কলকাতা/গুয়াহাটি, 12 মার্চ: লোকসভা ভোটে আর বাকি কয়েক সপ্তাহ ৷ তার আগে সোমবার দেশজুড়ে সিএএ কার্যকর করার ঘোষণা করেছে নরেন্দ্র মোদির সরকার ৷ আজ থেকে সারাদেশে কার্যকর হয়েছে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ৷ 2019 সালে সংসদের দুই কক্ষে পাশ হওয়ার পর অবশেষে সাড়ে চার বছর পর এই আইন কার্যকর হল ৷ নির্বাচনের আগে কেন্দ্রের এই ঘোষণা রাজ্য রাজনীতির পারদ চড়িয়েছে ৷
তবে লোকসভা ভোটের আগে সিএএ কার্যকর হতে পারে এই নিয়ে বেশ কয়েকমাস ধরে জল্পনা চলছিল ৷ বিজেপি নেতাদের মুখেও সে কথা বারেবারে শোনা গিয়েছে ৷ এবারের ভোটে সিএএ যে বিজেপির তুরুপের তাস হতে চলেছে তা আগেই আন্দাজ করা গিয়েছিল ৷ কারণ সিএএ কার্যকরী হলে বড় পরিমাণে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারদের সমর্থন পাবে গেরুয়া শিবির ৷ যদিও অমিত শাহের মন্ত্রকের এই পদক্ষেপ বিরোধী দলগুলিকে একজোটে বিজেপির বিরুদ্ধে খাড়া করেছে ৷ সম্ভবত কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে লোকসভা ভোটের আগে বিরোধীদের হাতিয়ার হতে চলেছে সিএএ ইস্যু ৷
সিএএ আইন কী?
এই আইনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানে মতো দেশগুলি থেকে মুসলিম ছাড়া অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা যারা 2014 সালের 31 ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতে এসেছেন, তারা এদেশের নাগরিকত্ব পাবেন । 2019 সালের ডিসেম্বরের শীতকালীন অধিবেশনে পাশ হয় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ৷ পরে তৎকালীন রাষ্ট্রপতির সাক্ষরে এটি আইনে পরিণত হয় ৷
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক মুখপাত্র বলেছেন, "যোগ্য ব্যক্তিরা সম্পূর্ণ অনলাইনে সিএএ'র জন্য আবেদন জমা দিতে পারেন । আবেদনকারীদের কাছ থেকে অন্য কোনো নথি চাওয়া হবে না ।"
যদিও কেন্দ্র সংখ্যালঘুদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছে যে এই আইনের মাধ্যমে কারও নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হবে না ৷ তবে একটি অংশের মানুষ সিএএ নিয়ে আশংকার মধ্যে রয়েছে । পাশাপাশি বিজেপি ক্ষমতায় নেই এমন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা সিএএ বাস্তবায়ন করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন ৷ এর মধ্যে রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ তৃণমূলের সঙ্গে 'ইন্ডিয়া' জোটের বাকি সদস্যরা সিএএ'র বিরুদ্ধে সরব হয়েছে ৷
লোকসভা নির্বাচনে সিএএ'র কী প্রভাব পড়বে পশ্চিমবঙ্গ ও অসমে ?
বাংলায় সিএএ বাস্তবায়ন
সিএএ কার্যকরের পর বিজেপির জন্য বাংলা একটি যুদ্ধক্ষেত্র পরিণত হবে ৷ কারণ পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার 27.01 শতাংশ (2011 সালের আদমশুমারি) মুসলিম । রাজ্যের মোট 23টি জেলার মধ্যে 6টিতে বেশিরভাগ মুসলিম সম্প্রয়াদের বাস । এছাড়া পূর্ব বর্ধমান এবং হাওড়াতেও উল্লেখযোগ্য মুসলিম জনসংখ্যা বেশি রয়েছে ।
রাজ্যে আনুমানিক ত্রিশ লক্ষ মুলসিম সম্প্রদায়ের মানুষ নদিয়া, উত্তর এবং দক্ষিণ 24 পরগনা জেলার অন্তত চারটি লোকসভা আসন এবং 30-40টি বিধানসভা আসনে ভোট দেবে । যেখানে বিজেপি বেশি আসন জেতার দিকে নজর রেখেছে লোকসভা অনুসারে উত্তরবঙ্গের 4-5টি আসনের উপর প্রভাব ফেলবে সিএএ ।
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (সিএএ) বাস্তবায়ন ছাড়াও অন্য দুটি দিক, পরিচয়ের রাজনীতি এবং আঞ্চলিক উন্নয়নও এই নির্বাচনে নির্ধারক কারণ হয়ে দাঁড়াবে ৷ কারণ চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল এবং বিজেপি বেশ কয়েকটি সম্প্রদায়কে আকৃষ্ট করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে । স্থানীয় সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তারা ।
মুর্শিদাবাদ, মালদা, দক্ষিণ 24-পরগনা, উত্তর 24-পরগনা, বীরভূম এবং উত্তর দিনাজপুর হল এমন জেলা যেখানে মুসলিম ভোট যে কোনও দলের জন্য একটি বড় ফ্যাক্টর ৷ এই ছয়টি জেলায় একত্রে দেখা গেলে, মুসলিম জনসংখ্যার 42.04 শতাংশ ।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সোমবার নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) নিয়ে বলেছেন, "এই সিএএ 2019 সালে পাশ হয়েছিল । কেন্দ্রকে এতদিন বিধি প্রণয়ন করতে কে বাধা দিয়েছিল ? নির্বাচনের ঠিক আগে কেন হঠাৎ জেগে উঠল? সিএএ কি বিজেপি সরকারের হাতের মিষ্টি? যদি কোনও আইন ব্যক্তির নাগরিকত্বের জন্য হুমকি হয়ে ওঠে তবে আমরা তার কঠোরভাবে বিরোধিতা করব ৷"
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, "পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু উদ্বাস্তুরা খুব খুশি ৷ এটি খুব ভালো পদক্ষেপ । কারও নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্চএ না । মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিভ্রান্তি তৈরি করার অনেক চেষ্টা করেছিলেন । এই আইন খুবই স্পষ্ট ৷ এটা নাগরিকত্ব দেওয়ার আইন, কেড়ে নেওয়ার জন্য নয় ৷"
সিএএ নিয়ে তোলপাড় অসম
জম্মু ও কাশ্মীরের পরে দেশে সর্বাধিক মুসলিমের বাস অসমে ৷ এই রাজ্যে মোট 3.12 কোটি জনসংখ্যার মধ্যে 34 শতাংশ মুসলিম ৷ সোমবার সিএএ কার্যকরের ঘোষণা হওয়ার পরেই বিক্ষোভ শুরু হয়েছে অসমে । পশ্চিমবঙ্গে এসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ একটি জনসভায় সিএএ বাস্তবায়নের বিষয়ে ঘোষণা করেছিলেন ৷ তবে বিক্ষোভের ঢেউ অসমে বেশি দেখা দিয়েছে ।
অল অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন-সহ বিভিন্ন দল ও সংগঠন এই আইনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে । কংগ্রেসের নেতৃত্বে গঠিত বিরোধী ঐক্য জোট 'ইন্ডিয়া'ও এই আইনের তীব্র বিরোধিতা করেছে । অল অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়নের প্রধান উপদেষ্টা সমুজ্জলকুমার ভট্টাচার্য বলেছেন, "একটি সত্যাগ্রহ আন্দোলন হবে । নর্থ ইস্ট স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশন সারা উত্তর পূর্ব ভারত জুড়ে আন্দোলন চালিয়ে যাবে । শান্তিপূর্ণ আন্দোলন এবং এর বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চলবে ৷ আমদের প্রতিবাদ করার অধিকার আছে । সেখানে সরকার আমাদের উপর অত্যাচার করতে পারে না । আমরা জনগণের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করব ।"
অন্যদিকে অল অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সভাপতি উৎপল শর্মা বলেছেন, "আমরা ইতিমধ্যেই 1971 সালের 24 মার্চ পর্যন্ত আসা বিদেশিদের বোঝা বহন করছি । এর পরে আবার 2014 সালের 31 ডিসেম্বর পর্যন্ত আসা বিদেশিদের বোঝা আরোপ করতে চাওয়া হয়েছে । এটা কোনো কারণে গ্রহণযোগ্য নয় ।"
অসম বিধানসভার বিরোধী দলনেতা দেবব্রত সাইকিয়া বলেছেন, "আজ সিএএ কার্যকর করে বিজেপি সরকার অসম এবং অসমিয়া জনগণকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে ৷ বিজেপি আবারও অসমিয়া জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ৷ তারা অসম চুক্তি লঙ্ঘন করেছে । কংগ্রেসও সিএএ-র বিরুদ্ধে বৃহত্তর আন্দোলন শুরু করবে ।"
অসম জাতীয় পরিষদের (এজেপি) সভাপতি লুরিনজ্যোতি গগৈয়ের দাবি, "সিএএ চাপিয়ে সরকার অসমিয়া জনগণের প্রতি অনেক অবিচার করল । জনগণের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে বর্ণবাদী আইনটি অসমের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে । অসমের মানুষ কখনোই এই আইন মেনে নেয়নি এবং মেনে নেবে না ।
এ দিকে অসমের রাজনৈতিক দলগুলিকে সিএএ-র বিরুদ্ধে প্রতিবাদে বনধের ডাক দিয়েছে ৷ এই প্রতিবাদ কর্মসূচিকে ঘিরে গুয়াহাটি পুলিশ আইনি নোটিশ ধরিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলিকে ৷
আরও পড়ুন: