কলকাতা, 8 জানুয়ারি: কিংবদন্তি নায়িকা সুপ্রিয়া চৌধুরীর আজ অর্থাৎ বুধবার 92তম জন্মদিন। বাংলা সিনেমায় তাঁর অবদান অফুরান হলেও তাঁর সেই মূল্যায়ণ হয়নি যতটা তাঁর প্রাপ্য ছিল, এমনটাই মনে করেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র গবেষক, অধ্যাপক তথা চলচ্চিত্র সমালোচক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। অভিনেত্রীর জন্মদিনে তাঁর কাছ থেকে ইটিভি ভারত জেনে নিল অনেক অজানা কথা। যে কথায় জড়িয়ে রয়েছেন চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক, অজয় কর থেকে মহানায়ক উত্তম কুমার, মহানায়িকা সুচিত্রা সেন।
সুপ্রিয়া চৌধুরীর অভিনয় সত্তার পাশাপাশি তাঁর নৃত্যশৈলীরও প্রমাণ পেয়েছে দর্শক 'আম্রপালি' ছবিতে। অধ্যাপক বলেন, "অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি অত্যন্ত সম্ভাবনাময়ী নৃত্যশিল্পী ছিলেন। বার্মায় একবার এক অনুষ্ঠানে সেখানকার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাঁকে পুরষ্কৃত করেন। কিন্তু বাঙালি পরিচালকরা তাঁর সেই নৃত্যশৈলী বাংলা সিনেমায় ব্যবহার করেননি কিংবা করতে পারেননি।"
তিনি আরও বলেন, "সেদিন 'যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে...' গানে যে ভাবে উনি আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন ওই অভিনয় সুপ্রিয়া ছাড়া কে করতে পারত? সেদিন সুপ্রিয়া চৌধুরী ছাড়া কোনও উপায় ছিল ঋত্বিক ঘটকের কাছে? দেশ বিভাগের পরে বাংলা সিনেমার হাতে সুপ্রিয়া চৌধুরী ছাড়া অন্য কোনও নারী ছিল না। সুপ্রিয়া চৌধুরী ছিলেন নিম্ন মধ্যবিত্তদের প্রতিনিধি।"
চলচ্চিত্র সমালোচক বলতে থাকেন, "মেঘে ঢাকা তারা সুপ্রিয়া ও চারুলতার মাধবীর সঙ্গে তুলনা করা হয় ৷ তাহলে মাধবী উচ্চবিত্ত সমাজের প্রতিনিধি এবং একটা নির্দিষ্ট জায়গায় সফল ৷ আর সুপ্রিয়া আমাদের মতো যাঁরা সব হারিয়ে কলোনী পাড়ায় থাকে, যাঁরা বাসে ঝুলে যাতায়াত করে তাঁদের সবার প্রিয়তমা নারী ৷ এমনকী, ঋত্বিক ঘটকের নির্দেশে বিশুদ্ধ ঘটি গীতা দে'কে সুপ্রিয়া দেবী বাঙাল ভাষা শিখিয়েছিলেন মাত্র দু' মাসে। তখন শেখা আর শেখানোর মানসিকতাও ছিল অন্যরকম।" |
কানন দেবী, সাধানা দেবী যে পরিমাণ সিনেমা জগতে প্রতারিত হয়েছেন সেখানে বার্মার উদ্বাস্তু সুপ্রিয়া দেবীর জন্য যে লালকার্পেট বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে তা নয় ৷ তিনি নিজেকে প্রমাণ করেছেন ৷ শুধু উত্তম কুমারের জন্য তিনি সফল হয়েছেন তা নয় ৷ উত্তম কুমারের আগেও সফল অভিনেত্রী ছিলেন সুপ্রিয়া ৷ সেই সময়ে সুপ্রিয়ার আশেপাশে প্রচুর নায়িকা ৷ তাঁদের মধ্যে থেকে লড়াই করে রোমান্টিক নায়িকা হিসাবে সুপ্রিয়া নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন ৷
পাশাপাশি তিনি বলেন, অভিনয়ের দিক থেকে সুপ্রিয়ার প্রতি বাঙালি সমালোচকরা একটু অবিচার করেছেন ৷ উত্তমকুমারের ছায়ায় রেখে তাঁকে আড়াল করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে ৷ সুপ্রিয়া আমাদের নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের একমাত্র প্রতিনিধি ৷ সুচিত্রা সেন সেই জায়গা ভরাট করতে পারেন না ৷ অপর্ণা সেনও পারেন না ৷
অধ্যাপক বলতে থাকেন, "যে রুক্ষতা, যে অপরিচ্ছন্নতা এবং যে বিরক্তচোখের ভাব সুপ্রিয়া দেবীর মধ্যে দেখেছি দেশ বিভাজনের পর ওঁকে ছাড়া অন্য কোনও নারীর বিকল্প ছিল না ৷ সুপ্রিয়াই নির্বিকল্প উদ্ধার ৷ হলিউড যেমন চিরদিন তার বিখ্যাত নায়িকা মে ওয়েস্টকে (Mae West) সন্দেহ করেছে এই আক্রমনাত্বক যৌনতা কেন? আসলে একজন নারীর অধিকার, তাঁর সীমাক্ষেত্র যখন সীমিত, গণ্ডিবদ্ধ তখন সুপ্রিয়া চেয়েছিলেন পা একটু বাড়িয়ে দিতে ৷ পুরুষের পৃথিবীতে হানা দিতে ৷ আততায়ীর মতো পুরুষশাসিত সমাজকে বোঝাতে আমি নই সামান্য নারী ৷ আর এখানেই সুপ্রিয়া সফল ৷ এটাই তাঁর সিনেমা জগতে অবদান ৷"