হায়দরাবাদ, 31 মার্চ: রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনুমান সত্যি করে ভারতের প্রতি তাঁর সুর নরম করেছেন মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুইজ্জু । মলদ্বীপের একটি স্থানীয় চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মুইজ্জুভারত থেকে নেওয়া ঋণ ফেরত দেওয়ার বিষয়ে কথা বলেন ৷ এই ঋণ ফেরত নেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতকে আরও নম্র হওয়ার জন্য অনুরোধ করেন । উল্লেখ্য যে, গত বছরের শেষে ভারতের কাছে মলদ্বীপের বকেয়া ঋণের পরিমাণ 400.9 মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা মাত্র 6.190 বিলিয়ন ডলারের জিডিপির একটি দেশের ক্ষেত্রে পরিশোধ করা খুবই কঠিন । মলদ্বীপ মোট 3.577 বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণের বোঝায় জর্জরিত, যার মধ্যে 42 শতাংশেরও বেশি ঋণ চিনের থেকে নেওয়া ।
ভারতের কাছে মলদ্বীপের মোট বকেয়া ঋণের পরিমাণ 517 মিলিয়ন ডলার । এর মধ্যে গত অর্থবর্ষেই ভারত 93 মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে । ভারতের বিরুদ্ধে মুইজ্জু সুর চড়ানো সত্ত্বেও সেখানকার উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলির জন্য সেখানকার বাজেটের প্রায় দ্বিগুণ অঙ্কের অর্থ সাহায্য করে মোদি সরকার । কঠিন সময়ে ভারত সবসময় মলদ্বীপের পাশে দাঁড়িয়েছে ।
1988 সালের নভেম্বর মাসে যখন মলদ্বীপে একটি অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টার সম্মুখীন হয় তখন ভারতই তার সেনা সেখানে পাঠায় পরিস্থিতি সামাল দিতে । 1980 এবং 1990 এর দশকে, ভারত মলদ্বীপকে একটি 200 শয্যার হাসপাতাল এবং একটি পলিটেকনিক প্রতিষ্ঠান উপহার দিয়েছিল । 2004 সালে মলদ্বীপে যখন সুনামি আছড়ে পড়েছিল তখন ভারতই প্রথম প্রতিক্রিয়া জানায় । 2008 সাল থেকে ভারত মলদ্বীপকে সহায়তার জন্য 2454.59 কোটি টাকার বেশি ব্যয় করেছে যার মধ্যে 500টি সাশ্রয়ী মূল্যের বাড়ি নির্মাণ, একটি প্রযুক্তি কেন্দ্র, একটি জাতীয় পুলিশ ও আইন প্রয়োগকারী কলেজ, মালেতে একটি জল ও পরিচ্ছন্নতা প্রকল্প, আদ্দু অ্যাটলে একটি রাস্তা ও জমি প্রকল্প এবং মলদ্বীপ জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর ২০,০০০ এরও বেশি কর্মীকে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি হসপিটালিটি অ্যান্ড ট্যুরিজম উন্নয়নে সহায়তা করে। আমাদের নৌবাহিনী এবং কোস্টগার্ড মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন যৌথ মহড়ায় এমএনডিএফকে নিযুক্ত করেছে।
22 মার্চ একটি স্থানীয় দৈনিক "মিহারু"-এর সঙ্গে কথা বলার সময়, মুইজ্জু তার ক্ষমতায় আসার পর প্রথমবারের মতো ভারতে সম্পর্কে নরম সুরে কোনও কথা বললেন । ভারত মলদ্বীপকে সহায়তা প্রদানে সহায়ক ছিল এবং এই দেশ মলদ্বীপে সর্বাধিক সংখ্যক প্রকল্পের বাস্তবায়ন করেছে, এ কথা স্বীকার করে নেন মলদ্বীপের রাষ্ট্রপ্রধান ৷ তিনি আশা প্রকাশ করেছেন যে, ভারত 'ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে মলদ্বীপের ঋণ-মুক্তির ব্যবস্থা সহজতর করবে' ৷ তিনি জানান, আবুধাবিতে রাষ্ট্রসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সম্মেলন চলাকালীন, তিনি ভারতীয় অবদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদির কাছে তাঁর 'কৃতজ্ঞতা' জানান । মুইজ্জু আরও জানান, তিনি মলদ্বীপে ভারতের উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলিকে বন্ধ করতে চান না ৷ বরং এই প্রকল্পগুলিকে শক্তিশালী করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদিকে অনুরোধ করেছেন । তার দেশ থেকে সেনা অপসারণের বিতর্কিত ইস্যুতে, মলদ্বীপের রাষ্ট্রপ্রধান তার অবস্থানকে 'নিরপেক্ষ' প্রমাণের চেষ্টা করেন৷ তিনি জানান, এই নীতি শুধুমাত্র ভারতের জন্য নয়, বরং সমস্ত বিদেশী রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে ।
এখন প্রশ্ন হল, কেন মুইজ্জু ভারতের ক্ষেত্রে সুর নরম করে নিজের অবস্থান পরিবর্তন করার চেষ্টা করছেন । এই 'ভোল বদল'-এর পিছনে চারটি শক্তিশালী কারণ থাকতে পারে । প্রথমত, ক্ষুদ্র অর্থনীতির মলদ্বীপের জন্য 400 মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি ঋণ শোধ করা 9 মাসের মধ্যে প্রায় অসম্ভব । দ্বিতীয়ত, চিন মলদ্বীপের সঙ্গে 20টি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এবং 130 মিলিয়ন মার্কিন ডলারের অনুদান ঘোষণা করেছে । মুইজ্জুর বেইজিং সফরের সময় মনে হয়েছে, অদূর ভবিষ্যতে ঋণ পরিশোধের কোনও স্পষ্ট ইঙ্গিত না মেলা পর্যন্ত মলদ্বীপে অর্থ বিনিয়োগ চালিয়ে যাওয়ার কোনও ইচ্ছা নেই চিনের । এ কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয়, চিনা ঋণের ক্ষেত্রে, প্রকৃত ঋণের পরিমাণ প্রায়ই জনসমক্ষে উল্লেখিত (পাবলিক ডোমেনে) পরিমাণের তুলনায় বেশি থাকে । তৃতীয়ত, দ্বীপরাষ্ট্রের অনিশ্চিত অর্থনৈতিক অবস্থার বিরুদ্ধে আইএমএফ-এর জারি করা সাম্প্রতিক সতর্কতাও মুইজ্জুকে ভারতের প্রতি সুর নরম করতে বাধ্য করছে । সবশেষে, দেশে ফিরে বিরোধীরাও মুইজ্জুকে সামগ্রিক সংশোধনের জন্য বাধ্য করেছে ৷ মুইজ্জুর পূর্বসূরি মহম্মদ সোলিহের দেওয়া পরামর্শ থেকে স্পষ্ট যে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপ্রধানের 'একগুঁয়ে' হওয়া উচিত নয় ।
কিন্তু মুইজ্জু তাঁর উত্তরের প্রতিবেশীর সঙ্গে তার দেশের সুবিধার জন্য কতটা বাস্তববাদী এবং যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি দেখাতে পারেন, তা দেখতে হবে ।