গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশে যা ঘটেছে, তা থেকে ফিরে এসেছে আরব বসন্তের স্মৃতি, যা 2010-11 সালে হয়েছিল ৷ সেই সময় উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে দীর্ঘমেয়াদী স্বৈরাচারী শাসকদের উৎখাত করার জন্য় ব্যাপক আন্দোলন হয়েছিল ৷ ওই আন্দোলন থেকে হিংসাও ছড়িয়েছিল ৷ বাংলাদেশে অবশ্য আন্দোলন শুরু হয়েছিল সংরক্ষণ ইস্যুতে ৷ তার সঙ্গে ছিল কর্মসংস্থান না হওয়ার ইস্যুটি ৷ 2019 সালে হংকং ও 2022 সালে শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রেও ছাত্ররা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন । বাংলাদেশের বিক্ষোভে পরবর্তীকালে জামাত-ই-ইসলামি ঢুকে পড়ে ৷ এই সংগঠনকে নিষিদ্ধ করে দেন শেখ হাসিনা ৷ তার পর থেকে হাসিনার উপর তাদের রাগ আরও বেড়ে যায় ৷ সেই কারণেই শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি-সহ হাসিনার বাসভবন ও পরিবারের অন্য সদস্যদের মূর্তি ভাঙা চলছে ৷
আরব বসন্তের মতো এক্ষেত্রেও রক্ত ঝড়েছে ৷ রক্তপাত ছাড়া নিরাপত্তা বাহিনী হিংসাত্মক জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খেয়েছে ৷ যার ফলে নেতারা হয় পদত্যাগ করেছেন অথবা অন্য কোথাও গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন । তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট সৌদি আরবে পালিয়ে যান, মিশরের হোসনি মোবারক পদত্যাগ করেন এবং লিবিয়ার গদ্দাফি নিহত হন । বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনাও দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেন । বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের মতো বিক্ষোভকারীদের উপর সেনাবাহিনী গুলি চালাতে অস্বীকার করার পরই শাসকরা হয় পদত্যাগ করেন অথবা পালিয়ে যান ।
যেসব দেশে আরব বসন্ত হয়েছিল, সেখানে মৌলিক দাবি ছিল গণতন্ত্র ও মানবাধিকার । হাসিনা কার্যত একজন স্বৈরতান্ত্রিক শাসক ছিলেন ৷ তিনি তাঁর বিরোধীদের দমন করেছিলেন ৷ বিরোধীদের কারাগারে আটকে রেখেছিলেন বা রাজনৈতিক দলগুলিকে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি বিক্ষোভ দমন করতে নিরাপত্তা বাহিনী নিয়োগ করেছিলেন । তিনি বাংলাদেশকে একদলীয় দেশে পরিণত করেছিলেন । সম্প্রতি শেষ হওয়া নির্বাচন দু’টি বৃহত্তম রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে হয় কেউ প্রসহসনের অভিযোগ তুলে অংশ নেয়নি, না হলে কাউকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে নির্বাচনে লড়তে দেওয়া হয়নি ৷ ফলে সংরক্ষণ বিরোধী আন্দোলন ছিল স্ফুলিঙ্গ মাত্র ।
তিউনিসিয়া ছাড়া আরব বসন্তের পরে সেখানকার অন্য কোনও দেশের গণতন্ত্র স্থিতিশীল হয়নি ৷ বিশেষ করে ইয়েমেন ও লিবিয়াতে পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হয় ৷ বাংলাদেশের পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, সেটাই দেখতে হবে ৷ ছাত্ররা কি আধিপত্য ধরে রাখবেন নাকি রাজনৈতিক দলগুলি তাঁদের সরিয়ে দেবে, তা এখনও অজানা । কতদিন পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকার দেশ চালাবে, সেটাও আরেকটি বিষয় । এর আগে একবার বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নির্বাচন ঘোষণার আগে দুই বছর অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমে শাসন করেছিল ।
সমস্ত আরব বসন্তের দেশগুলিতে রাষ্ট্রপ্রধানকে অপসারণের পরে প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা । বাংলাদেশেও একই অবস্থা ৷ সেখানে আওয়ামী লীগের সদস্যদের পরিকল্পিতভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে । পুলিশ তাঁদের প্রাণের ভয়ে উধাও হয়ে গিয়েছে । আইনশৃঙ্খলাহীন পরিস্থিতিতে সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত ৷ নৈরাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে সবসময় সময় লাগে । বাংলাদেশেও একই রকম দৃশ্য দেখা যাচ্ছে ।
আরব বসন্তে বিদ্রোহের প্রধান কারণ ছিল সরকারের দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক সুযোগের অভাবের কারণে হতাশা । বাংলাদেশেও তাই হয়েছে । 1971 সালের প্রবীণ সৈনিকদের সন্তান-সহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ সংরক্ষণের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ অনেকটাই কমে গিয়েছিল ৷ পাশাপাশি দুর্নীতিও হয়েছে ব্য়াপক হারে ৷
বাংলাদেশ কোভিডের পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল । তেল-সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম দ্রুত বেড়েছে ও রফতানি কমেছে । সেটা কখনোই আগের অবস্থায় ফেরানো যায়নি ৷ ফলে জনসাধারণের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে ।
বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের পেছনে স্বার্থান্বেষী দেশগুলোর এজেন্সিগুলোর সম্ভাব্য জড়িত থাকার ষড়যন্ত্র তত্ত্ব রয়েছে । বাস্তবিকভাবে প্রতিটি দেশেরই অন্য দেশে স্বার্থ জড়িয়ে থাকে । যুক্তরাষ্ট্র, চিন ও ভারতের বাংলাদেশে নিজস্ব স্বার্থ রয়েছে ৷ ভারত বাংলাদেশের সরকারকে সমর্থন করলেও কয়েকজনকে পরিবর্তনের জন্য জোর দিচ্ছিল ।
পাকিস্তানেরও বাংলাদেশ নিয়ে নিজস্ব এজেন্ডা রয়েছে, বিশেষ করে ভারত যেহেতু বাংলাদেশের পছন্দের প্রতিবেশী ছিল । এই ধরনের হস্তক্ষেপ একটি বিশ্বব্যাপী ঘটনা । ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিবেশী কয়েকটি দেশে নিজেদের স্বার্থ কায়েম করার অভিযোগ রয়েছে । অভিযোগগুলি কতটা সত্য, তা কখনোই জানা যাবে না ৷ কারণ, বেশিরভাগ অপারেশনই গোপনীয়তার সঙ্গে করা হয় ।
ভারতের অভ্যন্তরেও এমন অনেক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা (রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক) আছে, যারা বিদেশ থেকে অর্থ সাহায্য পায় এই দেশে অন্য দেশের এজেন্ডাগুলি প্রচার করার জন্য ৷ বাংলাদেশের অবস্থাও একই । বাংলাদেশে অভ্যুত্থান ঘটাতে বিদেশি শক্তির হাত কতটা কার্যকর ছিল, সেটাই দেখার বিষয় ।
বর্তমানে পড়ুয়ারা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য এগিয়ে রয়েছে । তাঁরা ট্র্যাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছেন, সংখ্যালঘুদের রক্ষা করছেন এবং যে শহরে পুলিশ দেখা যাচ্ছে না, সেখানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছেন বলে জানা গিয়েছে । তাঁরা সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতির সঙ্গেও দেখা করেছেন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য 15 জনের নাম পাঠিয়েছেন । তাঁরা ধর্মের আধিপত্য নয়, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চান । তাঁরা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান চান । ছাত্ররাই প্রথমে মহম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান করতে চেয়েছিলেন ।
শিক্ষার্থীদের সুপারিশের ভিত্তিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ঘোষণা করেছে যে টেকনোক্র্যাট মহম্মদ ইউনূস (84) অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দেবেন । ভারত ও চিন পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে ৷ কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাঁর নাম ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে ৷ কারণ, ক্লিনটন ফাউন্ডেশন ও অন্যান্য মার্কিন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে । সর্বোপরী তিনি ওই দেশে পড়াশোনা করেছেন ও শিক্ষকতা করেছেন । তাঁর নিয়োগ ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের সঙ্গে আরও ভালো সম্পর্কের ইঙ্গিত দিচ্ছে ৷ কারণ, উন্নয়নের জন্য বাণিজ্য ও অর্থের জোগান থাকা অপরিহার্য ।
হাসিনা সরকার ভারতের মদতপুষ্ট হওয়ায় ভবিষ্যতে যেকোনও সরকারই ভারতবিরোধী হতে বাধ্য, এমন একটি তত্ত্ব রয়েছে । ভারত ও বাংলাদেশ প্রতিবেশী ৷ দুই দেশের মধ্যে চার হাজার কিলোমিটারের বেশি সীমান্ত রয়েছে । কোনও দেশই অন্যকে উপেক্ষা করতে পারবে না । ছিটমহল ও সমুদ্রসীমার সমস্যার সমাধান হয়েছে । কোনও বিরোধের সমাধান হওয়া পড়ে নেই ৷
তাই বাংলাদেশে যে সরকারই আবির্ভূত হোক না কেন, তারা ভারতকে উপেক্ষা করতে পারবে না । বিভিন্ন সময়ে শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও নেপালেও ভারত-সমর্থক ও বিরোধী সরকার গড়ে উঠেছে । সেই সব ক্ষেত্রেও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক কখনোই খারাপ হয়নি ৷ কারণ, তারা সবাই বুঝতে পারে যে ভারতের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক অপরিহার্য ।
অতীতে কিছুটা সময় যেখানে যেখানে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে দেশ ছিল, সেখানেও সেনা একটি স্থিতিশীল ভূমিকা পালন করতে থাকবে । যদিও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আধিপত্য পাকিস্তানের মতো নাও হতে পারে ৷ তবে বাংলাদেশের সেনা দেশের স্বার্থরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করবে ৷ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক বরাবরই উষ্ণ ।
বাংলাদেশের অফিসাররা ভারতের সঙ্গে প্রশিক্ষণে অংশ নেয়, ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে অনুশীলন পরিচালনা করে এবং কিছু ভারতীয় অস্ত্র ব্যবহার করে । উভয় দেশ যৌথভাবে প্রতি বছর ডিসেম্বরে বিজয় দিবস উদযাপন করে । এটি অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে ।
ভারতকে বুঝতে হবে যে বাংলাদেশে যা কিছু ঘটছে, তা জনগণের ইচ্ছা । শেখ হাসিনার উপর বিষোদগার অবশ্যই বন্ধ করতে হবে এবং ঢাকায় যারাই ক্ষমতায় আসবে, তাদের সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে । একটি যুগের অবসান হয়েছে এবং একটি নতুন যুগ শুরু হচ্ছে । আকস্মিক পরিবর্তন বিরল ৷ কিন্তু ঘটতে পারে । বিভিন্ন দেশ এই পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেয় এবং কিছু সময়ের পরে এটা স্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয় ৷ ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা হবে ।
ভারতের জন্য একটি বড় উদ্বেগের বিষয় হল, বাংলাদেশে বর্ধিত অনিশ্চয়তা সীমান্তের ওপার থেকে এপারে শরণার্থীর সংখ্যা বাড়তে পারে ৷ এটা ক্ষতিকর হতে পারে৷ কারণ, এতে অনেক সীমান্ত অঞ্চলের জনসংখ্যা প্রভাবিত হবে । সীমান্তে বিএসএফ-কে সতর্ক থাকতে হবে ।
আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হল সংখ্যালঘুদের উপর ও তাদের প্রার্থনাস্থলে উপর তাণ্ডব চালানো । তাদের নিরাপত্তা দেওয়া বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দায়িত্ব, যা বর্তমানে তাদের সেনাপ্রধানের নেতৃত্বে রয়েছে । এটা নিশ্চিত করার জন্য ভারত সরকারকে অবশ্যই ঢাকায় তার মিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে । গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিশ্বব্যাপী চাপ থাকলেও তাড়াহুড়ো করা হবে না । অগ্রাধিকার হবে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা, নিরাপত্তা পুনরুদ্ধার করা ও তারপরে পরিকল্পনা করা । এটাই বৈশ্বিক নিয়ম ও বাংলাদেশের জন্যও তাই হবে ।
নবনির্বাচিত নেতাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত ঋণের ফাঁদে না ডুবে তাদের উন্নয়ন ও জনগণের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা । তারা খুব কমই অতীতের ক্ষোভ বহন করে । ভারত সবসময় সমর্থনের জন্য আছে ও এটা অজানা বিষয় নয় । ভারত তার আশেপাশে বিভিন্ন সরকারের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক রেখে চলেছে ৷ সর্বদা পাশে থেকেছে । আশা করি সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই হবে । যা প্রয়োজন তা হল ধৈর্য এবং কৌশলী কূটনীতি, যা ভারতের শক্তি ।