কলকাতা, 31 ডিসেম্বর: 'স্টার থিয়েটার'-এর নাম বদলে দিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । 'স্টার থিয়েটার' এখন থেকে 'বিনোদিনী থিয়েটার'। প্রশাসনের তরফে বলা হচ্ছে, 141 বছর পর যথার্থ সম্মান পেলেন বিনোদিনী দাসী ৷ তবে এবিষয়ে বাংলার নাট্যজগতের প্রতিক্রিয়া মিশ্র ৷ অনেকে এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন ৷ আবার কেউ এই সিদ্ধান্তকে কটাক্ষও করেছেন ৷ বিশিষ্ট্য নাট্য ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলেছে ইটিভি ভারত ৷
বিনোদিনী দাসী ছিলেন আদ্যোপান্ত থিয়েটার-প্রাণা এক নারী, যাঁর দেওয়া অর্থে তৈরি হয়েছিল বাংলার থিয়েটার মঞ্চ । আর তার বদলে তাঁর প্রিয় পুরুষ তাঁকে দিয়েছিল শুধুই বঞ্চনা আর নির্বাসন । এই বিনোদিনীই রামকৃষ্ণের কাছ থেকে চৈতন্য অর্জন করেন ৷ 1883 সালে উত্তর কলকাতার বিডন স্ট্রিটে গড়ে ওঠে 'স্টার থিয়েটার'।
জানা যায়, সেই সময় স্টার থিয়েটার তৈরির নেপথ্যে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন নাট্য ব্যক্তিত্ব গিরিশচন্দ্র ঘোষ এবং বিনোদিনী দাসী । এও জানা যায়, সেই সময় সেই রঙ্গিনী বিনোদিনী, চৈতন্যময়ী বিনোদিনী, পুরুষ-ভজা বিনোদিনী, একাকী নির্বাসিতা বিনোদিনীকেই বাংলার রঙ্গালয় তৈরির টাকা জোগাড় করতে অনুরোধ জানানো হয় । পাশাপাশি বলা হয়, তাঁর নামেই নাম রাখা হবে সেই রঙ্গালয়ের ।
শুধু সেই কারণে নয়, থিয়েটারের প্রতি দুর্বার ভালোবাসার টানে নিজের ভক্ত গুর্মুখ রায়ের কাছ থেকে 50 হাজার টাকা নিয়ে থিয়েটার নির্মাণে তা ব্যয় করেছিলেন বিনোদিনী । কিন্তু উদ্বোধনের একটু আগে সিদ্ধান্ত বদলে যায় । থিয়েটার হলটির নাম রাখা হয় 'স্টার থিয়েটার'। বিনোদিনী দেবী তাঁর আত্মজীবনী 'আমার কথা'তে লেখেন, "...থিয়েটার যখন প্রস্তত হয় তখন সকলে আমায় বলেন যে, এই যে থিয়েটার হাউস হইবে, ইহা তোমার নামের সঙ্গে যোগ থাকিবে ।...কিন্তু কার্যকালে উঁহারা সে কথা রাখেন নাই কেন-তাহা জানি না ।" সেই অপূর্ণতা এবার পূর্ণতা পেল । প্রায় 141 বছর পর ।
একে চমক হিসেবে কটাক্ষ করে চন্দন সেন বলেন, "আসলে বাম আমল থেকেই হেরিটেজ সব কিছুর নাম বদলে যাচ্ছে । পার্কস্ট্রিট হয়ে গিয়েছে মাদার টেরিজা সরণী । তাও ঐতিহ্যবাহী 'স্টার থিয়েটার' হলটির নাম বিনোদিনী দেবীর নামে হয়েছে এটা ভালো কথা । খুশি হয়েছি । তবে, মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী এই ঘোষণার আগে একটি শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন 'মহিলাদের সম্মানার্থে'। মহিলাদের যদি উনি সম্মানই করতে চান, তা হলে তিলোত্তমাকে সম্মান দিন উনি । এগুলোর থেকে অনেক বেশি জরুরি সেটা । তা হলে ভারত এবং আমাদের রাজ্য উপকৃত হবে । সেটা তো হচ্ছে না । শুধু কতগুলো চমক ঘটছে ।"
সোহিনী সেনগুপ্তের কথায়, "আমি খুব খুশি । ওঁর তো ইচ্ছা ছিল ওঁর নামে হোক থিয়েটার মঞ্চটি । কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় তা হয়নি । আজ এতগুলো বছর পরে হলেও হল । আমি সাধুবাদ দেব এই উদ্যোগকে ।"
পৌলমী বসু বললেন, "আমি তো খুব খুশি । বিনোদিনী দেবী হলেন 'দ্য ফার্স্ট লেডি অফ থিয়েটার'। ওঁর নামে থিয়েটার মঞ্চ । এর থেকে ভালো কিছু হয় না । আমিও একজন আদ্যোপান্ত মহিলা নাট্যকর্মী । তাই এটা আমারও প্রাপ্তি । আমি এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই ।"
সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, "স্টার থিয়েটারের নাম বিনোদিনীর নামে বদলে যাচ্ছে, এটাকে যাঁরা বিনোদিনীর জয় বলে মনে করছেন, তাঁদের অনুভূতিকে সম্মান জানিয়ে বলছি, বিনোদিনী কিন্তু চাননি কোনও 'সিনেমা হল'-এর নাম তাঁর নামে হোক । তাঁর সম্মান যাঁরা ফেরাতে চাইছেন তাঁরা দয়া করে থিয়েটারকে আগে সম্মান করে উত্তর কলকাতার ওই ঐতিহাসিক থিয়েটার প্রেক্ষাগৃহটিকে থিয়েটারের কাছে ফিরিয়ে দিন । তবেই বিনোদিনী নামকরণ সার্থক হবে । না হলে অর্থহীন ।"
সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথার রেশ টেনে দেবনাথ চট্টোপাধ্যায় বলেন, "বিনোদিনী দেবী স্টার থিয়েটারে কখনও অভিনয় করেননি । অনেক বঞ্চনার স্বীকার হন । অথচ থিয়েটার মঞ্চটি গড়ে তোলার নেপথ্যে ওঁর অবদান ছিল অনস্বীকার্য । একটা নাম হুট করে বদলে দিলেই তো হল না । তার ইতিহাস জানতে হবে । কেন নামটা 'স্টার থিয়েটার' তারও একটা ইতিহাস আছে । আর এখন তো ওখানে থিয়েটারের বদলে সিনেমা হয় । সপ্তাহান্তে একদিন হয় থিয়েটার । তাও বুকিং থাকলে । আমি চাই ওই থিয়েটার হলে থিয়েটার ফিরুক । তাতেই যথার্থ সম্মান পাবেন বিনোদিনী দেবী । কোনও সিনেমা হল তাঁর নামে হোক তিনি চাননি কখনও ।"
প্রসঙ্গত, আগামী বছর 23 জানুয়ারি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেতে চলেছে রামকমল মুখোপাধ্যায় পরিচালিত রুক্মিণী মৈত্র অভিনীত 'বিনোদিনী: একটি নটীর উপাখ্যান'। সেখানে বিনোদিনী দাসীর ভূমিকায় দেখা যাবে রুক্মিণীকে। স্টার থিয়েটারের নাম বিনোদিনী দাসীর নামে হওয়ায় তিনি আপ্লুত ৷ রুক্মিণী সোশাল মিডিয়ায় লিখেছেন, "এই সিদ্ধান্তের জন্য অনেক ধন্যবাদ দিদি । একজন নারীকে তাঁর যোগ্য সম্মানটুকু দেওয়া আর তাঁর 140 বছরের লড়াই আজ সার্থক বলে মনে হচ্ছে । আমার ধন্যবাদ জানানোর ভাষা নেই । এটা একেবারে একটা উদাহরণ যে, একটা মেয়েই অন্য আরেকটা মেয়েকে তুলে ধরতে পারে । আমরা, গোটা বিনোদিনীর টিম এই বদলের জন্য আপনার কাছে নত শির, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ । স্টার থিয়েটার এবার থেকে বিনোদিনী থিয়েটার হল ।"
তিনি আরও লেখেন, "আজ স্বপ্নপূরণের দিন । আজ দীর্ঘ শতাধিক বছরের বঞ্চনা থেকে অভিশাপ মুক্তির দিন । আজ নিজেকে ফিরে পাওয়ার দিন । আমরা যেমন স্বাধীনতার জন্য শতাধিক বছর ধরে লড়াই করেছিলাম, তেমনই বিনোদিনী দাসী নিজের প্রাপ্য সম্মানের জন্যে শতাধিক বছর ধরে লড়াই করে যাচ্ছেন । আজ প্রায় 140 বছর পর সেই স্বপ্ন পূরণের দিন । আজ থেকে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের আশীর্বাদধন্য নটী বিনোদিনীর স্বপ্নের স্টার থিয়েটার, 'বিনোদিনী থিয়েটার'। আর তা শুধুমাত্র হল আমাদের সবার প্রিয় মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর জন্য । প্রণাম দিদি ।" এর সঙ্গে তাঁর ছবি মুক্তির দিনক্ষণও জানান রুক্মিণী ।