হায়দরাবাদ, 15 মার্চ: 'গিপ্পি', 14 বছর বয়সী এক মিশুকে মেয়ে যে তার মা এবং ভাইয়ের সঙ্গে সিমলায় থাকে। মেয়েটিকে বয়ঃসন্ধিজনিত কারণে শারীরিক এবং মানসিক দিক থেকে একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ছোটবেলায় মেয়েদের শরীরে এই যে স্বাভাবিক পরিবর্তনগুলি আসে এবং তার মোকাবিলা কীভাবে করতে হয়, কীভাবে অভিভাবককে বন্ধু হয়ে উঠতে হয়, সেই বিষয়ে সচেতন করতে তৈরি হয়েছিল এই সিনেমাটি । 2013 সাল থেকে 2024, 11 বছর পরে কী বদলেছে চিত্রটা? মনোবিদ সাহেলী গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ক্লিনিক্যাল অভিজ্ঞতার জায়গা থেকে জানালেন বহু বয়ঃসন্ধি ছেলে-মেয়ে আসেন, যাদের সমস্যার অনেককাংশেই কারণ হিসাবে উঠে আসে বাবা-মার সঙ্গে কমিউনিকেশন বা বোঝাপড়ার সমস্যা ।
সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের কমিউনিকেশন গ্যাপ কি সত্যিই চিন্তার বিষয়?
মনোবিদ সাহেলী: কমিউনিকেশন গ্যাপ যে কোনও বয়সেই হতে পারে । টিনএজ ডেভেলপমেন্টাল, মাইলস্টোন বা বিকাশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ৷ এই সময় শারীরিক, হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে সন্তানের আবেগের উপর প্রভাব পড়ে । মনোবিজ্ঞানীদের ভাষায় একে স্ট্রেস অ্যান্ড স্ট্রম বলে। ঝড়ের সঙ্গে তুলনার কারণ বয়ঃসন্ধিকালে হরমোনাল পরিবর্তনের জন্য খারাপ লাগা, অভিমান, রাগ, প্রেম অতিরিক্ত মাত্রায় আসে ৷ মনের মধ্যে অভিঘাত অনেক বেশি আসে ৷ বয়ঃসন্ধিকালে কমিউনেকশনের অভাব বা ব্যবধান আরও প্রগাঢ় হয় বা বাড়ে । বয়ঃসন্ধিকালে পেরেন্টিং -এর ক্ষেত্রে বাবা-মাকে বেশ কিছু বিষয়ে সচেতন থাকতে হয় । কারণ এই সময়টা ভীষণ সংবেদনশীল । এই সময়ে বাবা-মায়ের সন্তানের সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রে শব্দ চয়নের উপর বিশেষ জোর দেওয়া উচিত । আপনি আপনার সন্তানের সঙ্গে কীভাবে কথা বলছেন, কী ভাষায় কথা বলছেন সেটা ভীষণ গুরুত্ব বহন করে একজন সন্তানের বয়ঃসন্ধি কালে আবেগের স্বাস্থ্য ও মানসিক স্বাস্থ গঠনের ক্ষেত্রে ।
সন্তানকে নিয়মে বাঁধা প্রয়োজন না কি কড়া শাসনে?
মনোবিদ সাহেলী: অনেক সময় দেখা যায়, হয়তো সন্তান পড়াশোনা ছাড়া বেশি মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে । স্বাভাবিকভাবে সন্তানের কেরিয়ার নিয়ে চিন্তিত হবেন বাবা-মা । অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, বড়রা ফোনটা কেড়ে নিচ্ছে বা ভীষণভাবে বকাবকি করছেন । এর ফলে যেটা হল, অনেকক্ষেত্রে সন্তান কথা শুনল না, তার রাগ বা অ্যাগ্রেশন বেড়ে গেল । রেগে গেল বা অভিমান করে বসল । বাড়তে থাকে দূরত্ব । আপনারই অজান্তে আপনাকে না জানিয়ে সমানতালে অতিরিক্ত সময় ধরে সে ফোন ঘাঁটতে থাকে । বারণ করলে সে অ্যাগ্রেসিভ হয়, জিনিসপত্র ভাঙে । সাজেশন হিসাবে বলা যেতে পারে, সন্তানের সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করে একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়ার পরিকল্পনা করা যেতে পারে । প্রয়োজনে অভিভাবক সেই বিষয়ে সুপারভাইজারের রোলও নিতে পারেন।
মানে সুপারভাইজার হিসাবে বাবা-মা আলোচনার মধ্য দিয়ে দেখতে পারেন কোথায় আরও পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে । বয়ঃসন্ধিকালে সন্তানরা সক্রিয়ভাবে সবকিছুর সিদ্ধান্ত নেওয়ার তাগিদ অনুভব করে । অভিভাবক হিসাবে একটিমাত্র সমাধানের পথ না দেখিয়ে অনেকগুলি অপশন তার সামনে রেখে আলোচনার মধ্য দিয়ে সুবিধা-অসুবিধা বুঝিয়ে দেওয়াই অভিভাবকের দায়িত্ব। তার মানেই সঠিক অপশনটা যে সবসময় নেবে তা কিন্তু নয়। অন্তত, সমস্যায় পরলে ও আপনার কাছেই আবার ফিরে আসবে ।
একই বিষয়ে বার বার বলা কি সন্তানের কাছে বিরক্তির কারণ?
মনোবিদ সাহেলী: বাবা-মা একই কথা বারবার বলছেন । এটা কেন করছিস, এটা কেন করছিস না ইত্যাদি । এই ন্যাগিংয়ের কারণে সন্তানের মধ্যে বিরক্তির সৃষ্টি হয়। তখন অনেক সময় সন্তানের মনে হতে থাকে বাড়িতে বাবা-মা না থাকলে ভালো হয় । ক্লিনিক্যাল জায়গায় দেখেছি, অনেক সময় অভিভাবক হিসাবে তাঁরা যখন উদ্বিগ্ন হচ্ছেন তখনই একই প্রশ্ন সন্তানকে বারংবার করে ফেলছেন । অনেক সময় সন্তানের সঙ্গে অভিভাবকের কথোপকথনে একটি মাত্র বিষয় থাকে, যা হল পড়াশোনা । বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলুন । জানতে চান সন্তানের পছন্দ-অপছন্দ । এরপর অবশ্যই সেই আলোচনায় পড়াশোনা আসবে । খেয়াল রাখতে হবে আপনার এবং সন্তানের সঙ্গে আলোচনার বিষয় শুধুমাত্র যেন পড়াশনা না থাকে ।
2023 সালের ডিসেম্বরে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (NCRB)-র প্রকাশিত সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ভারতে 2022 সালেই 13 হাজার পড়ুয়া আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে । যার মধ্যে শুধু 1 হাজার 123 জন পড়ুয়া পরীক্ষায় ফেল বা ভালো ফল না করার জন্য চরম পথ বেছে নিয়েছিল বলে জানিয়েছে সমীক্ষা । যাদের প্রত্যেক বয়স ছিল 18 বছরের নিচে । তারমধ্যে মেয়েদের সংখ্যা 578 জন ও ছেলে পড়ুয়ার সংখ্যা 575 জন । সবমিলিয়ে 18 বছরের নিচে 10 হাজার 295 জন পড়ুয়া আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে । যার মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা 5হাজার 588 জন । ছেলেদের সংখ্যা 4 হাজার 616 জন । অর্থাৎ বয়ঃসন্ধি বাচ্চাদের বা 18 বছরের নীচে বাচ্চা বা পড়ুয়াদের আত্মহননের পথ বেছে নেওয়ার মতো ঘটনা বেশি ঘটছে ।
মনোবিদ সাহেলীর মত, “অনেকাংশে দেখা যায়, সন্তান যা চায় তাই তাকে সঙ্গে সঙ্গে দেওয়া হয় ৷ ক্লিনিক্যাল জায়গা থেকে দেখেছি, সন্তান চাইছে আর আমি দেব না, এই জাতীয় দ্বন্দ্বে অভিভাবক পড়ে যান । তার মানে চাওয়া-পাওয়ার মাঝে যে গ্যাপটা সেটা শেখানোই হল না ৷ জীবনে তো সেটা সবসময় হয় না ৷ বিভিন্ন কারণে জীবনে না পাওয়া আসতে পারে, হতাশা আসতে পারে।"
সন্তানদের সঙ্গে কোয়ালিটি টাইম কাটানো কতটা প্রয়োজন?
মনোবিদ সাহেলী: বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়, সন্তান অভিযোগ করে বাবা-মা ফোনে ব্যস্ত থাকেন ৷ অফিস থেকে ফিরে এসে কোয়ালিটি টাইম কাটান না ৷ ফলে বাবা-মাও অনেক সময় সন্তান ফোনে ডুবে দেখেও চুপ করে থাকেন । কিছু বলেন না ৷ আবার বহু ক্ষেত্রে বাচ্চার মন খারাপ, কথা বলছে না, ঠিক মতো খাচ্ছে না এই ধরনের আচরণ আমরা লক্ষ্য করছি না । এই জন্যই কোয়ালিটি টাইম কাটানোর পরিকল্পনা রাখতে হবে সন্তানের সঙ্গে । কোয়ালিটি কনভারসেশন করতে হবে ৷ এর মানে তুমি কী পড়াশোনা করলে এই কথা দিয়ে আমার কনভারসেশন শুরু হবে না ৷ তোমার কোন সিনেমা ভালো লাগছে বা তোর কোন গায়ককে ভালো লাগে, কী শুনতে ভালো লাগে, বন্ধুদের সঙ্গে কী করলে মজা হয় ইত্যাদি কথা বলা অর্থাৎ সন্তানের ভালোলাগার বিষয় নিয়ে আলোচনা ৷
সন্তানের জীবনে ঢোকা মানেই অধিকার ফলানো নয়...
মনোবিদের কথায়, সন্তানের জীবনে ঢুকতে গেলে তার পছন্দগুলো জানতে হবে ৷ তারপরে পড়াশোনা নিয়ে আলোচনা ৷ এই পরিবেশ তৈরি না করলে বাবা-মায়ের কাছে সন্তানরা নিজেদের গুটিয়ে রাখবে । আবার অতিরিক্ত স্পাই করা, লুকিয়ে ডায়েরি পড়া, এটাও ঠিক নয় ৷ তাকে নিজস্ব স্পেস দিতে হবে৷ মাঝে মধ্যে সন্তানকে প্রশ্ন করা, তার কোনও সমস্যা হচ্ছে কি না স্কুলে, কেউ কিছু বলছে কি না, কারোর ব্যবহার খারাপ লাগছে কি না, সেটা আত্মীয় হলেও, সন্তানকে খুলে জিজ্ঞাসা করা ৷ তেমন কিছু হলে সে যে আপনাকে জানাতে পারে, সেই ক্ষেত্রও তৈরি করা দরকার।
রং, উচ্চতা, জেন্ডার নিয়ে বুলি হচ্ছে কি না, এই বিষয়ে সন্তানের সঙ্গে খুলে কথা বলা দরকার । বাড়িতে সাপোর্টিং পরিবেশ তৈরি করা দরকার । আসলে সন্তান অনেকক্ষেত্রে প্রথমে বাবা-মাকে কিছু বলতে গেলে ভয় পায় । সে জানে না বাবা-মাকে বললে কীভাবে রিঅ্যাক্ট করবে ৷ ফলে বাবা-মা হিসাবে কতর্ব্য প্রশ্ন করা। আমি পাশে আছি এটা বলা ৷
আবার অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, সন্তানের মনখারাপ, অমনোযোগিতা, সমস্যা দেখলে সন্তানকেই দোষারোপ করা হয়। ‘তুমি চাইলেই মন ঠিক করে নিতে পারো’ বা ‘তুমি ইচ্ছা করে করছো’, ‘তোমার হাতেই সবকিছু’, ‘এত পয়সা খরচা করছি’, ‘স্পেশাল ক্লাসে ভরতি করালাম’, ‘এত কিছু করলাম’ এই ধরনের মন্তব্য ভীষণ ট্রিগারিং ৷ ক্রিটিকাল কমেন্ট পাশ করা । যদি মন খারাপ থাকে, দীর্ঘদিন ধরে উৎসাহ না পায়, কাজে উদ্যমতা না থাকে, ঘুম না হয়, ইত্যাদি লক্ষণ থাকলে বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে ৷
সন্তানের মূল্যায়ণ অ্যাকাডেমিক পারফর্ম্যান্সের ভিত্তিতে যেন না হয় ...
সাহেলী জানান, অবশ্যই একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগোব বেশ কয়েকটি পরিকল্পনা মাথায় রেখে। প্ল্যান এ-তে যদি কোনওভাবে অসুবিধা মনে হয় তাহলে আমি যেন অ্যাপ্রোচেবল থাকি বাবা-মায়ের কাছে পরবর্তী প্ল্যানিং নিয়ে । আবার সন্তান যখন বাইরে থাকে তাঁর পড়াশোনার খোঁজ আগে না নিয়ে সে কেমন আছে, তার কোনও রকম সমস্যা হচ্ছে কি না, তা জানা দরকার । ইমোশনাল হেলথ নিয়ে প্রশ্ন করা অবশ্যই দরকার । ওপেন এই ডিসকাশনটা থাকা জরুরী ।
সোশাল মিডিয়া যদি ভাল-মন্দের বিচার করে, কী করণীয় ?
মনোবিদ জানাচ্ছেন, “সোশাল মিডিয়া থাকবে সেখানে লাইক পেলে আনন্দ হতে পারে কিন্তু সজাগ থাকতে হবে তা যেন সন্তানের আনন্দের একমাত্র উৎস না হয় । খেয়াল রাখতে হবে, সন্তানের ভালোলাগার বিষয়গুলির উপরও খেয়াল রাখতে হবে। বাইরে বন্ধুদের সঙ্গে খেলার মাঠে সময় কাটানো বা কোনও হবি পারসিউ করা, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে কথা ইত্যাদির উপরে যথেষ্টভাবে জোর দিতে হবে । ”
বয়ঃসন্ধিতে সন্তানের আবেগের মূল্যায়ণ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক । কষ্ট হচ্ছে দেখলে, রাগ হচ্ছে বুঝলে, মনখারাপ দেখলে প্রাথমিক ভাবে ওর আবেগের মূল্যায়ণ করুন, অ্যাকনলেজ করুন । ওকে এইটুকু জানান, ও চাইলে আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারে । অর্থাৎ বাবা-মাকে মুখে বন্ধু না বলে তা কথায়-ব্যবহারে সন্তানকে বোঝাতে হবে । পাশে আছি এই বার্তাটা ভীষণভাবে স্বচ্ছতার সঙ্গে দেওয়া উচিত, বলেই মত সাহেলী গঙ্গোপাধ্যায়ের ।
সবশেষে তিনি বলেন, "আমরা জয় সেলিব্রেট করি । সেই আচরণেই সকলে অভ্যস্ত । কিন্তু যদি ফলাফল উলটোটা হয়, আশানুরূপ না হয়, তাহলে তা নিয়েও আলোচনা করা উচিত। খোলা মনে পরাজয়কে স্বীকার করে জীবনে ‘রিস্টার্ট’ কীভাবে দেওয়া যায়, তা শেখাতে একমাত্র অভিভাবকরাই পারেন।
আরও পড়ুন
1. বায়ু দূষণ থেকে ফুসফুস-হার্টকে নিরাপদ রাখতে ডায়েটে রাখুন এই খাবারগুলি
2. খালি পেটে পান করুন তুলসীর জল, উপকারিতা জানলে চমকে যাবেন
3. চোখ-ফুসফুস-ত্বক বাঁচিয়ে রঙের উৎসবে কীভাবে রঙিন হয়ে উঠবেন ?