গত 14 নভেম্বর পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান 'চুরি করা ম্যান্ডেট, অন্যায্য গ্রেফতার এবং একটি বিতর্কিত সাংবিধানিক সংশোধনী পাশের' বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে তাঁর সমর্থকদের চলতি মাসের 24 তারিখে ইসলামাবাদে সমাবেশ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন ৷ উল্লেখ্য, ওই সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চতর আদালতে বিচারক নিয়োগের উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত হয়েছে । ফলে আদালতের রায়কে এবার প্রভাবিত করা যাবে ।
সরকারকে তাঁর শর্তে ইমরানকে মুক্তি দিতে বাধ্য করার জন্যই মূলত এই বিক্ষোভ । তাঁর আহ্বানে পাকিস্তানের সমস্ত অংশ থেকে কনভয় ইসলামাবাদে একত্রিত হতে শুরু করে ৷ এমনকি একটি কনভয় আসে যৌথভাবে তাঁর স্ত্রীর নেতৃত্বে । সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য কনভয়গুলি সমস্ত বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হয় । পুলিশও পিছু হটতে বাধ্য হয় ।
সেনাবাহিনীর সমর্থনে রাষ্ট্র (পাকিস্তান) বিক্ষোভ থামানোর সমস্ত প্রচেষ্টা করেছে ৷ যার মধ্যে কন্টেনার স্থাপন করা, বিক্ষোভকে অবৈধ ঘোষণা করা এবং আধা-সামরিক বাহিনী নিয়োগ করাও ছিল ৷ অনেক পিটিআই কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়, মিডিয়া কভারেজ সীমিত করা হয় এবং ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়াও বন্ধ করা হয় ।
বিক্ষোভ থামানোর আশায় সরকার ইসলামাবাদকে দেশের বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে । ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ক্ষতির মধ্যে, খাইবার পাখতুনখোয়ার কুররামে সাম্প্রদায়িক হিংসায় ক্রমবর্ধমান হতাহতের ঘটনাকে উপেক্ষা করে দেশবাসীর মনোযোগ ইসলামাবাদের দিকে সরানো হয়েছে ।
বিক্ষোভকারীরা ইসলামাবাদের রেড জোনের একটি এলাকা ডি চকে জড়ো হতে শুরু করে, যেখানে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি, সুপ্রিম কোর্ট ও কূটনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে । তাঁদের দাবি পূরণ না-হওয়া পর্যন্ত এলাকায় থাকতে বলা হয়েছে ।
চারদিনের লকডাউনের পর, যা বুধবার (28 নভেম্বর) শেষ হয়েছিল, ইমরান খানের দল প্রশাসনের মধ্যরাতের অভিযানের পর তাদের প্রতিবাদ স্থগিত করে ৷ কিন্তু ওই অভিযানে চারজন নিহত এবং 50 জনেরও বেশি আহত হয়েছে বলে জানা গিয়েছে ।
ইমরান যেমনটা করেছেন, এই ধরনের প্রতিবাদ শুধু এমন একটা ডাক দিয়ে হয় না । এই ধরনের আহ্বানে সঙ্গে সঙ্গে হিংসা ছড়িয়ে পড়ে ৷ প্রতিবাদ, বিশেষ করে যখন হাজার হাজার কনভয় দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রম করে, তখন সংগঠন, সমন্বয় এবং অপরিমেয় লজিস্টিকের ব্যাকআপ প্রয়োজন হয় । (আবহাওয়া বিবেচনা করে) প্রতিবাদকারীদেরকে রাখতে হবে, খাওয়াতে হবে এবং তাঁদের প্রচেষ্টার জন্য কিছু অর্থও প্রদান করতে হবে । যাঁরা অংশগ্রহণকারী, তাঁরা ইমরানের অনুসারী হতে পারেন, তবে তাঁরা এই বিষয়েও সচেতন ছিলেন যে রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়ার ফলে বিক্ষোভের সময় গ্রেফতার, প্রাণহানি এবং কোনও আয় হবে না ।
সুতরাং, তাঁদের শুধু অনুপ্রেরণার চেয়ে বেশি প্রয়োজন । 2020 সালের কৃষকদের আন্দোলনের সময় ভারত একই পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছিল, যেখানে উত্তর আমেরিকা-ভিত্তিক ভারত বিরোধী সংগঠনগুলি থেকে তহবিল দেওয়া হয়েছিল ।
ইমরান খান বা তাঁর দলের সদস্যরা কেউই এই বিক্ষোভ সংগঠিত করার জন্য তাঁদের নিজস্ব তহবিল বিনিয়োগ করবেন না ৷ কারণ, সাফল্যের সম্ভাবনা সবসময়ই প্রশ্ন রয়েছে । এছাড়া, সরাসরি অংশগ্রহণ এবং পরবর্তী ব্যর্থতা তাদের রাজনৈতিক কর্মজীবনের সমাপ্তির ইঙ্গিত দিতে পারে । আহ্বান হয়তো ইমরান এখন দিয়েছেন ৷ কিন্তু পরিকল্পনা আগে থেকেই চলছিল ।
এই তহবিল কোথা থেকে আসছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায় । ইমরান খান এক্স-এ পোস্ট করেছিলেন, ‘‘বিশ্বব্যাপী প্রবাসী পাকিস্তানিদের কাছে আমার ধন্যবাদ, যারা শুধু পাকিস্তানিদেরই উদ্বুদ্ধ করা এবং তহবিলই জোগাড় করছে না, তাঁদের নিজ নিজ দেশে ঐতিহাসিক প্রতিবাদও করছে ।’’ পাকিস্তানে অরাজকতা চললে এবং ইমরান রাষ্ট্রপ্রধান হলে যাঁদের লাভ হবে, তাঁরাই অর্থ জোগাড়ের চেষ্টা করছেন ৷
ভারত এমন একটি দেশ, যাদেরকেই পাকিস্তান নেতৃত্ব প্রথমে দোষারোপ করবে । ঘটনাচক্রে ইমরানের আমলে ভারত-পাক সম্পর্কের অবনতি বেড়েছে । ইমরানই হাইকমিশনারদের প্রত্যাহার করেছিলেন এবং আলোচনা পুনরায় শুরু করার জন্য 370 ধারা পুনর্বহাল করার মতো অগ্রহণযোগ্য শর্ত রাখেন । তাই ইমরানের প্রতি ভারতের কোনও ভালোবাসা নেই । তার পরও, ভারতের জন্য পাকিস্তানে নৈরাজ্য ভালো নয় ।
চিন বা পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোও চাইবে না যে পাকিস্তান অশান্তিতে থাকুক । পাকিস্তানে অস্থিতিশীলতা সিপিইসি (চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর) নিয়ে অনিশ্চিয়তা তৈরি করে, যা মূলত চিনের টাকায় হচ্ছে ৷ প্রতিবাদ রুখতে রাষ্ট্রযন্ত্রের পদক্ষেপ বিভিন্ন প্রকল্পে নিযুক্ত চিনা নাগরিকদের উপর আরও আক্রমণের দরজা খুলে দেবে ৷ তাছাড়া, সিপিইসি ব্যর্থতা নিশ্চিত করতে বা পাকিস্তান থেকে সরে যেতে চিনকে বিব্রত করার জন্য নিহিত স্বার্থ কাজ করছে ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক ডিপ স্টেটই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যা পাকিস্তানের অশান্তি থেকে, চিনকে হেয় করা থেকে এবং অনিরাপদ দক্ষিণ এশিয়া তৈরি হলে লাভবান হবে ৷ ডিপ স্টেট একাধিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, ভারতে নেতৃত্ব পরিবর্তন করতে এবং দেশে নৈরাজ্যের মাত্রা বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে । এর প্রচেষ্টা বারবার সরকার দ্বারা রুখে দেওয়া হয়েছে । কৌশলে পরিবর্তন করে এবার ভারতের প্রতিবেশী অঞ্চলে অনিশ্চয়তা বাড়ানো হতে পারে, যাতে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করা যায় । এটাকে কাজে লাগিয়ে ভারতকে টার্গেট করা হতে পারে ।
ডিপ স্টেট বাংলাদেশে তার প্রচেষ্টায় সফল হয়েছে৷ ভারতপন্থী শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাত করেছে ৷ মহম্মদ ইউনুসের অধীনে একটি পুতুল সরকার চাপিয়েছে, যা ক্রমবর্ধমান ইসলামিকরণ এবং সংখ্যালঘুদের লক্ষ্যবস্তুতে নিয়ন্ত্রণ করা থেকে ব্যর্থ হয়েছে । বাংলাদেশের অশান্তি এবং ক্রমবর্ধমান ঘৃণা ও হিংসা নিয়ন্ত্রণে ওই দেশের সেনাবাহিনী জড়িত থাকায়, ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলি এখন ভারতের উত্তর-পূর্বে অশান্তি বাড়ানোর জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠতে পারে । ওই দেশের অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্যের জন্য ভারতে অবৈধ অভিবাসন বাড়বে ও ভারতের জনসংখ্যা পরিবর্তন করবে ।
পাকিস্তানেও একই রকম দৃশ্য দেখা যাচ্ছে । ক্রমবর্ধমান নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণে সরকারকে অত্যধিক শক্তি প্রয়োগ করলে, তা পরিস্থিতিকে অস্থির করে তুলতে পারে । সেনাবাহিনী, যারা কার্যত শাসক, তাদের তরফে প্রভাবশালী ইমরানকে ফেরার রাস্তা করে দেওয়ার সম্ভাবনা কম । ইমরানের পক্ষে সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটি বিদ্রোহ এবং বর্তমান শাসনের অপসারণ পাকিস্তানকে বিশৃঙ্খলার মধ্যে ফেলে দিতে পারে । এটা ডিপ স্টেটের সম্ভাব্য পরিকল্পনা । ইমরান স্বৈরাচারী ক্ষমতা নিয়ে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে আবির্ভূত হবেন । তবে, পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক অতল গহ্বরে নিক্ষিপ্ত করে এই পরিবর্তন হিংসাত্মক হবে ।
তাই প্রতিবাদের বর্তমান প্রকোপ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি । পাকিস্তান যদি ভবিষ্যৎ বিক্ষোভ প্রতিরোধ করতে চায় (এটিই শেষ হবে না), তাহলে তাকে অবশ্যই মূল্যায়ন করতে হবে যে এই ধরনের আন্দোলনকে সমর্থন করার জন্য তহবিল কোথা থেকে আসছে । তাদের ভারতকে দোষারোপের বাইরে ভাবতে হবে এবং ইমরানের পুনরুত্থান ও একটি অস্থির দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে যারা লাভবান হবে, তাদের দিকে নজর দেওয়া উচিত ।
স্পষ্টতই, বাইরের তহবিল থাকতে হবে । ভারত হাওয়ালা তহবিলের প্রবাহ বন্ধ করে ডিপ স্টেটের প্রচেষ্টাকে আটকাতে সক্ষম হয়েছে । পাকিস্তান কি তা করতে পারবে ?
(এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামতগুলি লেখকের । এখানে প্রকাশিত তথ্য এবং মতামত ইটিভি ভারত-এর মতামতকে প্রতিফলিত করে না ৷)