5 নভেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হল ৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি খারাপ অভ্যাস রয়েছে, তা হল অন্যান্য গণতন্ত্র নিয়ে মন্তব্য করা, কাল্পনিক ত্রুটিগুলি খুঁজে বের করা এবং একই সঙ্গে নিজেদের ত্রুটিগুলিকে উপেক্ষা করা । অন্যদিকে তারা খোলাখুলিভাবে অন্য দেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে ও সেই দেশগুলিকে শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তনের দিকে ঠেলে দেয় ৷ তারা অন্যদের মার্কিন নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের জন্য অভিযুক্ত করে ৷ অথচ এমন কেউই নেই ৷ সোশাল মিডিয়ার এই যুগে বন্ধু এবং প্রতিপক্ষ উভয়ের কাছ থেকে ন্যারেটিভ তৈরি হবে, এটাই প্রত্যাশিত এবং এটাই নিয়ম হয়ে গিয়েছে৷ যদি সেটা হস্তক্ষেপও হয়, তাহলেও ৷
ভারত যদিও ইভিএমের ব্যবহার শুরু করে দিয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে ৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু এখনও কাগজের ব্যালটে আটকে অন্ধকার যুগে রয়ে গিয়েছে । তারা দাবি করে যে তাদের জনসংখ্যা এটাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয় । বুথ দখল ও ব্যালটে কারচুপি ঠেকাতে ভারতে ইভিএম ব্যবহার শুরু হয়েছে ৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনে জাল ব্যালট এবং ব্যালট বাক্স পোড়ানোর ঘটনা নিয়মিত হয়েছে ৷ এবারও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে ৷ ভোটারদের একাংশকে ভোট দিতে বাধা দেওয়ার জন্য নির্ধারিত সময়সীমা শেষ হওয়ার কয়েকঘণ্টা আগেই ভোটকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ৷

বেশিরভাগ দেশে ভোট দেওয়ার আগে পরিচয়ের প্রমাণ অপরিহার্য, যার ফলে নিশ্চিত করা হয় যে দেশের বৈধ নাগরিকরা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করছেন । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তা নয়, যেখানে উদ্দেশ্য হল নির্দিষ্ট দলের লাভের জন্য অবৈধ অভিবাসীদের ভোটকে কাজে লাগানো । কোন গণতন্ত্রে ত্রুটিপূর্ণ এবং আইনি ফাঁকফোকরগুলি বেশি শোষিত হয়, ভারত নাকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এটাই সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় । ভারত সারা বিশ্বের প্রতিনিধিদের বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক বৈশ্বিক অনুশীলন অর্থাৎ নির্বাচন এবং তার ন্যায্যতা ও প্রাণবন্ততা প্রদর্শনের জন্য আমন্ত্রণ জানায় ৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি তা করতে পারল ?
মার্কিন সরকার বাক স্বাধীনতার নীতিগুলিকে 'দৃঢ়ভাবে' মেনে চলার দাবি করে । তথাকথিত শিখস ফর জাস্টিস আন্দোলনের প্রধান গুরপতবন্ত সিং পান্নুনকে সুরক্ষা প্রদানে ও এয়ারলাইন্স সহ ভারতীয় সম্পদের হুমকির বিষয়ে ভারতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত এরিক গারসেটিকে একটি মিডিয়া সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করা হয় ৷ উত্তরে তিনি উল্লেখ করেন, ‘‘আমরা আমাদের ভারতীয় বন্ধুদের সবসময় অপরাধের দিকে মনোযোগ দিতে বলি । যখন আমরা মতামতের বিপরীতে অপরাধের দিকে মনোনিবেশ করি, তখন আমরা অগ্রগতি দেখতে সক্ষম হই ।’’ তাঁর এই কথার অর্থ ছিল পান্নুন কেবল একটি মতামত প্রকাশ করছিলেন । তিনি আরও জানিয়েছিলেন, যখনই ভারতীয় কনস্যুলেটে হামলা হয় ওয়াশিংটন তদন্ত শুরু করে ।
2018 সালের 5 অক্টোবর এফবিআই নিউজে জনগণকে সতর্ক করে একটি লেখা প্রকাশিত হয় ৷ সেখানে উল্লেখ করা হয়, ‘‘হুমকি দেওয়া, সে সোশাল মিডিয়া হোক, মেসেজ হোক বা ই-মেলের মাধ্যমে হোক, সব কিছুই ফেডারেল অপরাধ । যারা এই ধরনের হুমকি পোস্ট করেন বা পাঠায় তাঁদের ফেডারেল কারাগারে পাঁচ বছর পর্যন্ত যেতে হতে পারেন ৷ অথবা তাঁরা রাষ্ট্রীয় বা স্থানীয় অভিযোগের মুখোমুখি হতে পারেন ।’’ ওই প্রতিবেদনে এমন কয়েকটি ঘটনার তালিকাও রয়েছে ৷ যেখানে জাল বোমাবাজির হুমকি দেওয়ার জন্য ব্যক্তিদের 12 থেকে 24 মাস পর্যন্ত জন্য কারাগারে রাখা হয়েছে ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অন্য দেশের সম্পদ ও ব্যক্তিদের এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লোকদের হুমকি দেওয়ার জন্য আলাদা আইন আছে কি না, সেটা নিয়েই সন্দেহ তৈরি হয় । সম্ভবত ভারতীয় বিমান সংস্থাগুলিকে লক্ষ্য করার হুমকি দেওয়া এবং ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা করার কথা বলা 'বাক স্বাধীনতা', যখন মার্কিন মাটিতে দাঁড়িয়ে মিথ্যা হুমকি ইমেল করা একটি ফেডারেল অপরাধ ।
হয়তো রাষ্ট্রদূত 28 বছর বয়সী ভারতীয়-আমেরিকান ছাত্র রিধি প্যাটেলের কথা শোনেননি । তাঁকে 16টি অপরাধমূলক অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং আরও আটটি অভিযোগে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে । জামিন নামঞ্জুর করা হয়েছে । তাঁর অভিযোগের মধ্যে রয়েছে 'সন্ত্রাস করার অভিপ্রায়ে হুমকি' এবং 'প্যালেস্তাইনপন্থী বক্তৃতার সময় শহরের কর্মকর্তাদেরও হুমকি দেওয়া' । তার আবেগপূর্ণ বক্তৃতায় 'কোন হিংসা' ছিল না, শুধু হুমকি ছিল ।
শুধুমাত্র এই কারণে যে তিনি মার্কিন শহরের কর্মকর্তাদের হুমকি দিয়েছিলেন, তাই ওই মেয়েটিকে জেলে পাঠানো হয়েছে ৷ অথচ পান্নুন যখন ভারতীয় নেতাদের হত্যার জন্য এবং তার বিমান ধ্বংস করার কথা বলছেন, তখন সেটা বাক স্বাধীনতার অধীনে সুরক্ষিত রাখা হচ্ছে । আশ্চর্য হবেন যদি গারসেটি বুঝতে পারেন, তাঁর মন্তব্য কতটা অযৌক্তিক ।
গত বছর দু’বার তথাকথিত খালিস্তান কর্মীরা ভারতীয় কনস্যুলেটে হামলা করে । প্রথমটি মার্চে হয় এবং দ্বিতীয়টি হয় জুলাই মাসে । এরিক গারসেটি উল্লেখ করেছেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হামলার তদন্ত করছে । তিনি এফবিআইয়ের ডিরেক্টর, ক্রিস্টোফার ওয়ারির বিবৃতিকে সমর্থন করছিলেন, যিনি এনআইএ-এর সঙ্গে দেখা করার সময় মন্তব্য করেছিলেন যে এফবিআই ঘটনাটি 'আক্রমণাত্মকভাবে তদন্ত করছে' ।

গারসেটি যা উল্লেখ করতে ব্যর্থ হন, তা হল যে এনআইএ সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সনাক্ত করেছে এবং এফবিআই-কে সেই তথ্য দিয়েছে ৷ আশ্চর্যের বিষয়, এর আর কোনও অগ্রগতি হয়নি । তালিকার একজনকেও আজ পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি । যদি এফবিআই-কে এমন একটি তদন্তের মাধ্যমে ধাক্কা দিতে এত দীর্ঘ সময় লাগে, যেখানে প্রমাণ সরবরাহ করা হয়েছে, তাহলে হয় সংস্থাটির তদন্ত ক্ষমতা দুর্বল অথবা তদন্ত করার কোনও ইচ্ছে নেই । সম্ভবত ভারতীয় কনস্যুলেট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বনিম্ন স্তরের অগ্রাধিকার, যা গারসেটির মন্তব্যের সঙ্গে মেলে না ।
একই সঙ্গে, গারসেটি চায় ভারত তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে, তাঁদের 'দাবি' অনুয়ায়ী যাঁরা পান্নুনকে হত্যার ষড়যন্ত্রের পিছনে রয়েছেন । তিনি আরও জানান, যুক্তরাষ্ট্র ভারতের কাছ থেকে জবাবদিহি চায় । তিনি উল্লেখ করেন, ‘‘শুধু বলা নয় যে ভবিষ্যতে এটি ঘটবে না ৷ বরং যাঁরা জড়িত, তাঁদেরও ধরতে হবে ।’’ গারসেটির কাছে প্রশ্ন, জবাবদিহিতা কি একমুখী ব্যবস্থা ? একই সময়ে, ওয়াশিংটন এই সত্যটিকে উপেক্ষা করে যে কয়েকটি দেশের মধ্যে তারাও একটি দেশ, যারা নিজেদের প্রতিপক্ষকে হত্যা করেছে, সে আল কায়েদা নেতা হোক বা ইরানের নাগরিক হোক এবং হোয়াইট হাউস থেকে গর্বিতভাবে সেগুলি ঘোষণাও করা হয়েছে ৷
একই পান্নুন, যিনি ভারতীয় সম্পদকে হুমকি দেন, পরবর্তীতে ভারতীয় সরকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেন এবং মার্কিন সরকারের কোনও কর্মকর্তা বিষয়টি খোঁজ নিয়েও দেখেনি ৷ ভোপাল গ্যাস ট্র্যাজেডির নেপথ্যে থাকা মার্কিন কোম্পানি ন্যাশনাল কার্বাইডের বিরুদ্ধে অনুরূপ একটি মামলা প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে শাস্তিবিহীন অবস্থায় পড়ে রয়েছে এবং উপেক্ষিত হয়ে রয়েছে ৷ কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার অপরাধীদের রক্ষা করে এবং তাঁদের হস্তান্তর করতে অস্বীকার করেছে ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রাক্তন র অফিসার বিকাশ যাদবের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে এবং ভবিষ্যতে ভারতকে তাদের দেশে আইনি প্রক্রিয়ার মুখোমুখি করার জন্য তাঁকে প্রত্যর্পণের দাবি করবে । একই সময়ে, তারা মুম্বই জঙ্গি হামলার জন্য দায়ী ডেভিড হেডলিকে প্রত্যর্পণ করতে অস্বীকার করছে । একই সঙ্গে, গত দুই দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে 61টি প্রত্যর্পণের অনুরোধ মুলতুবি রয়েছে ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আশা করে যে তার বন্ধুরা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ-সহ সারা বিশ্বের সমস্যাগুলিতে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করবে । তারা আরও দাবি করে যে যদি তারা একতরফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে, আইনি বা বেআইনি কোনও সমস্যা না-হয় তবে সবাইকে সেগুলি মেনে চলতে হবে । ভারতের দ্বিমতের ফলে উভয়ের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয় ।
ওয়াশিংটন রাশিয়ার সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্ক এবং তেল সংগ্রহ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে । তারা ভারতের একটি স্বাধীন বিদেশনীতি গ্রহণ করাকে অপছন্দ করে । গারসেটি জুলাই মাসে একটি সেমিনারে উল্লেখ করেছেন, 'এটা (ভারত-মার্কিন সম্পর্ক) এখনও এতটা গভীর নয় যে আমরা ভারতীয় পক্ষ থেকে এটিকে মঞ্জুর করে নিই ।' ভারত সরকার তাঁর পক্ষপাতমূলক মন্তব্যকে যথাযথভাবে উপেক্ষা করেছে ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন অন্যদের দিকে আঙুল তুলেছে, তখন সময় এসেছে যে তারা নিজেদের দিকেও একবার তাকিয়ে দেখুক ৷ ভারত এমন কয়েকটি দেশগুলির মধ্যে রয়েছে, যারা কখনও মার্কিন হুমকির কাছে নতজানু হবে না এবং তাদের রাষ্ট্রদূত এরিক গারসেটির আলগা মন্তব্য নিয়ে মাথা ঘামায় না ।
(এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের ৷ এখানে প্রকাশিত তথ্য ও মতামত ইটিভি ভারত-এর মতামতকে প্রতিফলিত করে না ৷)