ইজরায়েলের মোসাড এবং তাদের সাইবার ওয়ারফেয়ার ইউনিট 8200 কীভাবে লেবানন জুড়ে পেজার, হাতে ধরা ওয়াকি-টকি এবং সৌর শক্তি সিস্টেমে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, তার সঠিক বিবরণ না থাকলেও, এটা বলা যায় যে এই ঘটনা হাইব্রিড যুদ্ধকে নতুন মাত্রা দিয়েছে ৷ এই আক্রমণের ফলে লেবাননে আতঙ্ক তৈরি করেছে ৷ এর ফলে তারা তাদের সমস্ত আধুনিক প্রযুক্তির ডিভাইসগুলি ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছে ৷ পাশাপাশি তারা বাধ্য হয়েছে যোগাযোগের প্রাচীন উপায়ে ফিরে যেতে ।
এই আক্রমণের জেরে হিজবুল্লা নেতাদের মনে অনিশ্চয়তা ও বিভ্রান্তিও তৈরি হয়েছে ৷ ফলে ইজরায়েল তাদের বাহিনীকে আক্রমণের জন্য পুনরায় সংঘবদ্ধ করার সময় ও জায়গা পেয়ে যাচ্ছে ৷ একই সঙ্গে ইলেকট্রনিক ডিভাইস থেকে উদ্ভূত ঝুঁকিও সামনে এসেছে এই আক্রমণের ফলে ।
ইউনিট 8200 সম্বন্ধে জেরুজালেম পোস্ট জানিয়েছে, ‘ইউএস ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি বা ব্রিটেনের জিসিএইচকিউ-এর সমতুল্য এবং ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনীর বৃহত্তম একক সামরিক ইউনিট ।’ সিগনাল ইন্টালিজেন্স, ডেটা মাইনিং থেকে সাইবার অ্যাটাক, এই কাজগুলিই করে ইউনিট 8200 ৷ ইরানের পারমাণবিক সেন্ট্রিফিউজ নিষ্ক্রিয় করতে সাইবার স্ট্রাইক-সহ একাধিক ঘটনা আগেই ঘটিয়েছে এই ইউনিট ৷ হামাসের উপর আক্রমণ করতে এই ইউনিট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করত বলে জানা গিয়েছে । তবে গত বছর 7 অক্টোবরের হামলা শনাক্ত করতে না পারার কারণে এর খ্যাতি নষ্ট হয় ৷ যার ফলে এর প্রধান পদত্যাগ করেন ।
মিডিয়া রিপোর্ট অনুমান করে যে ইজরায়েল হিজবুল্লার তরফে দেওয়া একাধিক যোগাযোগ সরঞ্জামের জন্য অর্ডার আটকাতে সক্ষম হয় এবং রেডিয়ো সংকেতের মাধ্যমে সেই সরঞ্জামগুলিতে বিস্ফোরণ করার জন্য বিস্ফোরক ও চিপ বসিয়ে দেয় ৷ বিস্ফোরণ ঘটা ডিভাইসগুলি যে সংস্থা তৈরি করেছে বলে মনে করা হচ্ছে, তারা এই ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে৷ তবে মনে করা হচ্ছে যে ইজরায়েলের অপারেটিভদের মালিকানাধীন একটি শেল কোম্পানিকে অর্ডার দেওয়া হয়েছিল ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই বিষয়টি জানত বা এর সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছে ৷ যদিও সিএনএনের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আসন্ন হামলার বিষয়ে অবহিত করা হয়েছিল ৷ তবে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হয়নি ৷ যদিও ইজরায়েল মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছে ৷ তাদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট উল্লেখ করেছেন, ‘আমরা এই যুদ্ধে একটি নতুন যুগের শুরুতে রয়েছি এবং আমাদের নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে হবে ।’ ইজরায়েলিরা বিষয়টি স্বীকার করার সবচেয়ে কাছাকাছি মন্তব্য এটি । কিন্তু বিশ্বের জন্য এই হাইব্রিড যুদ্ধ এখন একটি বিপজ্জনক পর্যায়ে প্রবেশ করেছে, যেখানে সাধারণ মানুষ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ।
ডিভাইসগুলিতে বিস্ফোরক ছিল বলেই বিস্ফোরণ হয়েছে, এমনটাই দাবি করা হয়েছে ৷ কিন্তু ইলেকট্রনিক সিগন্যাল ব্যবহার করে একই রকম ভাবে তৈরি অনেক ব্যাটারিতে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে কি না, সেটা স্পষ্ট নয় । হ্যাকাররা জানিয়েছে যে দূরে থাকা কোনও ডিভাইসকে বিকৃত করার জন্য ম্যালওয়্যার পাঠানো সম্ভব ৷ তবে সম্ভবত এর কোনও সাক্ষী নেই ৷ হিজবুল্লা পেজারে স্যুইচ করতে বাধ্য হয়েছিল, যখন তারা বুঝতে পেরেছিল যে ইজরায়েলিরা মোবাইল সিগন্যালের উপর ভিত্তি করে সিনিয়র কমান্ডারদের সনাক্ত করছে এবং সুনির্দিষ্টভাবে তাঁদের উপর আক্রমণ করছে । এই আক্রমণের পর পেজার এবং হাতে ধরা ওয়াকি-টকি ব্যবহারও লেবাননে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে । এর ফলে হিজবুল্লা কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না ৷ অথচ যোগাযোগ রাখাই যুদ্ধের একটি অপরিহার্য পূর্বশর্ত ।
ইজরায়েলের এই কৌশলগত অপারেশন গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে ৷ প্রাথমিকভাবে একাধিক জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধে প্রভাব পড়বে । হিজবুল্লা প্রতিশোধ নিতে বাধ্য হবে ৷ তবে প্রস্তর যুগের যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করে এটা সহজ হবে না । তাদের নেতৃত্বে কিছু সময়ের জন্য বিভ্রান্তি বিরাজ করবে । এটি ইজরায়েলিদের দ্বারা শোষিত হবে ।
হিজবুল্লার মধ্যে ইজরায়েলি গুপ্তচরদের সম্ভাব্য অস্তিত্ব নিয়ে ক্রমবর্ধমান অস্বস্তি তৈরি হচ্ছে ৷ যাঁরা মোসাডের কাছে খবর ফাঁস করে দিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে ৷ এর ফলে অবিশ্বাস বৃদ্ধি পেতে পারে হিজবুল্লার অন্দরে ৷ কে গুপ্তচর, তা খুঁজতে অভিযান শুরু হতে পারে ৷ সাম্প্রতিক হামলায় মৃত্যুর সংখ্যা কম ছিল ৷ তবে আহতদের মধ্যে হিজবুল্লার পদাধিকারীরাই বেশি ৷ তাছাড়া এই হামলার জেরে অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলিও ডিভাইস ব্যবহার নিয়ে শঙ্কিত ৷
আশঙ্কায় রয়েছে ইজরায়েলও ৷ তারা মনে করছে হিজবুল্লা ও তার সহযোগীরা পালটা প্রতিশোধ নিতে রকেট হামলা করতে পারে ৷ এর পর হয়তো ইজরায়েল পালটা হামলা চালাতে পারে ৷ তার পরও হিজবুল্লার তরফে হামলার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না ৷ যে হামলায় হতাহতের ঘটনাও ঘটতে পারে । কয়েকদিন আগে যে যুদ্ধবিরতি সম্ভব হয়েছিল, তা এখন ইতিহাসে পরিণত হয়েছে ৷ এর ফলে হামাসের হেফাজতে ইজরায়েলের পণবন্দিদের নিরাপত্তা প্রশ্নের মুখে পড়েছে ৷ ইরানও এখন ইজরায়েলের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধ চালাতে পারে ৷
ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সংঘাত বাড়ানোর লক্ষ্য অর্জন করেছেন । এতে তাঁর চেয়ার আরও কিছু সময়ের জন্য সুরক্ষিত থাকবে । হিজবুল্লার হামলার কারণে প্রত্যাহার করা বাস্তুচ্যূত ইজরায়েলিদের উত্তর ইজরায়েলে তাঁদের বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে অভিযানটি শুরু করা হয়েছিল । ফলে সংঘাত বাড়লেও তার বিরুদ্ধ স্বর শোনা যাবে না এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এটাকে সমর্থন করতে বাধ্য হবে । তাই শান্তি ও যুদ্ধবিরতির আশা বাষ্পীভূত হয়ে গিয়েছে ৷
হামাসের আক্রমণের প্রথম বার্ষিকী প্রায় চলে এসেছে ৷ ইজরায়েল তার যুদ্ধের লক্ষ্য অর্জনের কাছাকাছি নেই । কোনও কৌশল বা অবস্থা অবশিষ্ট নেই ৷ অথচ এর জেরে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির মধ্যে সংঘাতে তৈরি হয়েছে । ওই অঞ্চলে প্রাণহানি ও ধ্বংসের পরিমাণ মারাত্মক ।
ইরান প্রায় একশো আহত হিজবুল্লা সৈন্যকে চিকিৎসার জন্য তাদের দেশে নিয়ে গিয়েছে ৷ তারাও নিজেদের সীমান্তের মধ্যে একই ধরনের হামলার সম্ভাবনা বিবেচনা করবে । এর সেন্ট্রিফিউজগুলি ইজরায়েল আগের সাইবার আক্রমণে নিষ্ক্রিয় করেছিল । এর পুনরাবৃত্তি হতে পারে ৷ লেবাননে হামলার জবাব দিতে পারে ভেবে ইরানকে সতর্ক করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
বিশ্বব্যাপী দেশগুলি তাদের শীর্ষ অসামরিক এবং সামরিক কর্মকর্তাদের জন্য সিস্টেমগুলিতে দেশীয় উন্নত সফ্টওয়্যার-সহ সুরক্ষিত নেটওয়ার্ক ব্যবহারে জোর দিচ্ছে ৷ এর জন্য তারা বিশ্বস্ত কোম্পানি থেকে বিপুল সংখ্যক মোবাইল সেটের অর্ডার দেয় । এইগুলি তারপর সংশোধন করা হয় ৷ উদ্দেশ্য হল সিনিয়র কমান্ডারদের অবস্থানগুলিকে গোপন রাখা ও তা হ্যাক হওয়া থেকে বাঁচানো । ইজরায়েলের এই পদক্ষেপের পর প্রয়োজন হবে যে কোনও ম্যালওয়ারের জন্য এই জাতীয় সমস্ত ডিভাইস পুনরায় পরীক্ষা করা ৷ এটা ব্যয়বহুল কাজ৷ তবে এটা উপেক্ষা করা যাবে না ।
বৃহত্তর জনসংখ্যার দেশ, প্রধানত যে দেশগুলি চিন বা অন্যান্য প্রতিপক্ষ দেশ থেকে ইলেকট্রনিক হার্ডওয়্যার আমদানি করে, তারাও সরঞ্জামের মধ্যে একই ধরনের ম্যালওয়্যার নিয়ে উদ্বিগ্ন হবে । স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রতিপক্ষ দেশগুলি থেকে ক্রয় কমাতে সরকারগুলিকে চাপ দেওয়া হবে ।
দেশগুলি এখন ইজরায়েলি মডেল অনুসরণ করতে চাইবে এবং তাদের প্রতিপক্ষকে আরও ভালোভাবে আক্রমণ করার জন্য সম্ভবত প্রযুক্তির বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা করবে । হাইব্রিড যুদ্ধ এখন একটি নতুন পর্বে প্রবেশ করেছে । অনেক সময় সংবেদনশীল অবস্থানে কর্মীরা নিজের লুকিয়ে রাখতে ইন্টারনেট ছাড়াই বেসিক মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন ।
আইনগতভাবে, এই আক্রমণটিকে একটি বুবি ট্র্যাপ হিসাবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে, যা আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ । তবে ইজরায়েল এই হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছে । যদিও একটি মোবাইল ফোনে এখনও বিস্ফোরণ হতে পারে ৷ এই বিষয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন ৷ এটা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই প্রথম আক্রমণাত্মক ভূমিকায় ড্রোন ব্যবহার করে, বর্তমানে প্রতিটি দেশ এবং জঙ্গি গোষ্ঠীও বিপক্ষের বিরুদ্ধে ড্রোন ব্যবহার করা শুরু করেছে ৷ ইজরায়েল একটি পথ দেখিয়েছে ৷ এবার তা অন্যরা অনুসরণ করবে । বিশ্ব এখন একটি ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা হবে ।
(এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের ৷ এখানে প্রকাশিত তথ্য ও মতামত ইটিভি ভারত-এর মতামতকে প্রতিফলিত করে না ৷)