পাঁচ বছরের ব্যবধানের পর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আবার দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করতে চলেছেন ৷ এই দ্বিপাক্ষিক বৈঠক 2000 সালে শুরু হয়েছিল । এবার এই দ্বিপাক্ষিক শীর্ষ সম্মেলন আগামী 8-9 জুলাই অনুষ্ঠিত হতে পারে । 2023 সালের 24 ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করার পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিম বিশ্ব মস্কোকে ‘প্যারিয়া স্টেট’ হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করছে । আর সেই পরিস্থিতির মধ্যেই ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে এই বৈঠক হতে চলেছে ৷ ভারত অবশ্য রাশিয়ার সঙ্গে এর মধ্যে ব্যবসা চালিয়ে গিয়েছে ৷ জুলাই মাসে মোদির রাশিয়া সফরের সময় শুধু তেল আমদানি (যা ইউরোপে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই আরও বেশি হয়েছে)-সহ অর্থনৈতিক সমস্যাই নয়, বরং কৌশলগত বিষয়গুলি নিয়েও আলোচনা হবে, যা বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে ।
শক্তি কমলেও গত মাসেই তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি ৷ তার পর তাঁর উচিত ছিল কাজাখাস্তানের আস্তানায় সাংহাই কো-অপারেশন সামিট (এসসিও)-এ অংশ নেওয়া ৷ কিন্তু চিনের সঙ্গে কিছু সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তিনি সেই দেশের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর মুখোমুখি হতে চাইছেন না ৷ ভারত চিনা নাগরিকদের ভিসা দিচ্ছে না ৷ কিন্তু তার মানে এই নয় যে তারা ওই দেশের সঙ্গে ব্যবসা করছে না । দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় 118 বিলিয়ন ডলার ৷ তবে দুই দেশ গালওয়ান এবং নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর অন্যান্য ফ্ল্যাশ পয়েন্টের চারপাশে মুখোমুখি হয়ে রয়েছে ৷ প্রকৃতপক্ষে 2020 সালের জুনে গালওয়ানে যখন আমাদের প্রায় 20 জন জওয়ান শহিদ হন, তার পর থেকে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমিত হয়নি ৷ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন চিনের শি জিনপিংয়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ককে কাজে লাগিয়েছেন, যাতে তাঁর দুই প্রধান মিত্র দেশের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যায় । প্রেসিডেন্ট পুতিনের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ভারত ও চিনের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়নি । বরং অন্যদিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইছে যে ভারত চিনের বিরুদ্ধে সামরিক আগ্রাসন বজায় রাখুক ৷ তাহলে চিনও তাইওয়ানের বিরুদ্ধে কোনও দুঃসাহসিক পদক্ষেপ করার আগে ভাবনাচিন্তা করবে ৷ এটা চিনকে যুক্তি দেখাতেও ভালো কাজ করে ।
যদিও চিন একটি প্রধান ইস্যু যা প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া সফরের রূপরেখা নির্ধারণ করবে, সেখানে অন্যান্য বিতর্কিত বিষয় রয়েছে, যা দু’টি দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ । তার মধ্যে একটি হল, রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব ৷ একটি সাধারণ বিশ্বাস ছিল যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ভারতকে ওই দেশ থেকে তেল কিনতে বাধা দেবে । ইউক্রেন আক্রমণের আগে, ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে খুব বেশি তেল কেনেনি ৷ কারণ, এটা ভারতের শোধনাগারগুলির জন্য অনুপযুক্ত বলে বিবেচিত হয়েছিল ৷ তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাশিয়া ভারতের শীর্ষ তেল সরবরাহকারী হয়ে উঠেছে । ভারতে আমদানি করা অপরিশোধিত তেলের 40 শতাংশ রাশিয়া থেকে আসত । প্রকৃত অর্থে প্রতিদিন 1.96 মিলিয়ন ব্যারেল তেল কিনেছে ভারত ৷ আমরা সৌদি আরব থেকে যা কিনি, এটা তার চেয়ে অনেক বেশি । ভারতের পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী হরদীপ সিং পুরি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিলেন যে ভারতকে কখনোই রাশিয়ার তেল কেনা ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়নি । তিনি সঠিক হতে পারেন, কারণ পশ্চিম বিশ্বের কাছে রাশিয়ান তেল নেওয়া ছাড়া উপায় নেই ৷ যা ঘটেছিল, তা হল সেই পরিশ্রুত রাশিয়ান অশোধিত তেলের সিংহভাগ ইউরোপীয় দেশগুলিতে এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিল । যদি ভারতীয় রুট দিয়ে রাশিয়ান অপরিশোধিত পণ্য পাওয়া না যেত, তাহলে জ্বালানির দাম বৃদ্ধির সঙ্গে একটি বিপর্যয় ঘটত এবং বিশ্ব অর্থনীতিকে স্থবির করে দিত । এই কৌশল অবলম্বন করে, বিশ্ব অর্থনীতি ভালো করেছে । ভারতও ভালো করেছে ।
যেহেতু রাশিয়ান তেলের সিংহভাগ ভারতীয় টাকায় কেনা হয়েছিল, ফলে মস্কো ভারতীয় টাকার স্তূপে বসে আছে ৷ যা তাদের খরচ করতে হবে । এটা প্রধানমন্ত্রী মোদি ও প্রেসিডেন্ট পুতিনের মধ্যে একটি প্রধান আলোচনার বিষয়বস্তু হবে । অতীতে, রাশিয়ান কোম্পানি রোসনেফ্ট ভারতীয় টাকায় ভারতের এসসার শোধনাগার কিনেছিল । এইভাবে, বন্দে ভারত ট্রেনের উৎপাদন-সহ আরও প্রকল্প আগামী মাসে রাশিয়ায় যাবে ।
আন্তর্জাতিক নর্থ সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডোর (আইএনএসটিসি) নির্মাণে রাশিয়া যথেষ্ট বিনিয়োগ করেছে । এই করিডোরটি সুয়েজ খালের মধ্য দিয়ে পণ্য পরিবহণের চেয়ে অনেক ছোট পথ । ইরানের মধ্য দিয়ে যাওয়া ট্রায়ালে দেখা গিয়েছে যে মাল্টি-মডেল পরিবহণ করিডোর ভালো কাজ করছে । সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে ইরানের আব্বাস বন্দর ও তারপর ভারতের গুজরাতের মুন্দ্রা পর্যন্ত একটি ত্রুটিমুক্ত যাত্রার জন্য কিছু শূন্যস্থান পূরণ করতে হবে । প্রথমবারের মতো কয়লা রাশিয়ার খনি থেকে ট্রেনে ভারতে পাঠানো হয় এই পথে ।
আরেকটি সংযোগ প্রকল্প যা আইএনএসটিসি-কে চ্যালেঞ্জ করছে, তা হল আইএমইইসি । আসলে এই প্রকল্পটি আবার ভারতকে নিজেদের সঙ্গে নেওয়ার ইউরোপের একটি প্রচেষ্টা । এই করিডোর মধ্যপ্রাচ্য, ইজরায়েল ও গ্রিস এবং এর পরেও যাওয়ার কথা । আবার এই করিডোরটি সুয়েজ খালের চেয়ে কম সময় নেবে এবং লোহিত সাগরের কিছু জলের সমস্যাকেও পাশ কাটিয়ে দেবে, যেখানে জাহাজগুলি হুথিদের দ্বারা পীড়িত হচ্ছে, যারা ইজরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করার চেষ্টা করছে৷ উভয় ক্ষেত্রেই ভারত খুশি ।
যাইহোক, রাশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দু’টি যুদ্ধ ভারতের বিদেশনীতির জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে । প্রধানমন্ত্রী মোদি সম্ভবত ইউক্রেনীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ভারতীয়দের বিষয়টি তুলে ধরবেন । এটি একটি সংবেদনশীল ইস্যু এবং ভারত সরকার এটি বহুবার উত্থাপন করেছে ৷ কিন্তু মস্কোর যেভাবে লোকবল কমছে, তাই তারা এঁদের ছাড়তে চায় কি না, সেই বিষয়টি স্পষ্ট নয় ৷ রাশিয়ার মতো বন্ধুত্বপূর্ণ দেশের জন্য লড়াই করা ভারতীয়দের সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী কিভাবে ভারতের উদ্বেগ প্রকাশ করেন, তা জানা আকর্ষণীয় হবে । রাশিয়ান সূত্র অনুসারে, চাকরির চাহিদা রয়েছে । ভারত ও অনেকেই সেনাবাহিনীতে যোগদানের বিরোধিতা করে না ৷ কারণ যে বেতন দেওয়া হয়, তা অনেকটা বেশি ৷ আর যাঁরা সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন, তাদের জন্য থাকার অফারও রয়েছে ।
সব হিসাব করে, এটা প্রধানমন্ত্রী মোদির জন্য একটি খুব আকর্ষণীয় সফর হবে, যা বিতর্কিত ডি-ডলারাইজেশন (ডলারের ব্যবহার কমানো)-সহ অনেক বাধ্যতামূলক বিষয়ের উপর সিদ্ধান্ত নেবে ৷ যা 2024 সালের অক্টোবরে সম্প্রসারিত ব্রিকস দেশগুলির সদস্যদের বৈঠকের সময় উপাদান সংগ্রহ করার সম্ভাবনা রয়েছে ৷ ভারতের প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত এই শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেবেন । ভারত ডি-ডলারাইজেশন কার্যকর করতে অনিচ্ছুক ছিল ৷ কিন্তু এর জন্য রাশিয়া ও চিন দ্বারা মার্কিন স্পনসর করা নিষেধাজ্ঞাগুলি পাশ কাটানোর জন্য আক্রমণাত্মকভাবে চাপ দেওয়া হয়েছে ।