ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে বাংলাদেশের তরফে মুক্তিযুদ্ধের একাধিক ছবি প্রদর্শিত করা হয়েছে ৷ তার মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধিরও ছবি রয়েছে ৷ জাদুঘরের ওয়েবসাইটের হোমপেজে শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্ধৃতিও রয়েছে ৷ যেখানে লেখা, ‘মহৎ অর্জন সম্ভব মহৎ আত্মদানের বিনিময়ে’ ৷ মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্বের গল্প পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার লক্ষ্যে তৈরি হওয়া অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠান এই জাদুঘর । পড়ুয়া ও পর্যটকরা এই জাদুঘরে যেতে পারেন এবং সেখানে গিয়ে দেখতে পারেন যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সেনা কীভাবে বাংলাভাষীদের উপর অত্যাচার চালিয়েছিল, তা নিয়ে তৈরি চলচ্চিত্র ৷ তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে জোরদার করার জন্য ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ অবস্থানের বিষয়টিও এই চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে । এর মাধ্য়মে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ভারতের অপ্রতিরোধ্য সমর্থনের বিষয়টিকেও তুলে ধরা হয়েছে ৷
ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই জাদুঘরের সেলুলয়েড ডিসপ্লে থেকে ভারত ও স্বাধীনতা সংগ্রামে এই দেশের ভূমিকা সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা পেয়ে যাবে । পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মুজিবুর ও তাঁর কমরেডদের প্রতি ভারতের অটল সমর্থনের বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ওই সিনেমায় দেখানো হয়েছে ৷ এই বিষয়টি ভারত সম্পর্কে বাংলাদেশী জনগণের ধারণাকে শক্তিশালী করে চলেছে ।
একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে মূল কারণ ছিল যে দর্শকদের জন্য একটি সিনেমা দেখানো, যা মানুষের মনে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে তাজা করে রাখবে । ওই সংগ্রামের সময় মানুষ কীভাবে আত্মত্যাগ করেছে, তা স্মরণে রাখতেই এই প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয় ৷ যুদ্ধের সময় কী ঘটেছিল এবং লোকেরা কীভাবে পরাধীনতা ও নৃশংসতার মুখোমুখি হয়েছিল, তা পরবর্তী প্রজন্মকে দেখানোই এই প্রতিষ্ঠান তৈরির প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল ৷
এখন যেহেতু হাসিনা চলে গিয়েছেন, তাই তাঁর অনুগামীরা ভাবছেন যে কীভাবে এই ঘটনা ঘটল ৷ তবে তাঁরা নিজেরাই নিজেদের পতনের গল্প লিখেছেন এবং সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তা জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করেছেন । পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুপ্তচরবৃত্তি ও সমর্থনের মাধ্যমে বাংলাভাষী জনগণকে নৃশংসভাবে হত্যা করার অভিযোগ ওঠে 'রাজাকারদের' বিরুদ্ধে ৷ তাদের ধারণাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও শক্তিশালী করার উদ্দেশ্য ছিল বাংলা জাতীয়তাবাদকে বাঁচিয়ে রাখা । জাতীয়তাবাদী ব্যাখ্যায় 'রাজাকার' শব্দের অত্যধিক ব্যবহার করা হয়েছিল শুধুমাত্র দেশের কিছু বিরোধী সদস্যকে হেয় করার জন্য ৷ কিন্তু সাম্প্রতিক ছাত্র বিক্ষোভ থেকে তা শেখ হাসিনা সরকারের কাছে পালটা হিসেবে ফিরে এসেছে ৷ যে পড়ুয়ারা মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতার চলচ্চিত্র দেখে বড় হলেন, তাঁরা যখন বিক্ষোভে নামলেন, তখন তাঁদের উদ্দেশ্যে হাসিনা এই অপমানজনক শব্দ ‘রাজাকার’ ব্যবহার করলেন ৷ তাঁরা সারাজীবন এই ‘রাজাকার’ শব্দ থেকে সতর্ক থেকেছে ৷ তাই তাঁরা অপমানজনক এই শব্দটি হজম করতে পারেননি ।
শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর সাম্প্রতিক বিক্ষোভ এবং বাংলাদেশে নেতৃত্বের পরিবর্তনের ফলে মুজিবুরের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও তাঁর চলার পথে করা ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে যে স্মৃতিসৌধগুলি তৈরি করা হয়েছিল, তা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে । ওই দেশ গঠনে ভারতের অবদানের মধ্যে একটি মূল স্থায়ী সংযোগ ছিল হাসিনার দল (আওয়ামী লীগ), যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে অস্তিত্ব সংকটের সম্মুখীন হয়েছে । তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত প্রতীকগুলো ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে রয়েছে । চাকরির কোটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন থেকে যে যুব নেতৃত্ব উঠে এসেছে, তারা পুরনো বর্ণনাগুলিকে বাতিল করে দিয়েছে এবং প্রতিবাদীদের প্রতিষ্ঠাতার মূর্তিও ভেঙে ফেলতে দেখা গিয়েছে । শেখদের পরিবারের একটি অংশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী যুবকরা ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন ৷ শেখরা স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতীয় সমর্থনের জন্য একটি মাধ্যম ৷ কারণ, এই পরিবারের দলের উপর ভারত বিনিয়োগ করেছে ৷
আমরা মূলত দেখতে পাচ্ছি ইতিহাসকে নতুন করে লেখা হচ্ছে এবং নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে অতীতকে ঢেকে দিয়ে৷ এই বিশাল পরিবর্তন দেখে যাঁরা ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন, তাঁদের হৃদয়ে যন্ত্রণা হবেই ৷ ভারত উদ্ধারকর্তা হিসাবে নিজের অবস্থান নতুন করে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে বিশাল চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে ৷ কারণ, প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক হিংসায় উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ তুলে ভারতের টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতে সম্প্রচারিত হওয়ার পর কিছু নির্দিষ্ট মহল দেশটিকে একটি প্যারিয়া হিসাবে দেখছে ৷ যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে যাওয়ার পথ বন্ধ হওয়ার পর হাসিনা দেশে আশ্রয় নেওয়ার জেরে ভারতের বিদেশ নীতি পরিবর্তনের প্রয়োজন হতে পারে ৷ ভারত কি নতুন ব্যবস্থায় হাসিনাকে সমর্থন করে সঠিক কাজ করছে ? একটি নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারতকে এমন পদক্ষেপ করতে হবে, যা বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগের অবাধ পরিস্থিতি বজায় রাখতে সাহায্য় করে, উভয় দেশ কয়েক দশক ধরে যা করে আসছে ।
ঢাকার একটি ভিন্ন পথ নেওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে ৷ যা ভারতের জন্য উপযুক্ত নাও হতে পারে ৷ কারণ, সেক্ষেত্রে ওই দেশে চিনের প্রভাব বাড়তে পারে । 1971 সালের যুদ্ধের কথার পরিবর্তে প্রতিবাদের পর দেওয়ালে যা লেখা হয়েছে, তা নতুন প্রজন্ম বেশি মনে রাখবে । সাম্প্রতিক বিদ্রোহের ফলে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়েছে এবং নেতৃত্বের একটি নতুন পর্যায় তার পূর্বসূরীদের সুনামকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেছে । বিক্ষোভ ছিল মুক্তিবাহিনীর (বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের এই নামে ডাকা হয়) পরিবারগুলির (কোটার সুবিধাভোগী) বিরুদ্ধে, যারা তাদের আত্মত্যাগের জন্য সম্মানিত হয়েছেন এবং ভারত সমর্থিত জাতীয় বীর হিসাবে কাজ করেছেন ৷ পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধে ভারত মুক্তি বাহিনীকে সমর্থন দিয়েছিল । ভারতের অবস্থানকে অস্বীকার করা এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতীককে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করাই তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সংজ্ঞা । বন্ধু ও শত্রু, দেশপ্রেমিক ও শত্রুর বিশেষণ ছিল মুক্তি বাহিনী ও রাজাকার । হাসিনার 'রাজাকার'রা দেশ চালাচ্ছে এবং পুরো দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে ।
এটা আওয়ামী লীগের জন্য একটি ধাক্কা ছিল ৷ কারণ, তার অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে যায় এবং প্রতিবাদী যুবকদের জন্য অবমাননাকর ভাষা ব্যবহার করার ফলে তাদের কি দুর্দশা হতে পারে, সেই পরিণতি অনুমান করতে পারেনি । সরকার ও দল উভয়েই দেশের সব কিছুর ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তাদের আছে বলে আত্মতুষ্টির চরম মূল্য দিতে হয়েছে । শ্রীলঙ্কার পর বাংলাদেশ এশিয়ার দ্বিতীয় দেশ হয়ে উঠেছে, যেখানে ক্ষমতাসীন দলের পরিবারকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে । প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কথা হওয়ার পর বাংলাদেশের পরিস্থিতি কোন দিকে যায় ৷ কারণ, ইউনূস দেশের সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার আশ্বাস দিয়েছেন ৷