ডব্লিউটিও-র ত্রয়োদশতম মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন (এমসি13) 26 এবং 29 ফেব্রুয়ারির মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর আবুধাবিতে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ৷ এমসি হল 164-সদস্যের ডব্লিউটিও-এর সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থা, যারা সাধারণত দ্বি-বার্ষিকভাবে মিলিত হয় ।
ভারত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) 13তম মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে (এমসি13) কৃষি সংক্রান্ত কোনও আলোচনায় জড়িত হবে না, যদি না সদস্যরা প্রথমে দেশের পাবলিক প্রকিওরমেন্ট সিস্টেমের মূল পাবলিক স্টকহোল্ডিংয়ের সমস্যাটির স্থায়ী সমাধান খুঁজে না পান । যা 800 মিলিয়ন দরিদ্র মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং 95.3 মিলিয়ন জীবিকা-স্তরের কৃষকদের ন্যূনতম সমর্থন মূল্য (এমএসপি)-এর গ্যারান্টি দেয় ৷
অধিকাংশ ভারতীয় কৃষক দরিদ্র, এবং তাঁদের এমএসপি সমর্থন প্রয়োজন ৷ যার ফলে খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচি নিশ্চিত করতে পাবলিক স্টকহোল্ডিং গড়ে তোলা প্রয়োজন ৷ যেমন প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ আন যোজনা (PMGKAY) প্রতি মাসে 813.50 মিলিয়ন দরিদ্র মানুষকে বিনামূল্যে রেশন প্রদান করে ।
ডব্লিউটিও-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ভারত উন্নত দেশগুলির অন্যান্য এজেন্ডা যেমন কৃষি ভর্তুকির মতো আলোচনা করতে ইচ্ছুক । মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে খাদ্যশস্য রফতানির উপর বিধিনিষেধ, সদস্যরা সর্বপ্রথম পাবলিক স্টকহোল্ডিংয়ের স্থায়ী সমাধানে একমত হন । ন্যূনতম সমর্থন মূল্য হল পাবলিক স্টক হোল্ডিংয়ের চাবিকাঠি, যাতে চাল এবং গমের মতো খাদ্যশস্য কৃষকদের কাছ থেকে প্রশাসনের হারে যা বাজার মূল্যের চেয়ে বেশি, কেনার বিষয়টি জড়িত থাকে । কিছু ডব্লিউটিও সদস্য দেশ যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, নিউজিল্যান্ড এবং অনুরূপ অন্যান্য দেশ যাঁরা কৃষি পণ্য রফতানির সঙ্গে জড়িত, তারা ভারতের কৃষকদের ন্যূনতম সমর্থন মূল্য দেওয়ার এই অভ্যাসকে আপত্তি জানায় ।
এই দেশগুলি দাবি করে যে, এমএসপি কার্যক্রম হল বাণিজ্য-বিকৃতকারী ভর্তুকি ৷ 2013 সালের ডিসেম্বরে বালির নবম মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে এমসি11 দ্বারা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য পাবলিক স্টক হোল্ডিংয়ের বিষয়ে একটি স্থায়ী সমাধান নিয়ে আলোচনা করতে সম্মত হয়েছিল সদস্য দেশগুলি এবং অন্তর্বর্তী সময়ে সংযম অনুশীলন করতে সম্মত হয় তারা, যাকে বলা হয় 'শান্তি ধারা'। যদিও স্থিতাবস্থা বজায় রাখা হয়েছে এবং পাবলিক স্টক হোল্ডিংকে বিতর্কিত করা যাবে না, তবে ভারত চায় অন্য কোনও সমস্যা নিয়ে পদক্ষেপ করার আগে অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাকে কৃষি সংক্রান্ত চুক্তির (এগ্রিমেন্ট অফ এগ্রিকালচার) একটি স্থায়ী ধারা তৈরি করা হোক। উন্নয়নশীল দেশগুলির জোট (জি-33) এবং আফ্রিকান গ্রুপ-সহ আশিটিরও বেশি দেশ এই বিষয়ে ভারতকে সমর্থন করছে ।
'শান্তি ধারা' একটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা যা একটি স্থায়ী সমাধান না আসা পর্যন্ত ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলির জন্য একটা বড় স্বস্তি । ভারত খাদ্যশস্যের একটি প্রধান উত্পাদক হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে এবং তারা জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি এটি বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তায় একটি প্রধান রফতানিকারক হিসেবে অবদান রাখছে । দেশের নাগরিকদের ভর্তুকিযুক্ত খাদ্য সরবরাহ করে এই দেশ বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিশ্বকে সহায়তা করছে । কিন্তু কৃষিপণ্য রফতানিকারক দেশগুলি এটি পছন্দ করে না ।
ডব্লিউটিও গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে, কয়েকটি উন্নত দেশ যারা আন্তর্জাতিক পণ্য বাণিজ্যে শক্তিশালী দখল উপভোগ করেছিল তারা এমনভাবে ডব্লিউটিওর নিয়ম তৈরি করেছে যে, সদস্যদের খাদ্য ভর্তুকি বিল 1986-88 এর এক্সটার্নাল রেফারেন্স প্রাইস (ইআরপি) এর উপর ভিত্তি করে উৎপাদন মূল্যের 10% এর মধ্যে সীমাবদ্ধ হওয়া উচিত । সীমার উপরে ভর্তুকি দেওয়াকে বাণিজ্য বিকৃতি হিসাবে বিবেচনা করা হয় । 1988 থেকে এখনও পর্যন্ত অনেক পরিবর্তন হয়েছে । কৃষি প্রযুক্তি পরিবর্তিত হয়েছে, ইনপুট খরচ এবং আউটপুট মূল্যের মধ্যে সম্পর্ক পরিবর্তিত হয়েছে । ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে খাদ্য নিরাপত্তা প্রয়োজন এমন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়েছে ।
ক্ষুদ্র কৃষকের সংখ্যা, যাঁরা বড় দেশগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে না, যাঁরা তাঁদের কৃষিপণ্য উন্নয়নশীল দেশে ফেলে দিতে পারে, তাঁদের সংখ্যাও বেড়েছে । প্রকৃতপক্ষে, ক্ষুদ্র কৃষকদের আজ আরও বেশি সরকারি সহায়তা প্রয়োজন এবং দরিদ্র মানুষদের আজ ডব্লিউটিও গঠনের দিনগুলির তুলনায় উচ্চতর খাদ্য নিরাপত্তা প্রয়োজন ।
চাল ও পেঁয়াজের মতো কৃষিপণ্যের উপর ভারত কর্তৃক আরোপিত রফতানি নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আলোচনা করতে চায় উন্নত দেশগুলি । বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাগুলি খাদ্য মূদ্রাস্ফীতির লাগাম টানতে এবং ভারতীয় নাগরিকদের জন্য পর্যাপ্ত অভ্যন্তরীণ সরবরাহ রাখার উপকরণ । এছাড়া ভারত দরিদ্র দেশগুলোর অনুরোধে খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করে আসছে । যদিও জাপান এবং সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলি খাদ্য সামগ্রী আমদানির উপর নির্ভর করে, তবে এর জন্য অর্থ প্রদানে তারা যথেষ্ট সক্ষম কারণ তারা ধনী ।
প্রকৃতপক্ষে, উন্নত দেশগুলির যুক্তিগুলি কৃষক এবং নাগরিকদের চেয়ে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষায় বেশি মনোযোগী ৷ খাদ্য নিরাপত্তা ভারতের কাছে প্রধান গুরুত্ব এবং তার দরিদ্র কৃষকদের জন্য সরকারের দেওয়া ভর্তুকি যেমন বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, সেচ সুবিধা, সার এবং 95 মিলিয়নেরও বেশি কৃষকের অ্যাকাউন্টে 6,000 টাকা করে সরাসরি ট্রান্সফার - এগুলি আলোচনাযোগ্য নয় বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা । প্রকৃতপক্ষে, উন্নত দেশগুলি তাদের কৃষকদের কৃষি ভর্তুকিতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার হস্তান্তর করে ৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ বলেছিল যে, তারা ডব্লিউটিও-র সম্মেলনে পাবলিক স্টকহোল্ডিংয়ের স্থায়ী সমাধানের জন্য ভারতের দাবির প্রতিবাদ জানাবে ৷
অন্যদিকে, ভারতের প্রতি জি-33 উন্নয়নশীল দেশগুলির সমর্থন রয়েছে, যাদের কৃষিতে প্রতিরক্ষামূলক স্বার্থ রয়েছে ৷ যেমন, আফ্রিকা গ্রুপ এবং আফ্রিকান, ক্যারিবিয়ান এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলি ৷ সবমিলিয়ে ভারতকে সমর্থনকারী দেশগুলির সংখ্যা 90-এর কাছাকাছি ৷ যেহেতু ডব্লিউটিওতে সমস্ত সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়, তাই এই ইস্যুটি উত্তপ্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে ৷
ভারত এখনও এই দাবিতে অনড় যে, জনসাধারণের সংগ্রহ এবং খাদ্যশস্যের স্টক হোল্ডিং খাদ্যের দ্বিমুখী উদ্দেশ্য পূরণ করে - নিরাপত্তা এবং আয় সমর্থন । সমস্যাটির স্থায়ী সমাধানের অংশ হিসাবে, ভারত চায় যে ডব্লিউটিও চুক্তির অধীনে অনুমোদিত কৃষি ভর্তুকির পরিমাণ গণনা করার ভিত্তি বছরটিকে বর্তমান বছরে সংশোধন করা হোক । বর্তমানে 1986-1988 মূল্যে মোট উৎপাদন মূল্যের 10% ভর্তুকি সীমাবদ্ধ । প্রায় 7 বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চালে ভারতের ভর্তুকি সেই সীমা অতিক্রম করে এবং যা উৎপাদন মূল্যের 15% । অন্যান্য শস্যে এটি 3% এর নীচে । এটি মোটা শস্য এবং ডালের মতো সমস্ত প্রধান খাদ্যশস্যের জন্য এটি অনুমোদিত। চালের ক্ষেত্রে অনুমোদিত সমর্থন অতিক্রম করা সত্ত্বেও, শান্তি ধারার কারণে ভারতকে বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়ায় নেওয়া যাবে না । কৃষিতে অন্যান্য সহায়তা যেমন ভর্তুকিযুক্ত বিদ্যুৎ, সার, সেচ এবং এমনকি সরাসরি নগদ ট্রান্সফার যেমন পিএম কিসান উন্নয়নের বাক্সে রয়েছে, তাই ডব্লিউটিও-তে বিতর্ক করা যাবে না বলে জানান ওই কর্মকর্তা ।
ভারতের আরেকটি চ্যালেঞ্জ খাদ্যশস্যের উপর তার রফতানি বিধিনিষেধ রক্ষা করা । যদিও ভারত এটাই বলে রেখেছে যে, এগুলি অভ্যন্তরীণ খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ব্যবহার করা হয় ৷ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, কোস্টা রিক্যা এটিকে বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার একটি প্রধান কারণ হিসাবে বিবেচনা করে ৷ তারা একটি বাজার তৈরি করছে ৷ তারা রফতানি বিধিনিষেধযুক্ত ব্যবস্থাগুলিতে আরও স্বচ্ছতা আনছে এবং কেনার এক মাসের আগে নোটিশ পাঠাবে ৷ ভারতের অবস্থান হল যে, এর পাবলিক স্টকহোল্ডিং এবং অন্যান্য কৃষি নীতিগুলি বিশ্বব্যাপী দামকে সবার নাগালের মধ্যে রেখেছে ৷
খাদ্যশস্যের বৈশ্বিক বাণিজ্য 3 কোটি টন । ভারত যদি চাহিদার মাত্র 10% মেটাতে বাজারে প্রবেশ করে, যা প্রায় 25 মিলিয়ন টন, তাহলে তাতে একটি সংকটের সৃষ্টি হবে ৷ ভারত তার পক্ষ থেকে ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বাজার সমর্থনে যে জায়গায় রয়েছে তা চ্যালেঞ্জ করবে ৷ প্রতিটি পণ্যের উপর তাদের ভর্তুকি 5% সীমাবদ্ধ থাকা অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে 19 বিলিয়ন মার্কিন ডলার কৃষি বিপণন সহায়তা (এগ্রিকালচার মার্কেটিং সাপোর্ট) প্রদান করার জায়গা রয়েছে, যেখানে ইউরোপে 72 বিলিয়ন ডলার প্রদান করার জায়গা রয়েছে ।
এই বড় অংকগুলি যে কোনও পণ্যের জন্য বরাদ্দ করা যেতে পারে, যা তখন অনেক ছোট দেশের বাজারকে ধ্বংস করতে পারে ৷ ভারত কৃষিতে বিশেষ সুরক্ষা ব্যবস্থার জন্য তার অধিকার রক্ষা করবে, যা সদস্যদের উপর বিভিন্ন স্তরের বাধ্যবাধকতা রাখে ৷ সৌভাগ্যবশত, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে ভারতের শক্তি সাম্প্রতিক বছরগুলিতে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে । প্রকৃতপক্ষে, আমাদের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলির উপর আরও প্রভাব অর্জন করেছে, বিশেষ করে আফ্রিকাতে কোভিড 19 টিকা সহায়তার কারণে এটি হয়েছে ৷ বেশ কয়েকটি দরিদ্র দেশেও টিকা দিয়েছে ভারত ৷ তার উপর জি20-তে গ্লোবাল সাউথকে নেতৃত্ব প্রদান করেছে ভারত, তার কারণে এই দেশ আজ আগের চেয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করবে বলে আশা করা হচ্ছে ।
আরও পড়ুন: