কলকাতা, 7 অগস্ট: অপশাসনের বিরুদ্ধে মুখ বন্ধ করতে শুরু হয়েছিল ভয় দেখানো ৷ তাতেও কাজ না হওয়ায় দাঁত-নখ বের করে দমন শুরু করেছিল রাষ্ট্রযন্ত্র ৷ আন্দোলনকারীদের 'দাবায়ে রাখা যায়নি' ৷ উলটে প্রাণ হাতে নিয়ে দেশ ছাড়া হতে হয়েছে দেড় দশকের শাসককে ৷ বাংলাদেশের এমন পালাবদল অবশ্য এমনি এমনি হয়নি ৷ অকালে ঝরে গিয়েছে শয়ে শয়ে প্রাণ ৷ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লেখনী ধার করে বলতে হয়, "মানুষ বড় সস্তা..." ৷ এত রক্ত, এত মৃত্যু আর এত হাহাকারের পরও শান্ত হয়নি বাংলাদেশ ৷ অশান্তির তীব্র গর্ভযন্ত্রণা এখনও কুঁড়ে কুঁড়ে হচ্ছে আপামর বাঙালি জাতিকে ৷
শান্তি ফেরানোর চেষ্টা শুরু হয়েছে ৷ সেনার হাতে থাকা দেশের ভার যাচ্ছে অন্তর্বতীকালীন সরকারের হাতে ৷ শান্তিতে নোবেলজয়ী মহম্মদ ইউনুসকেই মাথায় রেখে তৈরি হবে এই স্বল্পমেয়াদের সরকার ৷ বাংলাদেশ চিরকালই কবিতা-সংস্কৃতির দেশ ৷ জল পড়লে যেমন পাতা নড়ে ঠিক তেমনি বাংলাদেশে উথালপাথাল হলে তার তীব্র প্রভাব পড়ে শিল্প-সংস্কৃতির আঙিনায় ৷
ইটিভি ভারতের সঙ্গে কথা বলেছেন, সে দেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ফারহাদ মজহার ৷ নতুন দিনের নতুন আশায় বুক বাঁধা দেশের জনপ্রিয় সাহিত্যিক অবশ্য শেখ হাসিনার প্রতি সমব্যাথী নন ৷ তাঁর সহনাভূতির সবটাই আন্দোলনরত ছাত্রদের জন্য সযত্নে রক্ষিত ৷
বামপন্থায় আস্থা রেখে জীবনের 76টি বসন্ত অতিবাহিত করা ফারহাদ টেলিফোনিক কথাবার্তায় বলেন, "আজকের পরিস্থিতি আমাদের দেশ ও সমাজকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে ৷ উপমহাদেশও এই চ্যালেঞ্জের বাইরে নয় ৷ ছাত্রনেতারা কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছেন ৷ তাঁদের কথা আসলে দেশের মনের কথা !"
ইউনুসকে দেশের ভার দেওয়ার ছাত্রদের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে তিনি জানান, আগেও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদকে এমন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল ৷ তিনি রাজি হননি ৷ এবার যখন রাজি হয়েছেন তা অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ ৷
এখনও কেন রক্ত ঝরছে দেশে ? সাহিত্যিকের স্পষ্ট জবাব, "ছাত্ররা এক নতুন দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছে ৷ আমরাও সকলে চাই শান্তিতে ক্ষমতার হস্তান্তর হোক ৷ দেশ এক সুন্দর গণতান্ত্রিক ও বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার হস্তান্তর দেখল ৷ আর তাই সবাই চান যাতে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটা খুব ভালো ভাবে হতে পারে ৷ ক্ষমতায় আসা সরকার একটা নতুন সংবিধান তৈরি করুক ৷ এই স্বৈরতান্ত্রিক সংবিধানকে বর্জন করা হোক ৷ আর এই গোটা বিষয়টি হতে হবে অহিংসার মাধ্যমে ৷ "
সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে ৷ সংসদে বিবৃতি দেওয়ার সময় ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের বিষয়ে সরব হয়েছেন ৷ পরিকল্পনামাফিক এমন আক্রমণ হচ্ছে বলে মেনে নিয়েছেন ফারহাদ মজহার ৷ তাঁর কথায়, "নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে হিন্দুদের উপর আক্রমণ হচ্ছে ৷ আমার কাছে প্রমাণ নেই তবে শুনেছি এই ধরনের আক্রমণের ঘটনার সঙ্গে আওয়ামী লিগের নেতা-কর্মীরা জড়িত ৷ তবে মানুষ সচেতন ৷ তাছাড়া ভারতের সেনাবাহিনীও এখানে আছে ৷ আমার মনে হয় এই ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না ৷ আমাদের এখানে হিন্দু বা মুসলমানদের এলাকা বলে কিছু নেই ৷ আমরা সবাই একসঙ্গে থাকি ৷ সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের বিষয়টি নিয়ে এভাবে প্রচার হতে থাকায় আন্দোলনের অভিমুখ পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে ৷ এখানেই আমরা সবাই সতর্ক ৷ সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ সংক্রান্ত আলোচনা বর্হিবিশ্বে কেন হচ্ছে তা আমি বুঝতে পারছি না ৷"
হাসিনা দেশ ছাড়ার পর বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের বহু মূর্তি ভাঙা পড়েছে ৷ সোশাল মিডিয়ায় সে সমস্ত ভিডিয়ো ভাইরালও হয়েছে ৷ এ ব্যাপারে অবশ্য সব দোষ আন্দোলনরত ছাত্রদের উপরে দিতে চাইছেন না ফারহাদ ৷ তিনি মনে করেন, হাসিনা সরকারের পতন প্রয়োজন ছিল ৷ শাসককেও আঘাত দেওয়া জরুরি ছিল ৷ সেটাই হয়েছে ৷ তবে মূর্তি কেন ভাঙা হচ্ছে আর কারাই বা সেটা করছে তা নিয়ে চর্চা প্রয়োজন ৷ আগে আইন-কানুনের ভার ছিল পুলিশের ৷ এখন সেই ভার সেনার ৷ তাঁদেরই মূর্তি রক্ষা করা উচিত ছিল ৷ কিন্তু শ্রীলঙ্কার মতো যে অবস্থা বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে তা যে চরম যন্ত্রণার সেটাও মনে করেন এই বিশিষ্ট সাহিত্যিক ৷
পাশাপাশি শেখ হাসিনাকে কেন দেশে ছাড়তে দেওয়া হল এবং তাঁর দেশ ছাড়ার পর দেশে এমন অরাজক অবস্থা তৈরি হল কেন সেই প্রশ্নের জবাব সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ ওয়াকার-উজ-জামানের দেওয়া উচিত বলে মনে করেন ফারহাদ মজহর ৷
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনায় ভারতের ভূমিকা নিয়েও সন্দিহান সাহিত্যিক ৷ তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রীর সরকারি আবাসনে ভারতের সেনাবাহিনীর আধিকারিকরা ছিলেন ৷ তাঁরা আচমকা কোথায় চলে গেলেন ? গণভবনে সাধারণ মানুষ ঢুকে এমন অরাজকতা চালাল কী করে ? তাদের কেউ বাধা দিল না কেন ! বাংলাদেশকে বদনাম করতেই এমন কিছু করা হয়েছে কিনা তাও জানতে চান তিনি ৷ তাছাড়া এতে দিল্লির কোনও ভূমিকা আছে কিনা তুলেছেন সেই প্রশ্নও ৷
বাংলাদেশের এমন পরিস্থিতিতে কি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হবে ? সাহিত্যিকের জবাব, "আমার মনে হয় না এই ধরনের ঘটনার কোনও প্রভাব দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপরে পড়বে ৷ দিল্লিকে সম্পর্ক ভালো করার উদ্যোগ নিতে হবে ৷ বিএসএফ সীমান্তে কী করছে তারও প্রভাব পড়ছে ৷ পাশাপাশি আমি মনে করি ব্যবসা থেকে শুরু করে সংস্কৃতির মাধ্যমে এই সম্পর্ক আরও ভালো হতে পারে ৷" এপারের বাঙালিদের জন্য বিশেষ বার্তাও দিয়েছেন ফারহাদ মজহর ৷ তাঁর কথায়,"বাংলাদেশ শুধুই তসলিমা নাসরিনের ভূমি নয় ৷ আমি চাই বাংলা আর বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও ভালো হোক ৷ দুটি ভূ-খণ্ডের ভাষা এক হলেও বলার রীতি আলাদা ৷ আমাদের দু'পক্ষেরই উচিত একে অপরকে সম্মান করা ৷"