সারা বিশ্বে যত বর্জ্য় তৈরি হয়, তার সবচেয়ে বেশি হয় ভারতীয় শহরগুলিতে ৷ বছরে এর পরিমাণ প্রায় 62 মিলিয়ন টন ৷ এর মধ্যে প্রায় 43 মিলিয়ন টন (70 শতাংশ) সংগ্রহ করা হয়, প্রায় 1 কোটি 20 লক্ষ টন শোধন করা হয় এবং 3 কোটি 10 লক্ষ টন ল্যান্ডফিল সাইটে ফেলা হয় ।
2020-21 এ কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের তরফে যে বার্ষিক রিপোর্ট দেওয়া হয়েছিল, সেখানে জানানো হয় যে ভারতে প্রতিদিন প্রায় 1 লক্ষ 60 হাজার মেট্রিক টন কঠিন বর্জ্য (সলিট ওয়েস্ট) তৈরি হয় ৷ এর মধ্যে প্রায় দেড় লক্ষ মেট্রিক টন প্রতিদিন সংগ্রহ করা হয় । মোট বর্জ্যের প্রায় 50 শতাংশ শোধন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায় ৷ আর 18 শতাংশ ল্যান্ডফিল সাইটে ফেলে দেওয়া হয় । ভারত এখন এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে ল্যান্ডফিল সাইটে বাড়তে থাকা বর্জ্য অপসারণের লক্ষ্য পূরণ করার জন্য দীর্ঘমেয়াদী কৌশলের প্রয়োজন ।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দিল্লির কাছে গাজিয়াবাদে যেখানে বর্জ্য ফেলা হয়, সেখানে আবর্জনা জমতে জমতে কুতুব মিনারের সমান উচ্চতায় পৌঁছে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে ৷ এই পরিস্থিতি থেকে বোঝা যায় যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার অভাব রয়েছে ৷ ভারতীয় কোনও শহরই আবর্জনা ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানে দক্ষতা অর্জন করতে পারেনি ।
2031 সালের মধ্যে ভারতীয় শহরগুলি প্রতি বছর 107.01 মিলিয়ন টন এবং 2041 সালের মধ্যে 160.96 মিলিয়ন টন বর্জ্য উৎপাদন করবে বলে মনে করা হচ্ছে ৷ এটা হলে, চার দশক ধরে বর্জ্য উৎপাদন প্রায় পাঁচগুন বৃদ্ধি পাবে ৷ দিল্লি পুরনিগম (মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন অফ দিল্লি বা এমসিডি) 2016 সালে সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট রুল তৈরি করে ৷ সেই নিয়ে মামলা দায়ের হয় ৷ গত 17 জানুয়ারি সেই মামলার শুনানি হয় সুপ্রিম কোর্টে ৷ সেখানে এমসিডি-র তৈরি করা এই রুল নিয়ে তীব্র অসম্মতি প্রকাশ করে শীর্ষ আদালত ৷ আদালত উল্লেখ করেছে যে জাতীয় রাজধানীতে প্রতিদিন তিন হাজার টন কঠিন বর্জ্য অপরিশোধিত অবস্থায় পড়ে থাকে ।
‘দুঃখজনক পরিস্থিতি’ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট এমসিডি-র সমালোচনা করেছিল । জানা গিয়েছে যে জাতীয় রাজধানীতে প্রতিদিন 11 হাজার টনেরও বেশি কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হতো । সেই বর্জ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ যে কেন্দ্রগুলি থেকে হতো, সেগুলির দৈনিক ক্ষমতা ছিল মাত্র 8 হাজার 73 টনেরও বেশি ৷ এর ফলে প্রতিদিন তিন হাজার টনেরও বেশি কঠিন বর্জ্য অপরিশোধিত থাকে ।
আরেকটি চ্যালেঞ্জ হল বায়োমেডিক্যাল ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট (বিএমডাব্লু), যা প্রচলিত আবর্জনার থেকে আলাদা । ভারত দাবি করে যে বায়োমেডিক্যাল ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট 96 শতাংশ প্রক্রিয়াজাত করা হয় ৷ কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকার উভয়ই কীভাবে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করবে, তা এখনও স্পষ্ট নয় ।
বায়োমেডিক্যাল ওয়েস্ট রুল বাস্তবায়নে সরকারি হাসপাতালগুলির প্রধান বাধা হল তহবিলের অভাব । 1990-এর দশকের শেষের দিকে, প্রথম বায়োমেডিক্যাল ওয়েস্ট সংক্রান্ত নিয়ম চালু হয় ৷ তার পর, ভারতে ইনসিনারেটর স্থাপনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় । এই কাজ রোগজীবাণু নির্মূল করে এবং জীবাণু ধারণকারী উপাদান ধ্বংস করে । তবে, এই কাজে অসম্পূর্ণ দহন হয় ৷ এর থেকে উপজাত এবং ডাইঅক্সিন-সহ বিষাক্ত পদার্থও তৈরি হয় ৷ এগুলি পরিবেশে নির্গত হয় এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করে ।
দেশে বিপজ্জনক বর্জ্য উৎপাদনকারী শিল্পের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে । একই সঙ্গে, আইন অনুযায়ী সঠিকভাবে বর্জ্য মজুদ করার যে পদ্ধতি রয়েছে, তা পালনে ব্যর্থ অনেক শিল্প সংস্থা ৷ আমরা যে সমস্ত বর্জ্য তৈরি করি, তার মধ্যে প্লাস্টিকজাত পণ্যগুলি মিষ্টি জল, মোহানা ও সামুদ্রিক পরিবেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে বলে মনে হয় ।
প্লাস্টিক বর্জ্য অন্যান্য গার্হস্থ্য কঠিন বর্জ্যের সঙ্গে ল্যান্ডফিল সাইটে ফেলা হয় । এর বদলে যদি প্রথমে কঠিন বর্জ্যকে পুনর্ব্যবহারের জন্য পাঠানো গেলে আরও কার্যকর হবে । সলিড ওয়েস্ট আলাদা করার কেন্দ্র থাকা এবং তা কার্যকর সম্পূর্ণভাবে হয়েছে, এমন দাবি ভারতের কোনও বড় শহরই করতে পারবে না ৷
এই কাজে নিযুক্ত কর্মীদের বেতন কম এবং দূষণ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে তাদের মধ্যে ৷ কারণ, তারা কোনও প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম পরেন না । আমাদের বর্জ্য শোধনের জন্য আরও উদ্ভাবনী প্রযুক্তিগত সমাধান তৈরি করতে হবে ৷ কঠিন বর্জ্য সংগ্রহ, তার পুনর্ব্যবহার এবং পুনর্ব্যবহারের হার বৃদ্ধির জন্য সব ব্যবস্থাগুলিকে এক করতে সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে একটি 'ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান' তৈরি করতে হবে ৷ এটা সম্ভবত একশো দিনের কাজের প্রকল্পের মাধ্যমে করা যেতে পারে ৷
দেশে বর্জ্য থেকে জ্বালানি তৈরির প্রযুক্তির অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে ৷ এছাড়া রয়েছে অনিশ্চয়তাও ৷ এই বিষয়ে আগে প্রকাশিত একটি লেখায় আমি আলোচনা করেছি যে কেন দিল্লির বর্জ্য থেকে জ্বালানি তৈরির যন্ত্র, এখন খোলা আবর্জনার আগুনে পরিণত হয়েছে এবং এর থেকে রাসায়নিকভাবে বিষাক্ত কণা ও গ্যাস নির্গত হয়েছে । অথচ একসময় শহরের ক্রমবর্ধমান আবর্জনা সংকটের সবুজ সমাধান হিসেবে পরিচিত ছিল এই যন্ত্র ৷
বিশ্বজুড়ে অসংখ্য শোধনাগার সরাসরি গলানোর মতো তুলনামূলকভাবে অভিনব প্রক্রিয়া ব্যবহার করে । কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তিকে এক ছাতার তলায় আনতে হবে ৷ বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিসিয়াল ইন্টালিজেন্ট), বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কৌশলগুলির দক্ষতা ও কার্যকারিতা বিপ্লব করতে পারে ৷
বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত বর্জ্য থেকে শক্তি উৎপাদন কেন্দ্রগুলি নিম্ন তাপমাত্রায় পরিচালিত কার্সিনোজেনিক যৌগ যেমন ডাইঅক্সিন, ফুরান এবং বিভিন্ন দূষণকারী পদার্থের পাশাপাশি ছাইয়ের সম্ভাব্য উৎস হয়ে উঠেছে । ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টার (বিএআরসি)-এর থার্মাল প্লাজমা টেকনলজিস সেকশন অফ দ্য লেজার এবং প্লাজমা টেকনলজি ডিভিশনের বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি একটি রিপোর্ট সামনে এনেছেন ৷ সেখানে তাঁরা দাবি করেছেন যে তাঁরা একটি মাঝারি-শক্তির (30 কিলোওয়াট) 'হাফনিয়াম ইলেক্ট্রোড এয়ার প্লাজমা টর্চ' তৈরি করেছেন ৷ আর এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাঁরা একটি অনন্য 'এয়ার প্লাজমা ইনসিনারেটর' তৈরি করেছেন ।
এই প্রযুক্তি পরিবেশে কোনও ক্ষতিকারক যৌগ বা অবশিষ্টাংশ নির্গত করে না । এই পদ্ধতিতে উচ্চ-তাপমাত্রায় (5 হাজার-7 হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত) গ্যাসিফিকেশন এবং নিয়ন্ত্রিত দহনের সংমিশ্রণ ব্যবহার করা হয় ৷ শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্যও এই প্রযুক্তি প্রস্তুত ৷
ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল ফর ইনোভেটিভ রিসার্চ ইন সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে (খণ্ড 1, সংখ্যা 11, এপ্রিল 2015) প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে পরিবেশ সংক্রান্ত ইঞ্জিনিয়র হেতা গান্ধি জানিয়েছেন যে প্লাজমা গ্যাসিফিকেশন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একটি 'স্থায়ী সমাধান' । তাহলে ভারতে কেন এটি জনপ্রিয় হয়নি ? সাধারণত বর্জ্য থেকে জ্বালানি তৈরির যে চিরাচরিত পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, তার থেকে এক্ষেত্রে প্লাজমা ইনসিনারেটর নির্মাণের খরচ বেশি এবং এর রক্ষণাবেক্ষণের কারণে, যার মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী নির্ভরযোগ্যতাও রয়েছে, সেটাই কি এর কারণ ?
জাপানের উতাশিনাইতে হিতাচি এমএসডব্লিউ গ্যাসিফিকেশন প্ল্যান্ট রয়েছে৷ সেখানে একটি প্লাজমা গ্যাসিফিকেশন প্ল্যান্ট ছিল ৷ সেখানে পুরসভার কঠিন বর্জ্য (এমএসডব্লিউ) এবং অটোমোবাইল শ্রেডার রেসিডিউ (এএসআর) প্রক্রিয়াজাত করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করত । প্ল্যান্টটি 2002 সালে নির্মিত হয়েছিল ৷ কিন্তু 2013 সালে বন্ধ হয়ে যায় ।
কঠিন বর্জ্য পরিশোধনের জন্য প্লাজমা গ্যাসিফিকেশন পরিবেশগতভাবে উপযোগী বিকল্প হওয়া সত্ত্বেও ওই প্ল্যান্টটি কোন কোন কার্যকরী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল, যার ফলে তা বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল ? নীতিনির্ধারক ও বিজ্ঞানীদের এই উদ্ভাবনী প্রযুক্তিতে সহযোগিতা করার সময় এসেছে, যাতে তারা কার্যকরী বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করতে পারে এবং কীভাবে এটাকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা যায়, সেটা ভাবতে হবে ।
(এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব । এখানে প্রকাশিত তথ্য এবং মতামত ইটিভি ভারত-এর মতামতকে প্রতিফলিত করে না ৷)