গত 7 নভেম্বর সাপ্তাহিক সাংবাদিক বৈঠকে উপস্থিত হয়েছিলেন বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল ৷ সেখানে তিনি অভিযোগ করেন, ক্যানাবেরায় বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কররের সাংবাদিক বৈঠক সম্প্রচার করায় অস্ট্রেলিয়া টুডে নামে অস্ট্রেলিয়ার একটি সংবাদমাধ্যমকে ব্লক করে দিয়েছে কানাডা ৷
রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ‘‘আমরা জানতে পেরেছি যে এই বিশেষ সংবাদমাধ্যমের সোশাল মিডিয়া হ্যান্ডেল ও পেজগুলি, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবাসী সংবাদমাধ্যম, সেই সংবাদমাধ্যমকে ব্লক করা হয়েছে এবং কানাডায় দর্শকদের জন্য এই সংবাদমাধ্যম আর উপলব্ধ নেই ৷ এই সংবাদমাধ্যম একটি পেনি ওং-এর সঙ্গে বিদেশমন্ত্রীর একটি প্রেস কনফারেন্স দেখানোর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরই এটা ঘটেছে ৷’’
তিনি এই ঘটনাকে ‘বাক স্বাধীনতার প্রতি কানাডার ভন্ডামি’ বলে অভিহিত করেছেন । কানাডায় এখনও পর্যন্ত এই ধরনের ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি ৷ এই ঘটনা ইঙ্গিত করে যে এর ফলে কানাডার মিথ্যা প্রকাশ হয়ে যাওয়ায়, সেই হতাশা থেকেই অটোয়া এই কাজ করতে বাধ্য হয় ।
এমনকি অস্ট্রেলিয়া টুডে-ও এই ব্লকের সিদ্ধান্তের কড়া জবাব দিয়েছে। তারা এক্স-এ একটি বিবৃতি জারি করেছে ৷ সেখানে তারা উল্লেখ করেছে, "ভারতীয় বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও অস্ট্রেলিয়ার বিদেশমন্ত্রী পেনি ওং-এর সাংবাদিক বৈঠকে আমাদের সাক্ষাৎকারের পর কানাডার সরকারের নির্দেশে সোশাল মিডিয়ায় সাম্প্রতিক বিধিনিষেধ ও নিষেধাজ্ঞা আমরা যারা মুক্তমনে সাংবাদিকতা করি, তাদের পক্ষে কাজ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে ৷"
তারা আরও মন্তব্য করেছে যে তারা 'যে গুরুত্বপূর্ণ খবর পরিবেশনের প্রয়োজন হবে, সেগুলি স্বচ্ছতার সঙ্গে ও নির্ভুলভাবে প্রকাশ করা হবে’ ৷ জাস্টিন ট্রুডো এবং তার সরকারের মুখে । 'ফাইভ-আইজ' আন্দোলনের সহ-সদস্য দেশের একটি সংবাদসংস্থা থেকে আসা এই অভিযোগ জাস্টিন ট্রুডো এবং তাঁর সরকারের মুখে থাপ্পড় মারার সামিল ৷
ভারতে খালিস্তানি চরমপন্থীদের লক্ষ্য করে কানাডিয়ান অভিযোগ এবং জয়শঙ্করের প্রতিক্রিয়া নিয়ে পেনি ওং-এর কথা তুলে ধরে অস্ট্রেলিয়া টুডে-র প্রতিবেদন প্রকাশ করে । যা অটোয়াকে বিরক্ত করেছিল, তা ছিল প্রতিক্রিয়া । জয়শঙ্কর তাঁর উত্তরে তিনটি দিক উল্লেখ করেছেন ৷ সেগুলি হল - প্রমাণ ছাড়া অভিযোগ, ভারতীয় কূটনীতিকদের নজরদারি এবং কানাডায় ভারত-বিরোধী উপাদানগুলির রাজনৈতিক অবস্থান । ভারত বারবার এই বিষয়টি তুলে ধরেছে ৷ তবে ট্রুডোর জন্য যা ক্ষতিকর ছিল, তা অস্ট্রেলিয়ায় উত্থাপিত হয়েছিল এবং পেনি ওং ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি ধরেই কথা বলেছিলেন ৷
ভারতীয় মুখপাত্ররা যেমন দাবি করছেন, বাকস্বাধীনতার নামে ভন্ডামি করছে কানাডা ৷ এটা শুধু তা নয়, বরং ট্রুডো সরকারের ক্রিয়াকলাপে স্পষ্টতই অপরাধবোধের চিহ্ন ছিল ৷ কানাডা মিত্র দেশের সংবাদমাধ্যমকে ব্লক করে দিয়েছে ৷ অথচ অটোয়ার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠছে, তা ইঙ্গিত করে যে জাস্টিন ট্রুডো সচেতন যে যা বলা হচ্ছে, তা এখনও পর্যন্ত সবই সত্যি ৷ তিনি প্রধান মিথ্যাবাদী৷ কারণ, তিনি তাঁর ক্ষমতা বাঁচাতে মরিয়া । কানাডা সঠিক হলে এই সংবাদমাধ্যমকে ব্লক করার দরকার ছিল না ৷ কারণ, ওই সংবাদমাধ্যম শুধুমাত্র একটি কথোপকথন রিপোর্ট করেছে । বিদেশ দফতরের একটি সাধারণ বক্তব্যই যথেষ্ট হতে পারত ।
ট্রুডোও যে বিষয়টি নিয়ে ভয় পাচ্ছেন, তা হল তাঁর নিজের লোকেরা তাঁকে আর বিশ্বাস করছেন না । তাঁরা বুঝতে শুরু করেছেন যে ভারতের বিরুদ্ধে পুরো খেলাটি কোনও প্রমাণ ছাড়াই অর্ধ-সত্যের উপর ভিত্তি করে ছিল ৷ অন্যথায় চার্জশিট দাখিল করা যেত ৷ এটা করা হয়েছে শুধু শরিক জগমিত সিংয়ের বিশ্বাস অটুট রেখে ক্ষমতা সুরক্ষিত রাখার জন্য ৷ তার উপর কানাডার মতো একটি দেশ, যারা আইনের শাসনের দাবি করে, তারা নিজেরাইই ভারতীয় কূটনীতিকদের উপর নজরদারি চালিয়ে ও ভয় দেখিয়ে ভিয়েনা কনভেনশন ভেঙেছে ৷ ভারত যদি একই কাজ করত, তাহলে তারা বিশ্বের কাছে চিৎকার করে সব জানাত ।
অস্ট্রেলিয়া টুডে-কে ব্লক করার বিষয়ে অটোয়ার নীরবতা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে ভারত যখন ভিয়েনা কনভেনশনগুলি মেনে চলে, তখন কানাডা সেগুলি ভঙ্গ করছে । বাস্তব পরিস্থিতি ট্রুডোকে বিপাকে ফেলতে একেবারে ঘরে পৌঁছে গিয়েছে । কয়েকদিন আগেই কানাডার বিরোধী দল কানাডার পার্লামেন্টে বিষয়টি তুলে ধরে ট্রুডোকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে ৷ এর কোনও শেষ নেই ৷
ভারত যখন ভিয়েনা কনভেনশনের উদ্ধৃতি দিয়ে কানাডার সব অতিরিক্ত কূটনীতিককে দেশ থেকে বের করে দেয়, তখন অটোয়া সরব হয়েছি ল৷ প্রাথমিকভাবে অটোয়া দ্বিধাবোধ করেছিল ৷ কিন্তু নয়াদিল্লি জানিয়েছিল যে তারা তাদের কূটনৈতিক অনাক্রম্যতা সরিয়ে ফেলবে ৷ তখন আর কোনও বিকল্প কানাডার কাছে ছিল না । কানাডা আপত্তি করার চেষ্টা করেছিল ৷ কিন্তু নয়াদিল্লি শুনতে অস্বীকার করেছিল এবং এমন কোনও দেশ ছিল না, যারা ভারতের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলতে পারে৷ বাধ্য হয়েই কানাডাকে সবটা মেনে নিতে হয় ৷
এবার তাদের মিথ্যা ও অবৈধ কাজগুলি প্রকাশ্যে এসেছে এবং তাদের চুপ করার জন্য এটা কিছুই করতে পারে না । তারা জানে যে এটা ভুল এবং এর জন্য সারা বিশ্ব থেকে সমালোচনার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ৷ একমাত্র অন্য দেশ যেখানে ভারতীয় কূটনীতিকরা একই ধরনের চাপের মুখোমুখি হয়, তা হল পাকিস্তান । পাকিস্তান ও কানাডা দুই দেশই জঙ্গি কার্যকলাপে সমর্থন করে ৷ তাই ভারতের উচিত এবার উভয় দেশকেই একই স্তরে রাখা ৷
এই বিষয়ে কানাডার কোনও কূটনীতিকের কোনও মন্তব্য পাওয়া যায়নি । তাদের বিদেশ দফতর, বিদেশমন্ত্রী বা এমনকি নয়াদিল্লিতে তাদের হাইকমিশনও কোনও টুইট করেনি । তাদের বেআইনি কর্মকাণ্ডের কথা বলা হয়েছে এবং তারা কিছুই করতে পারে না । এই ধরনের নীরবতা বধির করে দেয় ও জয়শঙ্কর যা বলেছিলেন, তা যে সঠিক ছিল সেটা প্রমাণ করে ।
টরন্টো পুলিশ ভারতীয় কনস্যুলেটকে ভারতীয় প্রবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করতে বাধ্য করেছে নিরাপত্তার অভাবের বিষয়টি সামনে রেখে ৷ এর থেকে বোঝা যাচ্ছে যে কানাডার জাতীয় রাজনীতিতে খালিস্তানপন্থী গোষ্ঠীর সদস্যদের আধিপত্য রয়েছে এবং কানাডিয়ান পুলিশ হয় তাদের ভয় পায় বা তাদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা নেই ৷ যে দেশ নিজেকে উন্নত বলে এবং আইনের শাসন মেনে চলে, এটা তাদের জন্য দুঃখজনক অবস্থা ।
এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের নাম জুড়ে দেওয়া থেকে সমস্ত ভুয়ো অভিযোগের পর ভারত সরাসরি নিশানা করেছে কানাডাকে ৷ এর থেকে বোঝা যাচ্ছে যে কানাডা কিছুটা সমর্থন আদায় করতে পারলেও সাম্প্রতিক কাজ তাদের জন্য ব্যুমেরাং হয়েছে এবং কানাডার সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত করছে । তারা ভারতের বিরুদ্ধে একই দোষ দিতে পারবে না বা নিজেদের মুখ বাঁচাতে কোনও কথা বলতে পারবে না ৷ কারণ, তাদের কথা আর কেউ বিশ্বাস করবে না ।
ট্রুডো সরকারের বিরুদ্ধে এই ভারতীয় চাপ এবং অভিযোগ এমন এক সময়ে এসেছে, যখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনঃনির্বাচনে ইতিমধ্যেই কানাডায় অনিশ্চয়তা বাড়ছে । কানাডার উপ-বিদেশমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড এবং জগমিত সিং-সহ প্রত্যেক সিনিয়র কানাডিয়ান সরকারের প্রতিনিধিরা বলছেন যে ট্রাম্পের আগমন কানাডার অর্থনীতির জন্য অন্ধকার দিনের ইঙ্গিত দেয় । তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া পরিচালনা করতে কানাডিয়ানদের মধ্যে ঐক্য চায় । ট্রুডো এবং ট্রাম্পের মধ্যে খারাপ সম্পর্কের নজির আগে থেকেই রয়েছে ৷
ভারতকে, তার পক্ষ থেকে প্রতিটি প্ল্যাটফর্মে কানাডিয়ান মিথ্যাচারের ব্যঙ্গ ও মুখোশ খুলে দেওয়ার কাজ চালিয়ে যেতে হবে । ভারত অটোয়াকে কোনও প্রমাণ ছাড়াই ভারতকে দোষারোপ করতে দিতে পারে না । এবার অস্ট্রেলিয়ার নেটওয়ার্ক ব্লক করে নিজের পায়ে কুড়ুল মেরেছে কানাডা । ভারতকে সেই পরিস্থিতি থেকে কানাডাকে বের হওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত নয় ।
(এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের৷ এখানে প্রকাশিত তথ্য ও মতামত ইটিভি ভারত-এর মতামতকে প্রতিফলিত করে না৷)