নয়াদিল্লি , 7 জুন: জাতীয় রাজনীতিতে জোট এখন এক বাস্তবতার নাম ৷ গত দশ বছরে 'জোট রাজনীতি' বা 'জোট ধর্ম'-র মতো শব্দ বড় একটা শোনা যায়নি ৷ এবার বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠ না হওয়া জোট রাজনীতিকে এক নতুন মোড়ে এনে দাঁড় করিয়েছে ৷ কেন্দ্র-রাজ্য মিলিয়ে দু'দশকেরও বেশি সময় সরকার চালানো নরেন্দ্র মোদি যে কঠিন লড়াইয়ের মুখে পড়তে চলেছেন, তা নিয়ে সন্দেহ করার কারণ নেই ৷
ভারতীয় রাজনীতিতে জোটের অভিঘাত বহু পুরনো ৷ নয়ের দশকে জাতীয় রাজনীতিতে একটা মজার কথা চালু ছিল তামিলনাড়ুর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার নামে ৷ বলা হত, চেন্নাইয়ের বাড়িতে বসে তিনি রিমোট টেপেন আর দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকার পড়ে যায় ৷ কথাটা নেহাত ভুল নয় ৷ 1998 সালে তাঁর সিদ্ধান্তেই পড়ে যায় অটলবিহারী বাজপেয়ীর এনডিএ সরকার ৷
তামিল রাজনীতির আরেক অবিসংবাদী চরিত্র এম করুণানিধিকে গ্রেফতার করা এবং সুব্রহ্মণ্যম স্বামীকে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী করার দাবি জানিয়েছিলেন জয়ললিতা ৷ জোট ধর্ম পালনে সুচতুর বাজপেয়ী সেই দাবি মানতে চাননি ৷ তার ফলে সমর্থন তুলে নেন জয়লিলতা ৷ সংসদে আস্থা ভোট হয় ৷ বিপক্ষে মাত্র একটি ভোট বেশি পড়ায় বাজপেয়ী সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যায় 13 মাসেই ৷ জাতীয় রাজনীতিতে এমন ঘটনা নতুন বা প্রথম নয় ৷ গত দশ বছরে জোট রাজনীতির তেমন দাপট দেখা যায়নি বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতার আলোকে ৷
পরিস্থিতি যা তাতে একা ম্যাজিক ফিগার না পাওয়া বিজেপিকে সরকার গড়তে এবং চালিয়ে নিয়ে যেতে টিডিপি এবং জেডিইউ-র উপর নির্ভর করতেই হবে ৷ এই দু'টি দলের সঙ্গে বিজেপির সমীকরণ বারবার বদলেছে ৷ আলাদা আলাদা কারণে কখনও তারা কাছাকাছি এসেছে, কখনও একে অপরকে আক্রমণ করেছে ৷ নীতীশ কুমারের জেডিইউ কতবার এনডিএ-তে গিয়েছেন আর কতবার ছেড়েছেন সেটা কর গুণে বলতে পারা একটু মুশকিল ৷ গত আট বছরেই তিনবার বিহারে রাজনীতি এমন আসা যাওয়া দেখেছে ৷
সম্ভবনাময় শিল্প রাজনীতিতে টিকে থাকতে মোদি জোট ধর্ম কতটা ভালোভাবে পালন করতে পারবেন, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া মিলেছে ৷ রাজ্য বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি দিলীপ ঘোষ জানালেন, সবাইকে নিয়ে চলার মানসিকতা বিজেপির আছে ৷ অতীতে অটলবিহারী বাজপেয়ী অনেকগুলি দলকে নিয়ে সরকার চালিয়েছেন ৷ এবার আবারও সেটাই হবে ৷ আবার জোট রাজনীতি বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথে অন্তরায় বলে মত অনেকের ৷ মোদি সরকার গত দু'বার একাধিক বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে ৷ নোটবন্দি থেকে শুরু করে 370 ধারা বিলোপ হয়েছে অনায়াসে ৷ এবার এরকম বড় সিদ্ধান্ত নিতে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে জোট শরিকরা ৷ দিলীপের জবাব, মোদি সরকার দেশের উন্নয়নের জন্য যে যে পদক্ষেপ করবে, তা শরিকরাও মেনে নেবে ৷ কারণ ভালো কাজে কেউ বাধা দিতে চায় না ৷
অন্যদিকে, কংগ্রেসের প্রদীপ ভট্টাচার্য জানালেন, নরেন্দ্র মোদির চরিত্রের মধ্যে স্বৈরাচারী মনোভাব আছে ৷ কারও উপদেশ নিতে চান না ৷ যাঁরা তাঁর সঙ্গে কাজ করেন, তাঁদের উপরেও নিজের মতামত চাপিয়ে দেন, অন্যদের উপরেও চাপিয়ে দেন ৷ এরপরই ওড়িশার এতদিনের শাসক দল বিজু জনতা দলের উদাহরণ টানেন প্রদীপ ৷ তিনি জানান, রাজ্যসভায় বসে তিনি দেখেছেন প্রায় প্রতিটি বিলেই বিজেপিকে সমর্থন করত বিজেডি ৷ তাদের মনে হয়েছিল, এভাবে বিজেপিকে খুশি করতে পারলে ওড়িশায় তাদের সরকার পড়বে না ৷ তবে বিজেপি রাজনৈতিক কৌশল করে তাদের গিলে খাচ্ছে, তা তারা বুঝতে পারেনি ৷ এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ৷
বঙ্গ কংগ্রেসের এই প্রবীণ নেতা মনে করেন, সরকার টিকিয়ে রাখতে জোট শরিকদের উপর নির্ভর করা বা জোট ধর্ম পালনের রাস্তায় মোদি হাঁটবেন না ৷ বরং অন্য দল ভাঙিয়ে সরকার টিকিয়ে রাখতে চাইবেন ৷ তবে পরবর্তীতে রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই কাজ মোদি কতটা করে উঠতে পারবেন, তা নিয়ে প্রদীপের সংশয় আছে ৷ তাহলে কি কংগ্রেসেও ভাঙন ধরাবে বিজেপি ? প্রবীণ নেতার জবাব, কংগ্রেসকে ভাঙা মোদির পক্ষে আগের মতো সহজ হবে না ৷ নতুন রাজনৈতিক সমীকরণে তৃণমূলের ভূমিকা কী হবে, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে ৷ দুর্নীতির দায় থেকে নেতাদের বাঁচাতে তৃণমূল-বিজেপির সঙ্গে গোপন সখ্য রাখলেও তিনি অবাক হবেন না ৷ তবে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিজেপিকে যে বিভিন্ন তদন্ত সংস্থাকে কাজে লাগানোয় রাশ টানতে হবে, তাও জানিয়ে দিলেন কংগ্রেসের এই প্রবীণ নেতা ৷
2013 সালে মোদি বিজেপি তথা এনডিএ-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ার ফলে জোট ছেড়েছিলেন নীতীশ ৷ কিন্তু তারপর থেকে পটনার রাজনীতি বদল দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে ৷ মোদির সঙ্গে মঞ্চ ভাগ না করার কথা প্রকাশ্যে বলেছিলেন নীতীশ ৷ সেই তিনি-ই শুক্রবার সংবিধান সদনে এনডিএ-র সভায় বসলেন মোদির পাশে ৷ নীতীশের দলের নেতারা আগেই বলেছিলেন, এনডিএ ছাড়ার প্রশ্ন নেই ৷ এমন কথাও শোনা গিয়েছে বিরোধী ইন্ডিয়া শিবির নাকি তাঁকে উপ-প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল ৷ তিনি সেই প্রস্তাবে রাজি না হননি ৷ বদলে ভোটের আগে হওয়া বিজেপির সঙ্গে জোট ধর্ম অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন বলে ঠিক করেছেন ৷
টিডিপি-র সঙ্গে বিজেপির ইতিহাসও বেশ ঘটনাবহুল ৷ বিশেষ করে চন্দ্রবাবু নাইডু এবং নরেন্দ্র মোদির পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার শুরু আছে, শেষ নেই ৷ 2018 সালে এনডিএ ছাড়ার পর চন্দ্রবাবু একটি সভা থেকে নরেন্দ্র মোদিকে উগ্রবাদী বলেছিলেন ৷ আবার কটাক্ষের সুরে মোদি বলেছিলেন, চন্দ্রবাবু অনেক ব্যাপারেই তাঁর চেয়ে সিনিয়র ৷ এই ব্যাপারের তালিকা চন্দ্রবাবুর সমর্থকদের আর যাই করুক খুশি করবে না ৷ মোদি দাবি করেন, দল ভাঙাতে, দল পরিবর্তন করতে চন্দ্রবাবু তাঁর সিনিয়র এবং আজীবন সিনিয়রই থাকবেন ৷ সেই দুই নেতাও আজ পাশাপাশি বসলেন ৷ শুধু তাই নয়, মোদিকে এনডিএ-র নেতা বেছে নেওয়ার বৈঠকের ফাঁকেই জানা গিয়েছে টিডিপিকে চারটি মন্ত্রক দিতে রাজি বিজেপি ৷
প্রধানমন্ত্রীও সংসদে জোট শরিকদের সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করে দিলেন, দেশের রায় থেকে স্পষ্ট তারা আস্থা রেখেছে শুধুই এনডিএ-র উপর ৷ এখানেই প্রশ্ন ওঠে তাহলে রাজনীতিতে একত্রে থাকার শর্ত কী ? জাতীয় রাজনীতিতে একসময় একটি শব্দবন্ধের চল ছিল ৷ তা হল, কমন মিনিমাম প্রোগ্রাম । একটি জোটের সব শরিকরা কয়েকটি কাজকে সামনে রেখে সরকারে আসছে- এটা বোঝাতেই এই শব্দবন্ধের ব্যবহার হত। তবে কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে আটের দশকের শেষে চন্দ্রশেখর সরকার থেকে শুরু করে একাধিক সরকার কমন মিনিমাম প্রোগ্রাম নিয়ে তৈরি হলেও টেকেনি।
2004 সালে প্রথম ইউপিএ সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নেয় বামেরা ৷ চার বছর পর আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তির বিরোধিতা করে সমর্থন প্রত্যাহার করে বামেরা ৷ তবে সে সময় অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকই মনে করেছিলেন মনমোহন সিংয়ের সরকার থেকে সমর্থন তুলে নেওয়া আদতে সিপিএমের কেরল লাইনের প্রতিফলন ৷ যদিও প্রায় কাছকাছি সময়ে প্রকাশ্যে আসা 12টি আন্তর্জাতিক রিপোর্ট দাবি করেছিল, বামেদের সমর্থন নিয়ে চলা ইউপিএ সরকার অর্থনীতি থেকে শুরু করে সমাজ সংস্কারে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন সিপিএম সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাত মনে করেছিলেন, ইউপিএ সরকারে থেকে গেলে কেরলে রাজনৈতিক ক্ষতি হতে পারে। তাই তাঁর সিদ্ধান্তে দল সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। অতএব কমন মিনিমান প্রোগ্রামও যে সবসময় মুশকিল আসান হয়ে ওঠে তা নয়। বরং জোটে থাকা দলগুলির মতাদর্শে মিল থাকা অনেক বেশি জরুরি । রাজনৈতিক মতাদর্শ এক আছে বলেই গত প্রায় পাঁচ দশক ধরে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট টিকে আছে ৷ সরকার পড়ে যাওয়ার পরও বামেদের এই ফ্রন্ট অটুট রয়েছে। সেদিক থেকে বিজেপির অধুনা জোট শরিকরা যে নরেন্দ্র মোদির বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারেন তাতে সন্দেহ নেই। সংসদীয় রাজনীতিতে সংখ্যাবলের তত্ত্বকে প্রাধান্য দিয়ে বিরোধী দলকে প্রধান বিরোধী দলনেতা বা ডেপুটি স্পিকারের পদ না দেওয়া বিজেপি এই পাহাড়প্রমাণ চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে তা বলাই যায়।