হায়দরাবাদ, 22 মে: আমেরিকার রাষ্ট্রদূত হিসেবে ভারতে এক বছর সম্পূর্ণ করলেন এরিক গারসেতি ৷ ভারতের প্রতি, ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি তাঁর ভালোবাসার জন্য তিনি সুপরিচিত ৷ এদেশে এক বছর পূর্ণ হওয়া নিয়ে উচ্ছ্বসিত গারসেতি সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন ৷ একটি ভিডিয়ো পোস্ট করে তাতে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে গভীর সম্পর্কের কথা তুলে ধরেছেন তিনি ৷ আমেরিকার রাষ্ট্রদূত হয়ে ভারতে গত এক বছরে এরিক গারসেতির অভিজ্ঞতা কেমন ? এনাডু-ইটিভি ভারতের রিপোর্টার আইআর শ্রীনিবাস রাওকে একান্ত সাক্ষাৎকারে তা জানালেন এরিক ৷
ইটিভি ভারত: ভারতে আপনি এক বছর কাটিয়েছেন ৷ দীর্ঘদিন ধরে আপনি ভারতীয় সংস্কৃতি দেখছেন ৷ আপনি কতটা সন্তুষ্ট ?
এরিক গারসেতি: আমি খুবই সন্তুষ্ট ৷ দু'টি দেশের মধ্যে সম্পর্কের কারণে এই বছরটা ঐতিহাসিক ৷ আজীবন ভারতে আমার হৃদয়ে থাকবে ৷ আমরা একসঙ্গে কী কী অর্জন করেছি, তা বলা সম্ভব নয় ৷ তবে এর আগে কখনও আমেরিকা এবং ভারতের মধ্যে সম্পর্ক এতটা গভীর, এতটা ব্যাপক হয়নি ৷ গভীর সমুদ্র থেকে শুরু করে দূরবর্তী নক্ষত্র পর্যন্ত যতদূর সম্ভব আমরা একসঙ্গে কাজ করছি ৷
বিভিন্নভাবে তা আমরা দেখতে পেয়েছি ৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হোয়াইট হাউজে গিয়েছেন ৷ নয়াদিল্লিতে জি-20 সম্মেলনে আমাদের নেতারা অংশ নিয়েছেন ৷ জেট ইঞ্জিন তৈরিতে একটা পরিবর্তন হয়েছে ৷ 190 বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি অর্থের বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে ভারতের সঙ্গে ৷ আগের তুলনায় আরও বেশি ভারতীয় পড়ুয়ারা আমেরিকায় পড়তে যাচ্ছে ৷ আগামী বছরগুলিতে আমাদের অংশীদারি সম্পর্ক একটা নতুন উচ্চতায় পৌঁছবে ৷ আমেরিকার রাষ্ট্রদূত হিসেবে আমি উচ্ছ্বসিত ৷ আগামিদিনে আমরা একসঙ্গে আরও অনেক কিছু করতে পারি ৷ সেটা ভেবে আরও বেশি আনন্দ পাচ্ছি ৷
ইটিভি ভারত: বর্তমান ভারত-আমেরিকার সম্পর্ককে আপনি কীভাবে দেখছেন ? এই সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করে তুলতে আপনি কোন কোন বিষয়ে অগ্রাধিকার দেবেন ?
এরিক গারসেতি: বিশ্বে ভারত-আমেরিকা সম্পর্ক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ৷ বিশ্বে ভারত একটা নেতৃত্ব দেওয়ার মতো জায়গায় উঠে এসেছে ৷ সুনিশ্চিত উন্মুক্ত ও স্বাধীন ইন্দো-প্যাসিফিক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভারত গুরুত্বপূর্ণ সহকারী দেশ ৷ ভারতের এই উত্থানকে আমরা সমর্থন করি ৷ একাধিক ক্ষেত্রে ভারত ও আমেরিকার একসঙ্গে কাজ করছে ৷ তার মধ্যে দুই দেশের ক্রমবর্ধমান সমৃদ্ধি, আমাদের দেশবাসীর সুরক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিশ্বের উল্লেখযোগ্য সমস্যাগুলির সমাধান রয়েছে ৷
আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে যে, গত এক বছরে দু'দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব আরও গভীর হয়েছে ৷ অন্য সব বন্ধুর মতো আমরা যে সব ইস্যুতে একমত হই, তা নয় ৷ কিন্তু আমাদের দেশের মানুষের একটা আকাঙ্খা আছে, একটা ভাগ করে নেওয়া স্বপ্ন আছে ৷ তাই আমরা যতটা না বিভক্ত, তার থেকে অনেক বেশি বোঝাপড়া আছে আমাদের মধ্য়ে ৷ ভারত ও আমেরিকা যখন একসঙ্গে কাজ করে তখন আমাদের মধ্যে সম্পর্কের ব্যাপক বিস্তার ঘটে ৷ সেটা শুধু আমেরিকার সঙ্গে ভারতের যোগ নয়, সারা দুনিয়ায় তা ছড়িয়ে পড়ে ৷
ইটিভি ভারত: জলবায়ু পরিবর্তন, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নিরাপত্তা ও উন্মুক্ত বাণিজ্যের মতো চ্যালেঞ্জিং বিষয়গুলি নিয়ে ভারত ও আমেরিকা একে অপরের সঙ্গে কাজ করছে ৷ এই সহযোগিতার সম্পর্ককে আপনি কীভাবে দেখছেন ?
এরিক গারসেতি: ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে উন্মুক্ত ও স্বাধীন হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভারত গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী দেশ ৷ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল মুক্ত রাখা দরকার ৷ এই এলাকা আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠুক, যোগাযোগ আরও বৃদ্ধি পাক, নিরাপত্তার নিশ্চয়তার মতো বিষয়গুলি নিয়ে আমাদের দু'দেশের ভাবনাচিন্তা একইরকম ৷ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিয়ে কোয়াড গোষ্ঠীর জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার পাশাপাশি ভারত ও আমেরিকা একসঙ্গে কাজ করছে ৷
এই দু'দেশের মধ্যে অংশীদারিত্বের সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে আমরা একগুচ্ছ উদ্যোগ নিয়েছি ৷ আর সেই তালিকা যথেষ্ট চমকপ্রদ ৷ তার মধ্যে রয়েছে- উন্নত প্রযুক্তি এবং সেমিকনডাক্টরের সরবরাহকে শক্তিশালী করা, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগী হিসেবে কাজ করে তাকে আরও উন্নত করে তোলা ৷ এছাড়া মহাকাশ গবেষণায় আমাদের দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের সহযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে ৷ তাকে আরও গভীর করতে ভারতীয় মহাকাশচারীদের নাসায় প্রশিক্ষণের বন্দোবস্ত করা ৷ মহাজগতের দূরতম নক্ষত্রটির কাছে পৌঁছতে একসঙ্গে কৃত্রিম উপগ্রহের উৎক্ষেপণ ৷ এর পাশাপাশি দু'দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে গবেষণার ক্ষেত্রকে আরও বিস্তারিত করা ৷ কৃষি, শক্তি, স্বাস্থ্য এবং প্রযুক্তিতে আগামীদিনের সমাধান খোঁজার কাজ করছে এই দুই দেশ ৷
ইটিভি ভারত: ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রতিদিন নতুন করে চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে ৷ সমুদ্রে নিরাপত্তা এবং সন্ত্রাস দমন-সহ সুরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করতে ভারতের ভূমিকাকে আপনি কীভাবে দেখছেন ?
এরিক গারসেতি: জঙ্গি হামলায় আমেরিকা ও ভারত- দুই দেশেরই ক্ষতি হয়েছে ৷ তাই বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসকে রুখতে আমাদের স্বার্থটাও এক ৷ সীমান্ত ও জলভাগে নিরাপত্তা,মাদক-বিরোধী অভিযান, নাগরিক আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমেরিকা ভারতের সঙ্গে কাজ করছে ৷ নিয়মিত দু'দেশের মন্ত্রীদের নিয়ে আলোচনায় বসা হয় ৷ নিরাপত্তা, শক্তি এবং মহাকাশ গবেষণার মতো একগুচ্ছ বিষয়ে খুব কাছ থেকে নজরদারি রাখতে দু'দেশের মধ্যে কথোপকথনও হয় ৷ আইসিইটি, আইএনডিইউএস-এক্স-এর মতো ফোরাম এবং স্ট্র্যাটেজিক ট্রেড ডায়ালগ ভারত ও আমেরিকার প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি করেছে ৷
ইটিভি ভারত: বিশ্বের সরবরাহের ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকাকে কীভাবে দেখে আমেরিকা ? আগামী দিনে দু'দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতায় কী সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন আপনি ?
এরিক গারসেতি: বিগত বছরগুলিতে কোভিড প্য়ানডেমিক থেকে শুরু করে বিশ্বজুড়ে নতুন নতুন যুদ্ধ- এই সব ঘটনাগুলি খুব ভালোভাবে দেখিয়ে দিয়েছে কিছু সামগ্রী বিশ্বে একটি মাত্র দেশ সরবরাহ করলে কী ভঙ্গুর অবস্থা হতে পারে ৷ বিভিন্ন দেশ এই সরবরাহে অংশ নিলে তা থেকে প্রতিটি দেশ উপকৃত হতে পারে ৷ এর সঙ্গে অনেকগুলি উপায়ও বেরিয়ে আসতে পারে ৷ ভারত একটি সুবৃহৎ আঞ্চলিক বাজার হয়ে উঠুক ৷ পাশাপাশি বিশ্বের উৎপাদন কেন্দ্রও বটে ৷ একজন রাষ্ট্রদূত হিসেবে আমি ভারতকে এভাবেই দেখতে চাই ৷ আমেরিকা বেশ কিছু সামগ্রীর জন্য ভারতের দিকে তাকিয়ে থাকে- যেমন আমাদের দেশের 40 শতাংশ জেনেরিক ওষুধ এখানে তৈরি হয় ৷ এই সম্পর্কটা ভারতে তৈরি ইলেকট্রিক যান, সোলার সেল এবং আরও অনেক কিছুতে বিস্তার পাক ৷ আমার সেটা খুবই ভালো লাগবে ৷
গত বছর ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনে আমরা আমাদের 7টি ব্যবসা সংক্রান্ত বিবাদ মিটিয়ে নিয়েছি ৷ বিশ্বের মধ্য়ে ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সবচেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে ৷ আমেরিকা বিশ্বে উন্নত অর্থনৈতিক দেশ এবং তার উন্নয়ন দ্রুত হচ্ছে ৷ আমাদের দু'দেশের মধ্যে এত মিল আছে ৷ তবে আমাদের কোম্পানিগুলিও তা খেয়াল রাখে ৷
ইটিভি ভারত: আবিষ্কার এবং উদ্যোগের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে পরিশুদ্ধ শক্তি এবং স্বাস্থ্য পরিষেবায় ভারত ও মার্কিন সহযোগিতার ক্ষেত্র কতটা সম্ভাবনাময় বলে আপনি মনে করেন ?
EG: এরিক গারসেতি: প্রযুক্তির কথা উঠলে, আমাদের মধ্য়ে থাকা সহযোগিতার গুণাগুণ আরও অনেকটা বেড়ে যায়। নতুন প্রযুক্তির সন্ধান করে মানুষের জীাবন আরও সহজ করার কাজ করছে দুদেশের একাধিক সংস্থা। সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে ভারত অনেক বেশি ভাবিত। উৎপাদন 2030 সালের মধ্যে 500 গিগাওয়াটে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ভারতের। সে ব্যাপারে তাঁদের সাহায্য করা হচ্ছে। তাছাড়া ওষুধ উৎপাদনের ব্যাপারেও ভারতকে প্রযুক্তিগত সাহায্য করা হচ্ছে আমেরিকার বিভিন্ন সংস্থার তরফে। বলতে পারেন, দুটি দেশ একত্রে এক নতুন বিশ্ব তৈরির কাজে হাত দিয়েছে।
ইটিভি ভারত: আমেরিকার ভিসা পেতে অন্ধ্রপ্রদেশ এবং তেলেঙ্গানার বাসিন্দাদের প্রবল সমস্যা হচ্ছে। দূতাবাসে 54টি ঘর রয়েছে যেখান থেকে ভিসার কাজ হওয়া উচিত। কিন্তু একটি ঘর থেকেও কাজ হচ্ছে না। কেন ?
এরিক গারসেতি: ভারত এবং আমেরিকার সম্পর্ক বদলের সঙ্গে সঙ্গে ভিসার চাহিদা অনেকটাই বেড়েছে। তাড়াতাড়ি ভিসা দিতে আমরা গত দু'বছরে একাধিক নতুন ব্যবস্থাও শুরু করেছি। আর তার জেরে বি-ওয়ান এবং ঘুরতে যাওয়া সংক্রান্ত ভিসা ছাড়া অন্য ভিসা পেতে প্রায় কোনও সময়ই লাগে না। তবে একটা জিনিস অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। তা হল, এখন ভিসার চাহিদা বেড়েছে তাই আমাদের আরও অনেক বেশি কাজ করতে হবে সেই চাহিদা মেটাতে। আমরা তার জন্য নানা ধরনের পরিকল্পনা করছি। ভিসা দেওয়ার কাজে আরও গতি আসবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
ইটিভি ভারত: আমেরিকার সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভারতীয়দের আপনি কী বার্তা দিতে চান?
এরিক গারসেতি: আগেই বলেছি, ভারত এবং আমেরিকার সম্পর্কের নিরিখে গত একটা বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আর এই বছরে আমার কাছে সবচেয়ে তৃপ্তির বিষয় ছিল, এই দুই দেশের সম্পর্ক ক্রমশ গভীর হয়েছে। নির্ভরতা বেড়েছে। দুটো দেশই বুঝতে পেরেছে, শুধু শক্তি বা দুর্বলতার নিরিখে সম্পর্ক ব্যাখ্যা করা যায় না। দুটি দেশের মধ্যেই যে অপার সম্ভাবনা আছে তা মাথায় রেখেই আগামিদিনে পথ চলতে হবে।
আরও পড়ুন: