হায়দরাবাদ, 2 জুলাই: কৃষ্ণ সাগরে আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে চিন ৷ সেই লক্ষ্যে ধীরে ধীরে পা বাড়াচ্ছে শি জিনপিংয়ের দেশ ৷ সম্প্রতি জর্জিয়ার কৃষ্ণ সাগরে আনাক্লিয়া গভীর-সমুদ্র বন্দর নির্মাণ ও পরিচালনার টেন্ডার পেয়েছে চিন-সিঙ্গাপুর ভিত্তিক দুটি কোম্পানি ৷ চলতি বছরের 29 মে জর্জিয়া সরকার এই খবরে সিলমোহর দিয়েছে ৷ দরপত্র বিজয়ী সংস্থার মধ্যে রয়েছে চিন কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড এবং সিঙ্গাপুর ভিত্তিক চিন হারবার ইনভেস্টমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড ৷
পরিকল্পনা অনুযায়ী, মিডল করিডোর তৈরির জন্য আনাক্লিয়া বন্দরের অবস্থানটি গুরুত্বপূর্ণ ৷ এই করিডোরের মাধ্যমে রাশিয়াকে বাইপাস করে চিন এবং ইউরোপের মধ্যে একটি বাণিজ্য রাস্তা তৈরি হবে । তাই এই বন্দর তৈরির ঘোষণার একাধিক ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে । প্রথম এবং সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এই বন্দর প্রকল্পটি চিনকে দক্ষিণ ককেশাসে তার স্পষ্টভাবে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করবে ৷ 1992 সালে ইউএসএসআর এর পতনের পর এই অঞ্চলের তিনটি দেশ (আর্মেনিয়া, আজারবাইজান এবং জর্জিয়া) স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে নিজেদের ঘোষণা করে ৷ তারপর থেকে এই অঞ্চলে কার প্রভাব থাকবে তার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে আমেরিকা ও ইইউ এবং রাশিয়ার মধ্যে ।
জর্জিয়া দক্ষিণ ককেশাসের একটি অপেক্ষাকৃত ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ দেশ ৷ কারণ এটি পূর্ব এবং পশ্চিমের আন্তঃরাস্তায় অবস্থিত ৷ এটি দক্ষিণ ককেশাসের একমাত্র দেশ, যার কৃষ্ণ সাগরে প্রবেশাধিকার রয়েছে ৷ বর্তমানে জর্জিয়া আজারবাইজান হয়ে তুরস্ক এবং ইউরোপে ক্যাস্পিয়ান সাগরের তেল ও গ্যাস পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটি সুবিধাজনক পথ । মিডল করিডোর সংযোগ প্রকল্পে জর্জিয়ার ভূমিকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।
ঐতিহাসিকভাবে জর্জিয়া এই অঞ্চলের এমন একটি দেশ, যা 1992 সালে তার স্বাধীনতার পর থেকে ন্যাটো এবং ইইউ নামক ইউরো-আটলান্টিক কাঠামোর সঙ্গে সম্পূর্ণ একীভূতকরণের একমাত্রিক বৈদেশিক নীতির শুরু থেকেই জোরদারভাবে অনুসরণ করে । কয়েক দশক ধরে প্রতিবেশী রাশিয়ার সঙ্গে জর্জিয়ার সম্পর্ক টানাপোড়েন রয়ে গিয়েছে । দুই দেশ 2008 সালের অগস্টে জর্জিয়ার বিচ্ছিন্ন অঞ্চল আবকাজিয়া এবং দক্ষিণ ওসেটিয়া নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হয় ।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে যে, জর্জিয়া অবস্থান থেকে সরে এসে রাশিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক উন্নত করতে চাইছে । জর্জিয়া দৃশ্যত ন্যাটো/ইইউ সদস্যপদগুলির সম্ভাবনা নিয়ে মোহভঙ্গ এবং দেশে ক্ষমতাসীন দল জর্জিয়া ড্রিম এখন তার রাশিয়া-বিরোধী অবস্থানকে দূরে সরিয়া রাখাকে বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করছে ।
রাশিয়ার সঙ্গে জর্জিয়া যে তার সম্পর্ক ভালো করতে চাইছে তার প্রথম আভাস পাওয়া গিয়েছিল যখন জর্জিয়া চিনের সঙ্গে তার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে 2023 সালের জুলাইয়ে কৌশলগত অংশীদারিত্বে উন্নীত করে । এর আগে 2017 সালে জর্জিয়া চিনের সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করেছিল । একই সঙ্গে জর্জিয়া এবং রাশিয়ার মধ্যে ধীরে ধীরে সম্পর্ক উন্নত হওয়ার যথেষ্ট প্রমাণ মিলেছে । যেমন- 2022 সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণ-স্কেলে বিশেষ সামরিক অপারেশন হওয়ার পর থেকে জর্জিয়া তার পশ্চিমা অংশীদারদের দ্বারা রুশ-বিরোধী বক্তব্য/নিষেধাজ্ঞায় যোগদান থেকে বিরত থাকে ৷ এছাড়া ইউক্রেনে রাশিয়ার কর্মকাণ্ডের জন্য মস্কোর প্রকাশ্যে সমালোচনা করেনি জর্জিয়া ।
সম্প্রতি এ বছরের জুন মাসে জর্জিয়ার ক্ষমতাসীন দল জনপ্রিয় প্রতিরোধ সত্ত্বেও একটি আইন নিয়ে অগ্রসর হয়েছিল, যা বিদেশি তহবিল প্রাপ্ত এনজিওগুলির উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ৷ এটি জর্জিয়ায় পশ্চিমা শক্তির প্রভাব সীমিত করার জন্য রাশিয়া কর্তৃক প্ররোচিত একটি আইন হিসাবে বিবেচিত হয় ।
দক্ষিণ ককেশাসে চিনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি এটি জানান দেয় যে, রাশিয়া-ইউক্রেন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের সঙ্গে বিবাদে স্পষ্টতই মধ্য এশিয়া এবং দক্ষিণ ককেশাসে চিনকে কিছু কৌশলগত স্থান দিতে ইচ্ছুক ৷ যে অঞ্চলগুলিকে রাশিয়া পোস্ট-সোভিয়েত স্থান এবং এর প্রাকৃতিক প্রভাবের এলাকা হিসাবে বিবেচনা করে । অথবা বিকল্পভাবে রাশিয়া ও চিন ঐতিহ্যগত পশ্চিমা প্রভাবকে কমাতে এই ভূ-কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে একসঙ্গে কাজ করতে সম্মত হয়েছে ।
এটি লক্ষণীয় যে, আনাক্লিয়া বন্দর থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে জর্জিয়ার একটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চল এবং একটি স্ব-ঘোষিত স্বাধীন দেশ আবখাজিয়ার কৃষ্ণ সাগর উপকূলে ওচামচায়ার বন্দরে একটি নৌ ঘাঁটি তৈরি করছে রাশিয়া ৷ ভারত এবং পশ্চিমে এর অংশীদাররা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ) চিনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভস (বিআরআই) প্রকল্পগুলি নিয়ে সত্যিকারভাবে উদ্বিগ্ন ৷ কারণ এই প্রকল্পগুলির ফলে ঋণের বোঝা বেড়েছে এবং ছোট অংশীদার দেশগুলির সার্বভৌমত্ব হ্রাস পেয়েছে ৷
আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়, এমন আশঙ্কা রয়েছে যে চিন শেষ পর্যন্ত এই কৌশলগতভাবে অবস্থিত বন্দর এবং বিমানবন্দরগুলির মধ্যে কয়েকটি সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারে । জি7-এর পার্টনারশিপ ফর গ্লোবাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট (পিজিআইআই) এবং ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডোরের মতো উদ্যোগগুলিকে চিনের বিআরআই-কে মোকাবিলা করার প্রচেষ্টা হিসাবে দেখা হয় ।
তবে পশ্চিম দেশগুলি চিনের হাতে আসা আনাক্লিয়া বন্দর প্রকল্প তৈরির পূর্বাভাস দিতে এবং প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে ৷ যদিও আমেরিকা এবং ইইউ জর্জিয়ায় যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে । আদর্শভাবে মধ্য করিডোর দ্বারা পরিবেশিত নিজস্ব স্বার্থে ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচিত ছিল এই বন্দরের উন্নয়নে নেতৃত্ব দেওয়া । এটি উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আমেরিকা প্রকল্পটির সঙ্গে যুক্ত ছিল যখন এটি মূলত 2012 সালে ঘোষণা হয়েছিল কিন্তু চালু করতে পারেনি ।
এই প্রেক্ষাপটে ভারতের অবস্থান কী?
দক্ষিণ ককেশাসের সঙ্গে ভারতের সংযোগ সুদূর অতীতে খুঁজে পাওয়া যায় । তবে বর্তমান সময়ে ভারত এই অঞ্চলে শুধুমাত্র আর্মেনিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেছে । 1992 সাল থেকে ভারত এবং এই দুই দেশের মধ্যে উচ্চস্তরের কোনো সফর হয়নি ৷ জর্জিয়া এবং আজারবাইজানের সঙ্গে রাজনৈতিক আদানপ্রদানের মাত্রা কম ছিল ভারতের । আজারবাইজান ভারতের চেয়ে পাকিস্তানকে অগ্রাধিকার দেয় । জর্জিয়ার ক্ষেত্রে অবশ্য ছবিটা আলাদা ৷ এটি প্রায় 15 বছর আগে ভারতে সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করতে শুরু করেছে ।
নীতি নির্ধারকদের মতে, ভারত জর্জিয়ার সঙ্গে তার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে গুরুতিব দেয়নি । এর ফলে আর্মেনিয়ার বাইরে এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি ভারত ৷ ইরান, মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ ককেশাসের মাধ্যমে মুম্বইকে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গের সঙ্গে এবং দক্ষিণ ককেশাসে উপলব্ধ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইউরোপের সঙ্গে সংযুক্ত আন্তর্জাতিক উত্তর দক্ষিণ পরিবহণ করিডোর-সহ সংযোগ প্রকল্পগুলিতে অংশীদারিত্বের প্রেক্ষাপটে এই অঞ্চলটি ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ।
তবে এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, দক্ষিণ ককেশাসে তার ঘনিষ্ঠ মিত্র আর্মেনিয়ায় রাশিয়ার প্রভাব হ্রাসের লক্ষণ দেখা দিয়েছে ৷ নাগোর্নো-কারাবাখ নিয়ে আজারবাইজানের সঙ্গে আর্মেনিয়ার বিরোধ হয় ৷ সে সময় রাশিয়া প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারায় আর্মেনিয়া স্পষ্টতই তার উপর হতাশ হয় । এরপরে আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসেন এবং আর্মেনিয়ার সিদ্ধান্তের কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন ।
ছোট করে বললে, চিনের সঙ্গে জর্জিয়ার কৌশলগত অংশীদারিত্ব, তার রাশিয়া-বিরোধী অবস্থানের থেকে সরে আসা, রাশিয়ার প্রতি আর্মেনিয়ার আস্থা হারানো এবং পশ্চিমের দেশগুলির দিকে ঝুঁকে যাওয়া দক্ষিণ ককেশাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ সংকেত, যা ভারতকে সতর্কতার সঙ্গে নজরদারি চালাতে হবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের কাজ করতে হবে ।