নয়াদিল্লি, 7 জুন: তবে কি বরফ গলছে ভারত-মালদ্বীপ কূটনৈতিক সম্পর্কে ? তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুইজ্জুকে আমন্ত্রণ জানানো হতে পারে বলে খবর উড়ছে দিল্লির বাতাসে ৷ যদি এটা হয়, তাহলে দু দেশের সম্পর্কের বরফ আগামী দিনে গলতে চলেছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল ৷
লোকসভা নির্বাচনে জয়ের ফলে তৃতীয়বারের জন্য সরকার গঠন করতে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৷ ফের দিল্লির মসনদে বসবেন তিনি ৷ গত 4 জুন নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর বিভিন্ন দেশের প্রধানদের শুভেচ্ছা বার্তায় ভরে গিয়েছে মোদির এক্স হ্যান্ডেল ৷ সেই বার্তাগুলির মধ্যে রয়েছে মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুইজ্জুর একটি পোস্ট ৷ তিনি লেখেন, "2024 সালের ভারতীয় সাধারণ নির্বাচনে টানা তৃতীয় মেয়াদে সাফল্যের জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপি ও বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ-কে অভিনন্দন । দুই দেশের সমৃদ্ধি এবং স্থিতিশীলতা জন্য একসঙ্গে কাজ করার জন্য আমি উন্মুখ ৷"
মুইজ্জুর সেই শুভেচ্ছা বার্তার জবাব দেন নরেন্দ্র মোদি ৷ মুইজ্জুকে ধন্যবাদ জানিয়ে এক্স হ্যান্ডেলে তিনি লেখেন, "ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মলদ্বীপ আমাদের মূল্যবান অংশীদার এবং প্রতিবেশী । আমিও আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করার জন্য ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার প্রত্যাশা করছি ।"
যদিও নরেন্দ্র মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে মুইজ্জু আসবেন কি না, দিল্লির তরফে এখনও পর্যন্ত সেই বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু জানানো হয়নি ৷ তবে মুইজ্জু এলে এটা তাঁর প্রথম ভারত সফর হতে চলেছে ৷ সূত্রের খবর, বৃহস্পতিবার এই বিষয়ে পরিষ্কার ছবিটা পাওয়া যাবে ৷
মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রণিল বিক্রমসিঙ্ঘে, নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দহল, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তবগে এবং মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী প্রবীন্ত যুগনাউথদের আমন্ত্রণ জানানো হবে বলে সূত্রের খবর ৷ ইতিমধ্যে অনুষ্ঠানে আসার কথা জানিয়ে দিয়েছেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট ৷ অনুষ্ঠানে আসার কথা নিশ্চিত করেছেন নেপালের ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও ৷
তবে এই প্রথম নয় ৷ 2014 সালে নরেন্দ্র মোদি যখন প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করেন, সেবারও সার্কের সদস্যদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ৷ এমনকি, 2019 সালের নির্বাচনের পর তাঁর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয় বিমস্টেক-এর সদস্য দেশের প্রধানদের ৷ তবে মলদ্বীপের প্রেসিডেন্টের বিষয়টি আলাদা ৷
গতবছর নির্বাচনী প্রচারে চিনপন্থী নেতা হিসেবে পরিচিত মুইজ্জুর প্রধান দাবি ছিল, মলদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার ৷ 2023 সালের নভেম্বরে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর সরকারিভাবে ভারতকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার কথা বলেন তিনি ৷ আপাতদৃষ্টিতে এতদূর পর্যন্ত সব ঠিক ছিল ৷ গত বছর ডিসেম্বর মাসে দেশের সুরক্ষা এবং সংবেদনশীল তথ্য সুরক্ষার অজুহাত দেখিয়ে ভারতের সঙ্গে হাইড্রোগ্রাফি চুক্তি পুনর্নবীকরণে অসম্মতি দেখায় মলদ্বীপ ৷ উল্লেখ্য, 2019 সালের 8 জুন মোদির মলদ্বীপ সফরের সময় এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় দুই দেশের মধ্যে ৷ চুক্তির আওতায়, দ্বীপরাষ্ট্রের বিস্তীর্ণ সামুদ্রিক এলাকায় গবেষণা করার অনুমতি দেওয়া হয় ভারতকে ৷
এখানেই হয়তো বিষয়টি ঠান্ডা হয়ে যেতে পারত ৷ কিন্তু এই আবহে দেশের সামুদ্রিক অঞ্চলে চিনের জাহাজকে প্রবেশের অনুমতি দেয় মলদ্বীপ ৷ ফলে দু'দেশের সম্পর্কে ফাটল আরও বেড়ে যায় ৷
এরপর প্রধানমন্ত্রীর লাক্ষাদ্বীপ ভ্রমণ এবং সেদেশের পর্যটন শিল্পের উন্নতিতে পরোক্ষ সহায়াতা করাকে কেন্দ্র করে আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পরিস্থিতি ৷ এরপর চলতি বছরের জানুয়ারিতে মলদ্বীপের তিন উপমন্ত্রীর ভারত বিরোধী মন্তব্যের জেরে আরও তিক্ত হয়ে ওঠে দু'দেশের সম্পর্ক ৷ তারপর সেনা প্রত্যাহারের জন্য নয়াদিল্লিকে সময়সীমা বেঁধে দেন প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু ৷ বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর মলদ্বীপের সিদ্ধান্তে রাজি হয় ভারত ৷ এককথায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দু'দেশের সম্পর্কের ফাটল ক্রমশ চওড়া হতে থাকে ৷
নয়াদিল্লির প্রতিবেশী নীতি অনুযায়ী, ভারত মহাসাগরে অবস্থানের কারণে কৌশলগতভাবে মলদ্বীপ ভারতের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ ৷ দীর্ঘদিন ধরে দু'দেশের মধ্যে জাতিগত, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে ৷ এই সম্পর্ক যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ । তবে 2008 সাল থেকে মলদ্বীপ সরকারের অস্থিতিশীলতা ভারত-মালদ্বীপ সম্পর্কে বিশেষ করে রাজনৈতিক ও কৌশলগত ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে । আর এই আবহে দেশের সুরক্ষার ক্ষেত্রে কোনওরকম ঝুঁকি নিতে নারাজ ভারত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না ৷
এই আবহে চলতি বছরের মার্চ মাসে ভারত বিদ্বেষী তাঁর গৃহীত বিদেশ নীতি থেকে হঠাৎ সরে আসেন মইজ্জু ৷ দু'দেশের সম্পর্ক প্রসঙ্গে তিনি জানান, দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দীর্ঘদিনের ৷ আর এই সম্পর্ক ভবিষ্যতেও একই রকম থাকবে বলে আশ্বাস দেন তিনি ৷
গত মে মাসে ভারত সফরে আসেন মলদ্বীপের বিদেশমন্ত্রী মুসা জামির ৷ বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে তাঁর বৈঠকের পর জামির জানান, ভারতের আগে মুইজ্জুর চিন সফর কোনও রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যে পড়ে না ৷ বেজিংয়ের সঙ্গে দ্বীপরাষ্ট্রের সামরিক চুক্তি নিয়ে জল্পনা সম্পর্কে তিনি জানান, দেশের মাটিতে বৈদেশিক সেনার উপস্থিতিতে মলদ্বীপ আগ্রহী নয় ৷ সুতরাং এই আবহে নরেন্দ্র মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে মুইজ্জুর উপস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই খুব গুরুত্বপূর্ণ ৷