ওয়াশিংটন, 14 ফেব্রুয়ারি: আমদানি শুল্ক নিয়ে যতই হম্বিতম্বি করুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট, পুরনো বন্ধু নরেন্দ্র মোদিকে দেখে ডোনাল্ড ট্রাম্প বললেন, "উই মিস ইউ" ৷ শুক্রবার দুই রাষ্ট্রনেতার এহেন বৈঠক ইতিবাচক হয়েছে বলেই জানা গিয়েছে ৷ 20 জানুয়ারি দ্বিতীয় বার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নিয়েছেন ট্রাম্প ৷ এরপর 14 ফেব্রুয়ারি ভারতীয় সময় রাত আড়াইটে নাগাদ ওয়াশিংটনে প্রথম তাঁর সঙ্গে বৈঠক হল প্রধানমন্ত্রী মোদির ৷
বৈঠকের আগে রেসিপ্রোকাল টারিফ বা আমদানি শুল্ক নিয়ে হাঁকডাক করেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৷ কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের তিনি জানান, আগামিদিনে ভারত আমেরিকা থেকে তেল-গ্যাস কিনবে ৷ ভারতের সঙ্গে ব্যবসা আরও বৃদ্ধি পাবে ৷ এমনকী এফ-35 যুদ্ধবিমানও ভারতে পাঠানোর কথা হয়েছে মোদির এই সফরে ৷ এছাড়া 2008 সালের 26 নভেম্বরে হওয়া মুম্বই হামলার অন্যতম মূল ষড়যন্ত্রী তাহাউর রানাকে ভারতে প্রত্যর্পণ করবে ট্রাম্প প্রশাসন ৷
President Trump often talks about MAGA.
— Narendra Modi (@narendramodi) February 14, 2025
In India, we are working towards a Viksit Bharat, which in American context translates into MIGA.
And together, the India-USA have a MEGA partnership for prosperity!@POTUS @realDonaldTrump pic.twitter.com/i7WzVrxKtv
সাধারণ ব্যবসা-বাণিজ্য হোক বা যুদ্ধ বিমান বিক্রি- প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর নীতি থেকে ভারতকেও রেয়াত করবেন না ৷ আমেরিকার স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার দুপুরে হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে প্রধামন্ত্রী মোদিকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ৷ দু'জনে বেশ কিছুটা সময় ধরে আলিঙ্গন করেন ৷ করমর্দনে একে অপরের হাত ধরে থাকেন খানিকক্ষণ ৷ প্রধানমন্ত্রী মোদিকে দেখে উচ্ছ্বসিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলে ওঠেন, "আমরা আপনাকে মিস করেছি ৷ খুব মিস করেছি ৷" এছাড়া তাঁকে 'মহান বন্ধু', 'দুর্দান্ত মানুষ' বলে উল্লেখ করেন বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশের প্রেসিডেন্ট ৷
আমেরিকার 47তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পরপরই ডোনাল্ড ট্রাম্প একের পর এক এগজিকিউটিভ অর্ডারে স্বাক্ষর করছেন ৷ ভারতের সঙ্গে আমেরিকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কেমন হবে, তা নিয়ে একটা অনিশ্চয়তার দোলাচল তৈরি হয়েছিল ৷ কিন্তু ভারতীয় সময় শুক্রবার রাতে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে যেভাবে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, তাতে নয়াদিল্লিতে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরেছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহলের একাংশ ৷
" i am thrilled to welcome the prime minister of india, my friend @NarendraModi, back to the @WhiteHouse.
— President Donald J. Trump (@POTUS) February 14, 2025
There is truly a special bond between the United States and India—the world's oldest democracy and the world's largest democracy." –President Donald J. Trump 🇺🇸🇮🇳 @PMOIndia pic.twitter.com/CfcRUMgLWs
এই সব ভালোর মধ্যে শুধু একটাই 'কিন্তু' রয়ে গিয়েছে ৷ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, কোনও দেশ আমেরিকার জিনিসপত্রের উপর যেভাবে কর আরোপ করবে, আমেরিকাও ঠিক সেইভাবে পাল্টা কর চাপিয়ে জবাব দেবে ৷
ভারতও এই রেসিপ্রোকাল টারিফের নিশানার বাইরে নয় ৷ 44 মিনিট ধরে বৈঠক করেন দুই রাষ্ট্রনেতা ৷ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এরপর বলেন, "ভারত আমাদের উপর যেভাবে কর চাপাবে, আমরাও সেইভাবে ভারতের উপর কর আরোপ করব ৷" দু'দেশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক চুক্তি হয়েছে বলে ঘোষণা করেন তিনি ৷ পাশাপাশি প্রেসিডেন্টের গলায় অভিযোগের সুর শোনা যায়, ভারত আমেরিকার কয়েকটি সামগ্রীর উপর যে আমদানি কর চাপিয়েছে, তা খুব 'খারাপ' এবং 'কঠিন' ৷
ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তিতে উচ্ছ্বসিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ৷ তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী মোদি আমেরিকার সঙ্গে এমন একটি চুক্তি করেছেন, যাতে আমেরিকা ভারতের পয়লা নম্বর গ্যাস-তেল সরবরাহকারী দেশ হয়ে উঠতে পারবে ৷ ভারতের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্যে 50 বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঘাটতি রয়েছে ৷ এই চুক্তিতে সেই ঘাটতির কিছুটা তো মিটবেই ৷
প্রেসিডেন্ট আরও জানান, দু'দেশই প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে অংশীদারিত্বে আরও বিস্তার ঘটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ৷ তিনি বলেন, "এই বছর থেকে শুরু হচ্ছে ৷ আমরা ভারতে সামরিক অস্ত্র, যন্ত্রপাতির বিক্রি কয়েক বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বৃদ্ধি করব ৷ ভারতে এফ-35 যুদ্ধ বিমান দেওয়ার রাস্তাও পরিষ্কার হয়েছে ৷" আমেরিকার এফ-35 যুদ্ধবিমান বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং আগ্রাসী বলে সুপরিচিত ৷
President Trump Hosts a Press Conference with Prime Minister Narendra Modi https://t.co/8pTo8JgbLI
— The White House (@WhiteHouse) February 13, 2025
তেল, গ্যাস, যুদ্ধবিমান কেনাবেচার পাশাপাশি বিশ্বের কট্টরপন্থী ইসলামিক জঙ্গি মোকাবিলাতে ভারত ও আমেরিকা একসঙ্গে কাজ করবে বলে ঘোষণা করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ৷ তিনি 26/11 মুম্বই হামলার মূল চক্রী তাহাউর রানার প্রসঙ্গে বলেন, "আমি খুব আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, আমার প্রশাসন বিশ্বের অন্যতম শয়তানের প্রত্যর্পণে ছাড়পত্র দিয়েছে ৷" রানা এখন লস অ্যাঞ্জেলেসে একটি ডিটেনশন সেন্টারে বন্দি ৷ তার সঙ্গে পাকিস্তানি-আমেরিকার জঙ্গি ডেভিড কোলম্যান হেডলির যোগাযোগ আছে বলে জানা গিয়েছে ৷
ট্রাম্প আরও বলেন, "তাকে ভারতে পাঠানো হচ্ছে ৷ সেখানে তার বিচার হবে ৷ আমরা এখনই তাকে ভারতের হাতে ফিরিয়ে দিচ্ছি ৷ এরকম আরও কয়েকটি প্রত্যর্পণের অনুরোধ পেয়েছি ৷ এরপর এই ধরনের বেশ কিছু প্রত্যর্পণ হবে ৷"
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও আশাবাদী যে, ভারত ও আমেরিকার মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক আরও ভালো একটি পৃথিবী গড়ে তুলতে পারে ৷ আগামী দশকের জন্য প্রতিরক্ষায় সহযোগিতার কাঠামো তৈরি হবে বলে মনে করেন তিনি ৷ তিনি বলেন, "একটা বিষয়ে আমি প্রশংসা না করে পারছি না। সেটা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছ থেকে জানলাম ৷ তাঁর কাছে আমেরিকার জাতীয় স্বার্থই সব ৷ তাঁরই মতো, আমিও ভারতের জাতীয় স্বার্থকে অন্য সবকিছুর উপরে স্থান দিয়েছি ৷"
ওয়াশিংটনে সাংবাদিক বৈঠকে শিল্পপতি গৌতম আদানিকে নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে ৷ শিল্পপতির বিরুদ্ধে ঘুষ দিয়ে কাজ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে আমেরিকায় ৷ এই প্রশ্ন অবশ্য সযত্নে এড়িয়ে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, "ভারত গণতান্ত্রিক দেশ ৷ আমাদের সংস্কৃতি 'বসুধৈব কুটুম্বকম' ৷ আমরা সারা বিশ্বকে একটা পরিবার বলে গণ্য করি ৷ আমার বিশ্বাস, ভারত আমার ৷ দু'দেশের দুই রাষ্ট্রনেতা কখনও এরকম কোনও ব্যক্তিগত বিষয়কে সামনে রেখে দেখা করেন না, আলোচনাতেও অংশ নেন না ৷"
ভারত-চিন আন্তর্জাতিক সীমান্ত সমস্যায় মধ্যস্থতা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, "আমি দেখেছি, সীমান্তে কিছু গোলমাল চলছে ৷ সেটা বিদ্বেষপূর্ণও বটে ৷ আমার মনে হয়, এভাবেই চলতে থাকবে ৷ ওই ঝামেলাগুলি মেটাতে আমি যদি কোনওভাবে কাজে লাগতে পারি তাহলে আমারই ভালো লাগবে ৷"
এদিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানান, বিশ্বের দরবার চিনের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ৷ তাঁর মতে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে বেজিং ভূমিকা নিতে পারে ৷ পাশাপাশি তিনি ভারত, চিন, রাশিয়া এবং আমেরিকার সহযোগিতার গুরুত্বের উপরেও জোর দেন ৷ ট্রাম্প বলেন, "আমি আশা করি, চিন, ভারত, রাশিয়া এবং আমেরিকা- আমরা সবাই একসঙ্গে চলতে পারি ৷ এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ৷"
তাঁদের এই বৈঠকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রসঙ্গটি বাদ যায়নি ৷ এই যুদ্ধ বন্ধে আগেই আগ্রহ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি ৷ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারে আশ্বাস দিয়েছিলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা তিনি করবেন ৷ এই বিষয়ে এদিন প্রধানমন্ত্রী বলেন, "এই যুদ্ধ শেষ করতে একটা সমাধানের রাস্তার সন্ধান করছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ৷ আমি তাঁকে সমর্থন করি ৷ বিশ্ব কোনওভাবে মনে করে ভারত এই যুদ্ধ নিয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে ৷ কিন্তু আমি আবারও বলতে চাই, ভারত কখনও নিরপেক্ষ নয়, ভারত শান্তির পক্ষে ৷"
তিনি আরও বলেন, "আমি প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে দেখা করে বলেছি, এটা যুদ্ধের যুগ নয় ৷ আমি আরও বলেছি, যুদ্ধক্ষেত্র কোনও সমস্যার সমাধান হতে পারে না ৷ সব পক্ষ আলোচনার টেবিলে এলে তখনই সমাধান বেরতে পারে ৷" ভারত, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপকে সংযোগকারী ইকোনমিক করিডর নির্মাণে রাজি ট্রাম্প ৷ তিনি বলেন, "বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে দুর্দান্ত রুট তৈরির জন্য কাজ করতে দু'পক্ষই সহমত হয়েছে ৷ "