ঘাটাল, 22 মে: পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার 32 নম্বর ঘাটাল লোকসভা কেন্দ্র ৷ রাজনৈতিক টানাপোড়েন, দলাদলি, হিংসা এই সবের উর্ধ্বে, এই লোকসভা কেন্দ্রে নির্বাচনের এক ও একমাত্র ইস্যু 'ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান' ৷ গত আট দশক ধরে শুধুই গালভরা প্রতিশ্রুতি ৷ 'ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান' একটা নামই রয়ে গিয়েছে ৷ যার বাস্তব রূপ এখনও চাক্ষুস করতে পারেননি ঘাটাল তথা দুই মেদিনীপুরের বন্যা পীড়িত মানুষগুলি ৷
25 মে এই কেন্দ্রে আরও একটি নির্বাচন হতে চলেছে ৷ সেই নির্বাচনে যুযুধান দুই প্রতিপক্ষ তৃণমূলের তারকা প্রার্থী তথা বিদায়ী সাংসদ দীপক অধিকারী ওরফে দেব ৷ আর তাঁর বিপক্ষে রয়েছেন বিজেপি প্রার্থী টলিউডের প্রাক্তন তারকা তথা খড়গপুর সদরের বিধায়ক হিরণ্ময় চট্টোপাধ্যায় ৷ আর এই দুই যুযুধান প্রতিপক্ষের লড়াইয়ের বাইরে বাম-কংগ্রেস জোটপ্রার্থী হিসেবে লড়ছেন সিপিআই-এর তপন গঙ্গোপাধ্যায় ৷
দেবের কাছে নির্বাচনে লড়াই করার ইস্যু বলতে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্প ৷ কিন্তু, সাংসদ হিসেবে দেব কী করেছেন ? মানুষের কাছে ভোট চাইতে গিয়ে কী বলছেন তিনি ? ঘাটাল লোকসভার একমাত্র সমস্যা 'ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান' ৷ 2014-2024 সাল, 10 বছরের সময়কালে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানকে বাস্তবায়িত করতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি ৷ তবে, এই ব্যর্থতা শুধু তাঁর একার নয় ৷ 1959 সাল থেকে এই ব্যর্থতা জারি রয়েছে ৷ ঠিক যেদিন মানসিং কমিটি 'ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান'-এর প্রস্তাব দিয়েছিলেন ৷ সেই পঞ্চাশের দশকে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে অবিভক্ত মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল শিলাবতী, ঝুমি ও কংসাবতীর জলে প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল ৷ বর্ষায় এই তিন নদী প্লাবিত হলে, তার জল যাতে রূপনারায়ণ নদ দিয়ে বের করে দেওয়া যায়, সেই পুরো প্রকল্পের নামই দেওয়া হয়েছিল, 'ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান' ৷
কিন্তু, সেই প্ল্যান খাতায় কলমেই রয়ে গিয়েছে ৷ মাঝে বাম আমলে 1983 সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এই প্রকল্পের শিলান্যাস করেছিলেন ৷ কিন্তু, সেই পর্যন্ত ইতি হয়ে যায় ৷ পরবর্তী সময়ে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের দাবিতে সেখানকার মানুষ বৃহত্তর আন্দোলনে নেমেছেন ৷ কিন্তু, সেই আন্দোলনেও কোনও ফল হয়নি ৷ প্রতি বর্ষায় আজ একতলা বাড়ি সমান জলে ডুবে থাকে ঘাটালবাসী ৷ নৌকা একমাত্র যাতায়াতের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায় ৷ এই পরিস্থিতিতে বিদায়ী সাংসদ দেব আগেই স্বীকার করে নিয়েছিলেন, তিনি ব্যর্থ হয়েছেন ৷ সেই ব্যর্থতার গ্লানি থেকে রাজনীতিও ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন ৷ তবে, তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের কথায় ফের নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন দেব ৷
প্রচারে নেমে দেবের হাতিয়ার করোনার সময় মাঠে নেমে ঘাটাল লোকসভার মানুষের হয়ে কাজ ৷ সঙ্গে জিতলে ফের একবার ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে লড়াই করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন দেব ৷ তবে, দেবের হয়ে প্রচারে এসে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করে গিয়েছেন, ঘাটাল লোকসভায় তৃণমূল জিতে আসলে, আগামী 31 ডিসেম্বরের আগে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের কাজ শুরু হয়ে যাবে ৷ উল্লেখ্য, 2024-25 রাজ্য বাজেটেও ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের কথা উল্লেখ করেছে সরকার ৷
অন্যদিকে, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত হিংসা ও রক্তের রাজনীতির অভিযোগ তুলছেন ঘাটাল লোকসভার বিজেপি প্রার্থী ৷ কেশপুর, ঘাটাল, ডেবরা অঞ্চলে দেবের নেতৃত্বে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা বিজেপি কর্মীদের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন হিরণ ৷ এমনকি তৃণমূল প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সৌজন্য এবং আড়ালে রক্তের রাজনীতির অভিযোগ তুলেছেন তিনি ৷ তবে, উন্নয়ন বা ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে সেভাবে প্রচারে কথা বলতে শোনা যাচ্ছে না বিজেপি প্রার্থীকে ৷ যা নিয়ে রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব জানে যে, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে কেন্দ্র থেকেই অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না ৷ তাই প্রচারে এনিয়ে মুখ খুলছে না তাঁরা ৷
এবারেও বাম-কংগ্রেসের জোট প্রার্থী হয়েছেন সিপিআই-এর তপন গঙ্গোপাধ্যায় ৷ গতবার তৃণমূল ও বিজেপি প্রার্থীর ধারে কাছে পৌঁছাতে পারেননি ৷ এই লোকসভাতেও লড়াইয়ের ময়দানে তাঁকে নিয়ে খুব একটা হইচই নেই ৷ তবুও, নিজের মতো করে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন ৷ গরিব কৃষক, দিনমজুর ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলছেন ৷ তাঁদের সমস্যার কথা শুনছেন ৷ আর ভোটে জিতে সংসদে তাঁদের কথা তুলে ধরার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন ৷ তবে, ঘাটাল লোকসভার কুর্সির দৌড়ে তিনি কতটা আছেন ? তা নিয়ে নিজেও হয়তো সন্দিহান ৷ তবে, শেষ জবাবটা দেবে জনতা জনার্দন ৷ তাই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের সাফল্যের 'কুর্সি'-তে কে বসবেন ? তার জবাব মিলবে 4 জুন ৷
আরও পড়ুন: