হায়দরাবাদ, 3 জুলাই: কয়েক দশক ধরে দেশের আইনি ব্যবস্থাকে রূপ দিয়েছে ইন্ডিয়ান পেনাল কোর্ট(ভারতীয় দণ্ডবিধি), ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট এবং কোড অফ ক্রিমিনাল প্রসিডিওর । এই আইনগুলি ন্যায়বিচারের ভিত্তি স্থাপন করলেও তারা আধুনিক ভারতের সমস্যাগুলিকে মোকাবিলা করতে ক্রমশ ব্যর্থ । বর্তমানে একটি নতুন যুগের সূচনা হয়েছে ৷ ভারত সেই যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে নতুন তিন ফৌজদারি আইনের প্রবর্তন করেছে ৷ এর মাধ্যমে আইনের ক্ষেত্রে বিবর্তনের দিকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিল ভারত ।
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই আইন সংস্কারের উদ্যোগটি নেওয়ার শুরু হয়েছিল 2020 সালে ৷ যখন কমিটি ফর রিফর্মস ইন ক্রিমিনাল ল'জ (সিআরসিএল) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং অধ্যাপক ডঃ রণবীর সিং এর সভাপতিত্ব করেছিলেন । ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (বিএনএস), ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়াম (বিএসএ) এবং ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা (বিএনএসএস) নামের এই তিনটি বিলে পুরানো আইনগুলিকে সংস্কার করে নতুন আইনি কাঠামোর সঙ্গে প্রতিস্থাপন করা হয় ৷ এই তিন নতুন ফৌজদারি আইনকে 21 শতকের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছে ৷
এই নতুন আইনগুলি ভারতীয় ফৌজদারি বিচারব্যবস্থাকে ঔপনিবেশিক ধ্যানধারণা থেকে মুক্ত করেছে । নতুন আইনগুলিতে শাস্তির পরিবর্তে ন্যায়বিচারের দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে ৷ এর জন্য নতুন আইনগুলির প্রশংসাও কুড়িয়েছে ৷ এই নয়া আইনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা হয়েছে ৷ যার ফলে 'দণ্ড' সংহিতা এখন 'ন্যায়' সংহিতায় পরিণত হয়েছে ।
আদালত ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি এই আইন সংস্কারের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি । 1860-এর দশকে নিয়মবিধি প্রণয়নের মাধ্যমে আদালত ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেছিল তারাই । বর্তমানে স্থায়ী কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে এই নতুন বিলগুলি সংশোধন করা হয়েছে এবং রাজ্যসভা ও লোকসভা, সংসদের উভয় কক্ষে বিলটি অনুমোদিত হয়েছে । রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু গত বছরের 25 ডিসেম্বর ওই বিলে স্বাক্ষর করেছেন ৷ তারপরেই সেটি আইনে পরিবর্তন হয়েছে ৷ এরপরেই গত 1 জুলাই থেকে তিনটি ফৌজদারি আইন দেশে কার্যকর হয়েছে ৷
আইনের সংস্কার এবং পরিবর্তনের প্রয়োজন তখনই পড়ে যখন সরকার উপলব্ধি করে বিদ্যমান আইনগুলি ঔপনিবেশিক যুগের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থাকে প্রতিফলিত করছে এবং যার লক্ষ্য ন্যায়বিচারের পরিবর্তে নিপীড়ন করা । বর্তমানে ওই পুরানো আইনের অনেক ধারা অপ্রাসঙ্গিক এবং অপ্রচলিত হয়ে পড়েছে, যার জন্য আইনগুলির সংস্কার করা প্রয়োজন ।
নতুন ফৌজদারি আইন ভারতীয় ন্যায় সংহিতা 2023 হল, 1860 সালের ভারতীয় দণ্ডবিধির সংস্কারকৃত রূপ ৷ সংশোধন, বাতিল এবং ধারাগুলি যুক্ত করার মাধ্যমে এই আইনের লক্ষ্য হল পদক্ষেপের উপর শাস্তি আরোপ করে অপরাধের প্রতি একটি সংক্ষিপ্ত দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়া, যা ভারতের সার্বভৌমত্ব, একতা ও অখণ্ডতার জন্য হুমকিস্বরূপ ।
উপরন্তু, এটি সন্ত্রাসবাদ ও সংগঠিত অপরাধের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে, গুরুতর ও ছোট অপরাধের মধ্যে পার্থক্য করে এবং গুরুতর অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তি আরোপ করে । অপরাধের শাস্তি হিসেবে 'কমিউনিটি সার্ভিস'-এর ধারণাটি এখন আইনের অধীনে বাস্তবায়িত হচ্ছে, যা ন্যায়বিচারের আরও ইন্নত পদ্ধতির উপর দৃষ্টি আরোপ করে । সাম্প্রতিক আইনে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ধারা 304 এর অধীনে একটি অপরাধ হিসাবে ছিনতাইকে যুক্ত করেছে ।
ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা 2023-এর লক্ষ্য আমাদের ফৌজদারি পদ্ধতিকে পরিমার্জিত করা । তদন্তের জন্য সময়সীমা নির্ধারণ করে এটি নিশ্চিত করতে চায় যে, ন্যায়বিচার আরও সহজলভ্য এবং জনগণের প্রয়োজনের প্রতি প্রতিক্রিয়াশীল । এই নতুন ফৌজদারি আইনের 176 ধারায় একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাবে, যা সাত বছর বা তার বেশি কারাদণ্ড হবে এমন অপরাধের ক্ষেত্রে তদন্ত বাধ্যতামূলক করে । এর মানে হল যে, নিযুক্ত বিশেষজ্ঞরা ময়দানে নেমে তদন্ত পরিচালনার সঙ্গে জড়িত থাকবেন ।
এর পাশাপাশি ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতার ধারা 173-তে ট্রায়াল, অনুসন্ধান এবং শুনানির ক্ষেত্রে ডিজিটাল পদ্ধতির অবলম্বন করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে ৷ এর মাধ্যমে ডিজিটাল যুগের গুরুত্বের উপর জোর দেওয়া হয়েছে । ডকুমেন্টেশন এবং প্রক্রিয়ার দিকে এই স্থানান্তর প্রযুক্তির অগ্রগতির দিক নির্দেশ করে এবং আইনি প্রক্রিয়াগুলিকে আরও সহজতর করতে সহায়তা করে ।
আইন সংস্কারের যুগান্তকারী ধারণা হল, জিরো এফআইআর বাস্তবায়ন । আইনের 173 ধারা অনুসারে, বিচারযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে ওই থানার এখতিয়ার থাকুক না থাকুক ব্যক্তিরা দেশের যে কোনো থানায় একটি এফআইআর দায়ের করতে পারে ৷ এতে বলা হয়েছে যে, ওই থানার দায়িত্ব 15 দিনের মধ্যে সেই এফআইআরকে যে নির্দিষ্ট এলাকায় অপরাধ সংঘটিত হয়েছে সেখানকার থানায় স্থানান্তর করা । অপরাধ এবং অপরাধমূলক ট্র্যাকিং সিস্টেমগুলি জনসাধারণের সুবিধার জন্য ব্যবহার করা হবে ।
1872 সালের ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্টের পরিবর্তে ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়াম আইনটি কার্যকর হয়েছে ৷ এর ফলে সাক্ষ্য আইনের কাঠামোর পরিবর্তন হয়েছে । আজকের পরিবেশে যেখানে প্রযুক্তি অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে, এই নতুন ফৌজদারি আইন ইলেকট্রনিক প্রমাণের উপর জোর দেওয়া হয়েছে, যেমন কোনো ডিভাইস বা সিস্টেমে থাকা বা প্রেরণ করা তথ্য, যা ডেটা সংরক্ষণ বা পুনরুদ্ধার করতে পারে ।
ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ামের ধারা 57 প্রাথমিক প্রমাণ হিসাবে ইলেকট্রনিক রেকর্ডের স্বীকৃতি দেয় । এছাড়াও আইনটিতে এমন বিধান রয়েছে যা এমনকী মৌখিক প্রমাণের ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক উপস্থাপনা সক্ষম করে । এই নতুন আইনে সশরীরে না এসেও সাক্ষীরা দূর থেকে সাক্ষী দিতে পারবে ৷ সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করা হয় যে ডিজিটাল রেকর্ডগুলি কাগজের নথিগুলির মতো একই তাৎপর্যপূর্ণ । দেশ যে ডিজিটাল রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ । আইনের ধারা 24, যৌথ বিচারের ধারণাকে প্রসারিত করে ।
ভারতের ফৌজদারি আইনগুলি এই পরিবর্তনগুলির সঙ্গে সম্পর্কিত অসুবিধা, পরিণতি এবং আপত্তিগুলিকে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে । ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতার অধীনে পুলিশ হেফাজতের সময়কাল বৃদ্ধি করা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । অপরাধের তীব্রতার উপর নির্ভর করে সীমা 15 দিন থেকে বাড়িয়ে 60 বা 90 দিনে করায় আইন প্রয়োগকারীর প্রয়োজনীয়তা এবং নাগরিক স্বাধীনতা রক্ষার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার বিষয়ে প্রশ্ন উঠছে ।
ভারতীয় ন্যায় সংহিতা বিস্তৃতভাবে সংজ্ঞায়িত অপরাধের একটি সিরিজ প্রবর্তন করে, বিশেষ করে যেগুলি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত । যদিও এই আইনে 'রাষ্ট্রদ্রোহ' শব্দটি বাদ দেওয়া উল্লেখযোগ্য, তার পরিবর্তে 'ভারতের সার্বভৌমত্ব, একতা এবং অখণ্ডতাকে বিপন্ন করার কাজ,' অস্পষ্ট শব্দ বজায় রাখে, সম্ভাবনাকে অপরাধীকরণের থেকে বেশি গুরুত্ব উদ্বেগ বাড়িয়েছে ৷
'সংগঠিত অপরাধ' এবং সন্ত্রাসী আইন' এর মতো অপরাধের বিস্তৃত পরিধি এখনও রয়ে গিয়েছে এবং যখন তাদের সংজ্ঞা স্পষ্ট ও সীমাবদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে, তখন সম্ভাব্য অপব্যবহার এবং ব্যক্তিদের উপর প্রভাব সম্পর্কে প্রশ্নগুলি রয়ে গিয়েছে । উচ্চ শূন্যপদ, মামলার চাপ ও ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের জন্য ব্যাপক পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং কর্মীদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ও বিবৃতিগুলির অডিয়ো-ভিডিয়ো রেকর্ডিংয়ের মতো বিষয়গুলিকে উদ্দেশ্যমূলক দক্ষতা উপলব্ধি করার জন্য কঠোরভাবে মোকাবিলা করতে হবে ।
দেশের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় বলেছেন, "নতুন আইনগুলি আমাদের সমাজের জন্য উপযোগী কারণ কোনও আইন আমাদের সমাজের দৈনন্দিন আচরণকে ফৌজদারি আইনের মতো প্রভাবিত করে না । ফৌজদারি আইন জাতির নৈতিক চাহিদাকে নির্দেশ করে এবং জনগণকে তাদের উপভোগ করা স্বাধীনতা থেকেও বঞ্চিত করতে পারে ।"
তিনি আরও বলেন, "আমাদের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার সমস্যাগুলির মধ্যে একটি হল যে আমরা গুরুতর এবং কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির সঙ্গে একইভাবে আচরণ করি, যা পরিবর্তন করতে হবে এবং এটি তিনটি নতুন ফৌজদারি আইনের অধীনে তা পরিবর্তিত হয়েছে । ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে যত দ্রুত সম্ভব ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ ও তদন্তকারী কর্মকর্তাদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে । ভারত অগ্রসর হচ্ছে এবং ভারতের নতুন আইনের প্রয়োজন ।"
সামাজিক-রাজনৈতিক কারণগুলির উপর নির্ভর করে এই নতুন আইনগুলি তৈরি করা হয়েছে । বিচারের ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্তদের অগ্রাধিকার দেওয়া, ডিজিটাল বিপ্লবের কারণে প্রযুক্তিগত বিধিগুলির প্রয়োজনীয়তা এবং বিকশিত সামাজিক মূল্যবোধ সবই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে এই আইনে ৷ এছাড়াও বিচার বিভাগীয় সক্রিয়তা যেমন অদক্ষতা এবং আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা তুলে ধরার পাশাপাশি বিচারকদের বিভিন্ন মতামতের মতো চাপ ছিল । যদিও তাঁরা উন্নতির সম্ভাবনাকে স্বীকার করেছে, তাঁরা বোঝার এবং বাস্তবায়নের গুরুত্বের উপরও জোর দিয়েছে । এটিও উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিভিন্ন আদালতে বহু বিচারাধীন মামলা জমে থাকাক কারণে ভারতে ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়াটি ধীর গতিতে হয়েছে । তাই সেই দিকগুলি বিচার করে আধুনিক আইনি ব্যবস্থার প্রয়োজন পড়েছে ।
নতুন ফৌজদারি আইনগুলি অনুসন্ধান এবং বাজেয়াপ্ত করার ক্ষেত্রে অডিয়ো-ভিডিয়ো রেকর্ডিং বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ৷ এর মাধ্যমে গভীরে থাকা মূল পরিকাঠামোগত বাধাগুলিকে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে বলে মনে করা হচ্ছে । আইনের সংস্কারsর পর সেটি বাসত্বায়নের জন্য একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন, যার মধ্যে রয়েছে পদ্ধতিগত পরিবর্তন এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন ।
এই উদ্বেগ সত্ত্বেও তিনটি আইনে সংগৃহীত উদ্যোগগুলি তার আইনি ও তদন্ত ব্যবস্থার সংস্কারের প্রতি ভারতের প্রতিশ্রুতির উপর জোর দেয় । প্রযুক্তি এবং ফরেন্সিক বিজ্ঞানের উপর গুরুত্ব আরোপ আধুনিক যুগে আইনি কাঠামোকে প্রতিফলিত করে । আইনগুলি বর্তমান চাহিদা এবং মূল্যবোধের সঙ্গে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থাকে এক সারিতে রেখে সমাজের প্রান্তিক ও দুর্বল শ্রেণির মানুষকে আরও সুরক্ষা দেওযার যে প্রতিশ্রুতি তা পূরণ করবে ।
(মতামত লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত)