নয় কোয়ালিটি চাই- 5 বাচ্চা - রিক্সাওয়ালা, সবজিওয়ালা, ঠেলাওয়ালা, পরিযায়ী শ্রমিক, হকার না হয়ে দু’বাচ্চা শিক্ষক-ডাক্তার নিদেনপক্ষে আমার মতো পুলিশ হাওয়া ভালো নয় কি ?’’
আরেক তৃণমূল বিধায়ক, যাঁরও নাম হুমায়ুন কবীর, তিনিও এই নিয়ে সমালোচনা করেছেন ৷ মুর্শিদাবাদের ভরতপুরের বিধায়ক হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘‘এই ধরনের মন্তব্য করা উচিত নয় । ওঁর আরও বেশি কোরান-হাদিস পড়া উচিত । কারণ, আগামিদিনে সর্বময় ঈশ্বর কোনও সম্প্রদায়ের গর্ভে কত সন্তান পাঠাবেন আমরা জানি না । বর্তমানে বাংলায় মুসলিম পপুলেশন 35 শতাংশ । 30 শতাংশ ভোটার । মুর্শিদাবাদে হিন্দু-মুসলিম কত সবাই জানে । কিন্তু আগামী 20 বছরে সনাতন না মুসলিম সম্প্রদায় বাড়বে, আমরা কেউ জানি না । তাই এই মন্তব্য করা উচিত হয়নি ।’’
তবে তাৎপর্যপূর্ণভাবে ফিরহাদের সমালোচনা না-করে কার্যত পাশে দাঁড়িয়েছেন কুণাল ঘোষ ৷ তিনি বলেন, ‘‘ফিরহাদ হাকিম ঠিক কী বলেছেন, পুরোটা একবার দেখে নিন ৷ গোটা মুসলিম সমাজ, নতুন প্রজন্ম, তাঁদেরকে আরও বেশি করে শিক্ষিত করা, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা, তাঁদের গুণমান বাড়ানো, সরকারের বিভিন্ন জায়গায় আরও বেশি করে অংশগ্রহণ, সেটা নিয়ে তিনি বলছিলেন, বলতে বলতে তিনি ওই ধরনের একটা বাক্য গঠন করেছেন, যা নিয়ে বিরোধীরা বিকৃত প্রচার করছে ৷’’
তাই তৃণমূলের দুই হুমায়ুন কবীরকে তিনি অনুরোধ করেছেন যে এমন কিছু যাতে তাঁরা না-বলেন, যা থেকে বিরোধীরা আবার তৃণমূলের সমালোচনার সুযোগ পেয়ে যায় ৷ একই সঙ্গে তিনি ফিরহাদ হাকিম ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বলেও অবিহিত করেছেন ৷ যদিও বিরোধীরা যে এই যুক্তি মানতে নারাজ, তা স্পষ্ট হয়েছে বহরমপুরের প্রাক্তন সাংসদ কংগ্রেসের অধীররঞ্জন চৌধুরী ও বিজেপির আইনজীবী নেতা তরুণজ্যোতি তিওয়ারির কথায় ৷
এদিন বহরমপুরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে অধীর বলেন, ‘‘এটা উস্কানিমূলক মন্তব্য । এতে দিদিরও (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) সায় আছে, মোদিরও সায় আছে । দিদি আর মোদির সমঝোতা গেম চলছে । দিদির বিধায়ক সাম্প্রদায়িক কথা বলছেন । দিদির আর এক বিধায়ক বাবরি মসজিদ তৈরির কথা বলছেন । দলের মন্ত্রী উস্কানিমূলক কথাবার্তা বলছেন । মন্ত্রীকে সংযত করা উচিত ।’’ তাঁর আরও দাবি, ‘‘বাংলাদেশে যা চলছে, তা এখানে আনার চেষ্টা চলছে । এই চেষ্টা তারাই করছে, যারা রাজনীতির কারবারি । আমরা রাজনীতির কারবারি নই । আমরা মানুষের হয়ে কাজ করি ।’’
বিজেপির তরুণজ্যোতি তিওয়ারি সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, ‘‘...বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ‘সেকুলারিজমের মশাল’ হাতে নিয়ে পথে নামে, কিন্তু সেই মশালটি শুধু একদিকেই আলো দেয় । তাদের সেকুলারিজম এমন এক চশমা, যেটা দিয়ে শুধু হিন্দুদের ভুল দেখা যায়, আর অন্য সম্প্রদায়ের ভুলগুলো কেমন জানি অদৃশ্য হয়ে যায় ।... ওই সেকুলারিজমের মশালধারীরা কলকাতার মেয়রের এই বক্তব্য নিয়ে কী বলে, তা শোনার ইচ্ছা থাকল ।’’
এদিকে রবিবার রাজভবনে এক বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসেছিলেন কেরালার রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খান ৷ তিনিও এই নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেন ৷ তাঁর মন্তব্য, ‘‘যেটা সংবিধানের বিরুদ্ধে সেটাকে ভর্ৎসনা করা যেতে পারে । বিভাজনমূলক মন্তব্য গণতন্ত্রের জন্য অস্বাস্থ্যকর ৷’’
অন্যদিকে এদিন শিলিগুড়িতে ‘লক্ষ কণ্ঠে গীতা পাঠ’ অনুষ্ঠানে যোগ দেন কার্তিক মহারাজ ৷ তিনি মঞ্চ থেকেই ফিরহাদের বক্তব্যের সমালোচনা করেন ৷ তাঁর কথায়, ফিরহাদ হাকিম তো বলতে পারেন যে শিক্ষিত হয়ে ভারতকে এক নম্বরে স্থানে নিয়ে যাবেন সংখ্যালঘুরা ৷ কিন্তু সেকথা কলকাতার মেয়র কেন বলেননি, সেই প্রশ্নই কার্যত তুলেছেন কার্তিক মহারাজ ৷